ভরা পুর্নিমায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে নৌকায় রাত কাটানোর প্ল্যান ছিল অনেকদিনের। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে হয়ে উঠেনি। অবশেষে গত অক্টোবরে ভরা পুর্নিমায় না হোক এক সেমি পুর্নিমায় পাঁচজন বন্ধু যাদের কয়েকজন সহকর্মীও সুনামগঞ্জের পথে রওনা হলাম। ভালো কোন এসি বা নন এসি বাসের টিকেট না পেয়ে মামুন পরিবহনেই যাবার সিদ্ধান্ত হল। আট ন’ ঘন্টার নট সো গুড বাস জার্নির পর কাক ডাকা ভোরে সুনামগঞ্জ পৌছলাম। বাস ষ্ট্যান্ডের পাশের দীনহীন এক আবাসিক হোটেলের একটি রুম অনুরোধ করে ঘন্টা কয়েকের জন্য ভাড়া নিলাম ফ্রেশ হয়ে নেবার জন্য। হাত মুখ ধুয়ে গোসল সেরে মালপত্র সব রুমে রেখে স্থানীয় এক বেড়াদিয়া রেষ্টুরেন্টে গরম গরম পরটা ডাল দিয়ে নাস্তা করলাম। তারপর বের হলাম একটি হিউম্যান হলার ভাড়া করতে। আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় জাদুকাটা নদী, বারিক টিলা ঘুরিয়ে আমাদের নামিয়ে দিবে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে যেখান থেকে মিলবে টাঙ্গুয়া যাবার ইঞ্জিন নৌকা। মাথার উপর গনগনে রোদ নিয়ে যাত্রা শুরু সীমান্ত ঘেষা জাদুকাটা নদীর উদ্দেশে। প্রথম দিকে বেশ লাগছিলো। চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ি, দূরে মেঘালয়ের পাহাড়সারি উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু একটু পরই রাস্তা হয়ে উঠলো এবড়োথেবড়ো ধূলিধূসরিত। বসে থাকাই দায়। এভাবেই ঝাঁকি খেতে খেতে প্রায় একঘন্টা পর রাস্তা ভুল করে সীমান্ত ঘেষা এক বিজিবি ক্যাম্পে পৌছলাম। সেখানকার জওয়ানদের কাছে থেকে পথের ঠিকুজি বুঝে নিয়ে আবার যাত্রা। আধাঘন্টা পর একটি বাজারে পৌছলাম নামে খেয়াল নেই। বেশ বাড়ন্ত বাজার, দোকানপাট, মানুষ আর ধুলো সব কিছুরই আধিক্য।
গাড়ি এর পর আর যাবেনা। সামনে রাস্তা কাটা। কয়েকজন বাইকওয়ালা পাওয়া গেল। ওরাই ট্যুরিষ্টদের ঘুরিয়ে আনছে জাদুকাটা নদী আর বারিক টিলা থেকে। জনপ্রতি ১২০ টাকা করে পাঁচজন তিনটি বাইকের পিছনে উঠে বসলাম। এবড়োথেবড়ো গ্রাম্য মেঠো পথ পেরিয়ে মিনিট পনর পরেই মরুভূমির মত ধূধূ বালির মাঠে এসে পৌছলাম। এটি আসলে জাদুকাটা নদীর পাড়। কাক চক্ষু পানির ব্যাস্ত নদীতে হাজার হাজার ডিঙ্গী নৌকা, কেউ বালু তুলছে, কেউ বা নুড়ি পাথর সংগ্রহ করছে। নদী গিয়ে সোজা ভারতের পাহাড়সারিতে মিশেছে। নীলাভ পাহাড় সারির অবিরত বিস্তার দেখতে দারুন লাগছে। শুধু আফসোস ভারতের অংশ হওয়ায় সেখানে যাবার কোন উপায় নেই। অগভীর চওড়া নদীতে আকাশের প্রতিফলন দেখতে চমৎকার লাগছে। নদীর অপর পারেই বারিকটিলা। একটি বড় নৌকায় কাঠের পাটাতন ফেলে ফেরীর মত বানানো হয়েছে। সেটিই পারাপারের কাছে ব্যাবহৃত হচ্ছে। মটর সাইকেল, মানুষ, মালামাল, হাস মুরগি সব কিছু নিয়ে নৌকা অপর পাড়ে গেল। আমাদের বাইক পিছনে রয়ে গেল। আমরা বারিক টিলা ঘুরে এসে এই বাইকে করেই আবার বাজারে ফেরত যাব। বারিক টিলায় আলাদা করে তেমন দেখার কিছু নেই। উপর থেকে জাদুকাটা নদী, অনতিদূরে মেঘালয়ের দীর্ঘ পাহাড়সারি, নদীতে ডিঙ্গী নৌকার সমারোহ এসব দেখতে অবশ্য ভালোই লেগেছে। এদিক ওদিক ঘুরে আধাঘন্টা মত কাটিয়ে আবার খেয়া পাড়ি দিয়ে বাইকে উঠলাম। ফেরার পথে শাহ্ আরেফিনের মাজার পরিদর্শন করলাম। একদম সীমান্তের পাহাড় ঘেষে এই মাজার। শান্ত, সবুজ আর সুন্দর জায়গা। মাজার থেকে একটু দূরে একটি দুর্দান্ত ঝরনা আছে। কিন্তু এখন পানিশূন্য। শুধু কালো পাথর সারি হা করে তাকিয়ে আছে। যা হোক বাজারে গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আবার যাত্রা তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। বিকেলের কিছু আগে তাহিরপুর বাজারে পৌছলাম।
তাহেরপুর পৌছে প্রথমেই ঘাটে গেলাম যুতসই একটি নৌকা ভাড়া করতে। সাম্প্রতিক সময়ে নৌকার ভাড়া অনেক বেড়েছে। যে ভাড়া হাঁকাচ্ছিল তাতে গোটা নৌকা কিনে নেয়া যায়। দশ বারো হাজার টাকা পর্যন্ত দাবী করছিল এক রাতের জন্য যা কোনভাবেই দু আড়াই হাজারের বেশী হবার নয়। যা হোক এক ঘন্টা দরাদরি করে সাড়ে তিন হাজার টাকায় মাঝারি সাইজের একটি নৌকা রফা করলাম। তারপর বাজার সদাইয়ের পালা। মুড়ি চানাচুর থেকে শুরু করে মুরগি সবজি, মশার কয়েল, চা পাতা, ,গুড়ো দুধ সব কেনা হল। মিনারেল ওয়াটার কেনা হল বারো লিটারের মত। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, আমাদেরও তর সইছিলনা। মালপত্র সব নিয়ে নৌকায় উঠে পড়লাম। যাত্রা শুরু হল তৎক্ষণাৎ। ঘাট থেকে ফানেলের সরু মুখের মত একটি জল পথ সোজা হাওরে পড়েছে। মিনিট পাঁচ দশেকের ভিতর আমরা হাওড়ে ঢুকে পড়লাম। হঠাৎ করেই যেন অন্য এক জগতে চলে আসলাম। চারিদিকে কাজল কালো জল। ভালো করে খেয়াল করলে নিচে শেওলার ঝাক চোখে পড়ে। দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের কালো সারি আবছা চোখে পড়ে। হালকা বাতাসে মৃদুমন্দ ঢেউ উঠেছে হাওরে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা কিন্তু মেঘ করে করেও আসছেনা।
চারিদিকে জলের বিস্তার এত বিশাল যে পুরোপুরি দিকভ্রান্ত আমরা। কোথায় যাচ্ছি তার কিছুই ঠাহর হচ্ছেনা, অবশ্য তাতেই বা কি আসে যায়। নির্বাক সবাই নৌকার ছইয়ের উপর যুত করে শুয়ে বসে চারপাশের বিশালতাকে ধারন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো। যেন একটা বড় কালো চাদর দিয়ে ধীরে ধীরে চারপাশ কেউ ঢেকে দিল। তখনো চলছি আমরা। এর মাঝেই একদফা চা হয়ে গেল, সাথে চানাচুর, মুড়ি। সিগারেট ও চলতে লাগল হাত থেকে হাতে। হাওরের মাঝে ছোট ছোট কিছু দ্বীপের মত উচু জমি আছে যেখানে মানুষের বসতি আছে। সেরকমই চারপাশ জলমগ্ন এক চিলতে উচু জমিতে কয়েক ঘর বসতি নিয়ে একটি দ্বীপের মত জায়গায় আমরা রাতের মত নোঙ্গর করলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত আট। তিন ঘন্টা একটানা চলেছি। মাঝির বাড়ি এখানেই। রান্না হবে তার উনুনেই। সে রান্নার সব উপকরন নিয়ে নেমে গেল। আমরা নৌকার ছইয়ের উপর বসে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে হাওয়া খাচ্ছি, দূরে মেঘালয়ের পাহাড় কেটে বানানো রাস্তায় যানবাহনের চলাচল বোঝা যাচ্ছে হেডলাইটের সঞ্চারনশীল আলো দেখে। আকাশে অর্ধেক চাঁদ চারপাশ ধুয়ে দিচ্ছে নরম আলোয়। ঘন্টাখানেক পর মাঝি খাবার নিয়ে আসলো। পুরো এক ডেকচি ল্যাটা খিচুরী, ডিমের ঝোল, মুরগি, সালাদ আর এক বন্ধুর বুদ্ধি করে নিয়ে আসা ছোট এক কৌটা খাঁটি গাওয়া ঘি। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে হাপুস হুপুস করে খেলাম সবাই। পরিবেশের কারনে সাধারন খাবারই অসাধারন হয়ে উঠলো। খাবার শেষ করে আবার ম্যারাথন আড্ডা। শেষ রাতে সবাই ঘুমাতে গেলাম নৌকার নিচের কুঠুরিতে। আবার চলা শুরু হবে সেই ভোরে।
ভোর ছ’টার দিকে সবাই ঘুম থেকে উঠে গেলাম। নিকটেই হাওড়ের মাঝে বিজিবি ক্যাম্প। সেখানকার বাথরুম ব্যাবহার করলাম সবাই। মাঝি অনেক ভোরে উঠে আবার খিচুরি রান্না করে এনেছে। সাথে ডিম। দ্রুত খেয়ে রওনা হলাম। ভোরের হাওরের সৌন্দর্য বর্ননাতীত। চলন্ত নৌকার গলুইয়ে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে ভোর হওয়া দেখলাম। আধঘন্টার মধ্যে পৌছলাম লম্বা এক সারি হিজল বনের প্রান্তে। সেখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। উচুতে উঠে চারপাশের দিগন্ত পর্যবেক্ষন করলাম। কিছুক্ষন কাটিয়ে আবার যাত্রা। এবার থামলাম একটি কান্দায়। কান্দা মানে হাওড়ের একটু উঁচু এলাকা। পানি আছে তবে হাটু কিংবা তার নিচ পর্যন্ত। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পায়ে বাড়ি দিচ্ছে। কান্দায় নেমে হুটোপুটি করে গোসল করলাম। আরো প্রায় এক ঘন্টা হাওড়ের এধার ওধার ঘুরে তারপর রওনা হলাম ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনির দিকে। খনি এখন পরিত্যাক্ত, চুনাপাথরের মজুদ শেষ হবার পর একটি লেকের সৃষ্টি হয়েছে। সেটি দেখতে যাচ্ছি। যাবার পথটি দারুন। পাশে পাহাড় একদম নিকটে। স্থানে স্থানে হিজল গাছের সারি। রাখাল গরু চরাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা নির্ভয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে পানিতে। ভালো সাতারু এক একজন। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে পৌছে গেলাম ট্যাকেরঘাট। সীমান্তের একদম লাগোয়া জায়গাটি। একপাশে হাওর, তারপর রাস্তা তারপর মেঘালয়ের পাহাড় শ্রেনী। পাহাড়ের গায়ে ভারতীয় বাড়িঘড়, গাড়ির আসা যাওয়া দেখা যাচ্ছে। রাস্তা পার হলেই পরিত্যাক্ত খনির সীমানা। তার ঠিক আগে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরনে একটি স্মৃতিসৌধ। এটি দেখে খনি অঞ্চলের দিকে পা বাড়ালাম। এদিক ওদিক পরিত্যাক্ত হেভি মেশিনারি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে। লেকের দিকে গেলাম। টানা লম্বা লেক, চারপাশে কার্পেটের মত সবুজ ঘাস। ওপারেই ভারতের সীমানা। পানির ধারে কিছুক্ষন বসলাম। এক ঘন্টার মত কাটিয়ে অতঃপর আবার যাত্রা। এবার ফেরত যাবার পালা। হাওড়ের বুক চিরে আমাদের নৌকা ছুটে চলল তাহিরপুরের দিকে। বুক ভর্তি বিশুদ্ধ বাতাস আর দু’চোখে সুখস্মৃতি নিয়ে দু ঘন্টার ভিতর পৌছে গেলাম তাহিরপুর বাজার। মালপ্ত্র গুছিয়ে পাঁচশত টাকায় একটি স্কুটার ভাড়া করে সুনামগঞ্জের পথে। সুনামগঞ্জ পৌছেই দেখলাম একটি বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়বে ছাড়বে করছে। টিকেট ও আছে। অতএব দেরি না করে উঠে পড়লাম। আর এভাবেই শেষ হল একটি ঝটিকা হাওড় ট্রিপ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪০