প্রথম অধ্যায়ের লিঙ্ক
দ্বিতীয় অধ্যায়- খুঁজে ফিরি
“বোকামী আর সাহসিকতার মাঝে কোন সীমারেখা আছে কিনা তা যথেষ্ট বিতর্কপুর্ন- আর থাকলেই বা কি এসে যায়” - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক ব্রিটিশ বৈমানিক
প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী থাকার পর আমাকে স্থানান্তর করা হল এক আর্মি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ততদিনে আমি কিছুটা নড়াচড়া করতে সক্ষম, অল্প স্বল্প হাঁটতেও পারি কিন্তু পিঠের তীব্র ব্যাথা একদম অসাড় করে দেয়। নিজেকে খুব ভঙ্গুর আর নরম মনে হচ্ছিল। পরবর্তী ছ’সপ্তাহ প্রতিদিন আমার চিকিৎসা চলল সারাদিন ধরে। প্রথমে একজন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টরের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তিন ঘন্টা ষ্ট্রেচিং এক্সারসাইজ। তারপর এক টানা দু’ঘন্টা ফিজিওথেরাপী। বিশ্রাম নিয়ে এই পুরো চক্রটি আবার চলত। আস্তে আস্তে আমার নড়াচড়ার ক্ষমতা বাড়ছিল এবং পেশীর কার্যক্ষমতা ও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম যে আমি ধীরে ধীরে সেরে উঠছি আর তাঁতে আত্ববিশ্বাস ও খানিকটা ফিরে পেলাম।
দুর্ঘটনার প্রায় আটমাস পর আমি যখন পুনর্বাসন কেন্দ্র ত্যাগ করি তখন আমার সেরে উঠার গতি বেশ দ্রুত। পিঠের কার্যক্ষমতা প্রায় পুরোটাই ফিরে পেয়েছি এবং যদি আরো চারমাস ব্যায়াম অব্যাহত রাখি তাহলে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাব, এই অভিমত ই দিলেন ডাক্তার। তার মতে আমার অবস্থা এখন অনেক ভালো আর আমি সম্ভবত সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যাক্তিদের একজন। তিন বছরের শিশু ছোট্ট প্লাষ্টিকের বাথটাবে হিসু করে ধরা পড়লে যেমন অপ্রস্তুত হাসি দেয় ডাক্তারের কথা শুনে মুখে সে রকম একটি হাসি ঝুলিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্র ত্যাগ করলাম। আসলেই আমি অনেক ভাগ্যবান।
সেরে উঠার এই দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়া আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিল জীবন কত মুল্যবান। চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়ার খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি ইশ্বরের দয়ায় আর এই গল্প বলার জন্য। এই আট মাসে জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
গ্রীষ্মের এক মনোরম সকালে ঘন নীল আকাশের সান্নিধ্যে এক গ্লাস রিবেনায় চুমুক দিতে দিতে আমি ভাবলাম আমার জীবনের ঘটনাপ্রবাহের কথা। ব্রিটিশ আর্মির ২১ স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে তিনটি অসাধারন বছর কাটানোর পর আমি অবসরের কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। সেনাবাহিনীতে আমার কাজের ধরন অত্যন্ত ডিমান্ডিং- হোকনা তা ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ওজনদার ভার বহন করে ছুটে চলা কিংবা রাতের আকাশে প্যারাশুট নিয়ে মাটিতে লাফ দেয়া। মোদ্দা কথা কাজের ধরন যাই হোকনা কেন শরীরকে অনেক চাপ নিতে হয়। আর্মি থেকে অবশ্য আমাকে সব ধরনের সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে চাকরি আগের মত চালিয়ে যাওয়ার জন্য। পুনর্বাসনের পর তারা আমাকে শারীরিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত বলে রায় দিয়েছে কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে।
আমার মা বাবা অবশ্য চাইছিলেন সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করার আগে আমি কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেই, আমি তাই করলাম এবং সকলেই দ্বিধাহীন ভাবে জানিয়ে দিলেন যে এই চাকরি চালিয়ে যাওয়া হবে চুড়ান্ত পাগলামি। ডাক্তারদের সকলেই আমাকে সতর্ক করে দিলেন আমি যদি পিঠে ভারি ব্যাগ নিয়ে ফের প্যারাশুট বেঁধে লাফ দেই এবং দু একটা ল্যান্ডিং যদি বিগড়ে যায় তবে আমার পিঠে দীর্ঘ মেয়াদে আথ্রাইটিস জনিত গুরুতর জটিলতা তৈরী হবে। পরিনতি নিয়ে অবশ্য ডাক্তারদের মধ্যে দু দলের সৃষ্টি হল। তবে ডাক্তারদের মতামত যাই হোকনা কেন আমি কোন ঝুকি নিতে চাইনা। ইতিমধ্যে ভাগ্য একবার আমার প্রতি অতি সদয় আচরন করেছে, সেনাবাহিনীতে আরো কয়েক বছর চাকরীর জন্য আমি ভাগ্যকে আর কোন সুযোগ দিতে চাইনা। তারপর ও ছেড়ে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুরা তখনও আর্মিতে, তাদের ছেড়ে যেতে হবে, ত্যাগ করতে হবে উত্তেজনায় ঠাসা সাহসিকতাপুর্ন সব কাজ।
আমার হাতে বিকল্প বেশী কিছু ছিলনা। দুর্ঘটনার পর সেরে উঠলেও প্যারা জাম্পিয়ংয়ের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পুরন করা আমার জন্য ঝুকিপুর্ন ছিল, ভবিষ্যতেও ঝুঁকি রয়ে গেছে। আর আমি ইউনিটের অকার্যকর সদস্য হিসেবেও একদম থাকতে চাচ্ছিলামনা। দুর্ঘটনার বেশ চড়া মুল্যই দিতে হল মনে হয়। সেনাবাহিনীর সময়টা আমি পুরোপুরি উপভোগ করেছি আর আমার নিজ রেজিমেন্টের হয়ে কাজ করতে পারাটা ছিল আমার জন্য গর্বের ব্যাপার। তাদের পেশাদারিত্ব এবং রসবোধ ছিল অতুলনীয়। উনিশ বছর বয়সে আমি যখন যোগদান করি আমার উপর তাদের আস্থা এবং সক্ষম পেশাদার হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহ প্রদানের জন্য আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
আমার স্কুলের বন্ধুরা যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তাদের অধিকাংশই রয়াল গার্ড কিংবা ক্যাভালারিতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে শুরু করেছে। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম সেনাবাহিনীর জীবনটা আমি একদম নিচ থেকে দেখব। আর তাই যোগ দিয়েছিলাম আর্মির সবচেয়ে নিচু পদে ‘স্কোয়াডি’ হিসেবে। এটি একেবারেই প্রাথমিক ধাপের মাঠ পর্যায়ের নিয়োগ, যেখান থেকে সত্যিকার সৈনিকের জীবন শুরু হয়। এখানে কেতাদুরস্থ কিছু নেই, নেই কোন বর্ণাঢ্য জৌলুস, পরস্পরকে পৃথক করতে নেই কোন সামরিক পদের উপস্থিতি- এখানে আমরা যারা আছি সবাই সহজ, সরল হয়তো কিছুটা বুনোও। আমার এই সিদ্ধান্তটি ছিল জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আমি এমন সব ভালো বন্ধু পেয়েছি যা আমি কখনো কল্পনা করিনি। এই বন্ধুত্বের ভিত্তি অনেক গভীর যার জন্ম বিপদে, ভয়ে, ঠান্ডায় কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ আর সহমর্মিতা থেকে। সেনাবাহিনী ছাড়ার পর আমি সবচেয়ে বেশী যে ব্যাপারটির অভাব বোধ করব তা হল আমার প্রিয় এই সৈনিক বন্ধুদের।
সামরিক জীবন পেছনে ফেলে আসার পর আমার আরেকটি পেশা খুঁজে নেয়ার কঠিন কাজ শুরু হল। কিন্তু খুঁজে পাওয়া তো দুরের কথা এমনকি আমার বর্তমান অবস্থার জন্য উপযুক্ত কোন পেশার দেখা পাওয়া ও দিনকে দিন দুষ্কর হয়ে পড়ল। হতাশার সাথে পাল্লা দিয়ে একটি একটি উপযুক্ত পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার প্রয়োজনীয়তা ও বাড়ছিল। বাস্তবতা আর স্বপ্নের মাঝের ফারাক এক তিক্ত অনুভুতির জানান দিচ্ছিল। দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার জোগান আর স্বপ্নকে তাড়া করার ইচ্ছা ভারসাম্যপুর্ন অবস্থায় থাকছেনা। সামনে এক কঠিন রাস্তা। কিন্তু বুকের গভীরে আমি জানতাম আমাকে হৃদয়ের কথা শুনতে হবে আর তাই উন্মুখ হয়ে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।
গুজবের কোন হাত পা নেই কিন্তু কিভাবে তা আমার কানে এসে পৌছল আমি এখন তা স্মরন ও করতে পারছিনা। কিন্তু এটিই আমার জীবনে গুরুত্বপুর্ন প্রভাব বিস্তার করল। কখন, কিভাবে আর কার মাধ্যমে জানিনা তবে আমার কানে পৌছল যে আমার এক পুরোন বন্ধু এভারেষ্ট জয়ের পরিকল্পনা করছে এবং সেই উদ্দেশ্য দল গঠনের আয়োজন করছে। নেইল লফটন, প্রাক্তন রয়াল মেরিন কমান্ডো; বলিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা এবং পরবর্তীতে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি আমার দেখা সবচেয়ে প্রেরনাদায়ক ব্যাক্তিদের একজন।
নেইল ১৯৯৬ সালে এভারেষ্টে গিয়েছিল, সেই বছর যখন মে মাসে এভারেষ্টের উপর দিয়ে তীব্র ঝড় বয়ে গিয়েছিল এবং পরিনতিতে চব্বিশ ঘন্টার ব্যাবধানে আটজন পর্বতারোহীর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। এদের কয়েকজন ঠান্ডায় জমে মৃতুবরন করেন নিজেদের তাবুর মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে আর বাকিরা সাড়ে সাত হাজার মিটারের উপরে ডেথ জোনে অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়ে আটকে পড়ে এভারেষ্টের বিপদ সংকুল ঢালে।
২৬০০০ ফুটের অধিক উচ্চতায় আরোহন অনেক নির্মম হতে পারে, এবং সেই রাতে তীব্র তুষার ঝড় নেইলকে চার নম্বর ক্যাম্পে প্রায় অক্ষম অবস্থায় গেঁথে রেখেছিল আর নেইল প্রাণপণ সংগ্রাম করছিল নিজের প্রাণ রক্ষার। সেদিন ক্যাম্প চারে থাকা পর্বতারোহীদের মধ্যে যারা প্রানে বেঁচে ফিরেছিল নেইল ছিল সেই সৌভাগ্যবানদের অন্যতম।
এবার নেইল একটি নতুন দল দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের লক্ষে। কি সেই দুর্নিবার আকর্ষন পর্বতের যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ডাকে তার বিপৎসংকুল ঢালে আর জীবন বাজি রেখে মানুষ ছুটে চলে তার পানে- কেবল কি শুধু চূড়ায় আরোহনের মুহুর্তকাল সুযোগর জন্য নাকি চূড়ায় ক্ষনকাল একাকী মুহুর্তের আকাঙ্ক্ষায়? উত্তর যাই হোক না কেন নেইলকে এবার বেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনে হল যা সে ১৯৯৬তে অসমাপ্ত রেখে এসেছিল তা এবার তা পুর্ন করতে। আর আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার বুকের গভীরে কি এক বোধ আস্তে আস্তে মাথাচাড়া দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ রাত ৯:০৩