(প্রথম পর্ব)
পরপর দু’বার ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বিলাত দেশটার প্রতি বিজাতীয় বিতৃষ্ণা এসে গেল। ভিসা দেবার আরজি করে দু’দুটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের চিঠি পেয়েও তাদের মন নরম হলনা। আর রিফিউজ লেটারের সেকি ভাষা। পিত্তি জ্বলে যায়। তাদের ঘোর সন্দেহ বিলাত গিয়ে আমি আর ফিরবনা অথবা দেশটির স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোন কাজে লিপ্ত হব। মেজাজ খুবই খারাপ হল, ট্রেনিংয়ের গুষ্টি কিলাই, বিলাত যাবার কোন দরকার নেই। কিন্তু অফিস থেকে বলল আবার এপ্লাই করতে। হাতে সময় বেশী নেই, মাত্র এক সপ্তাহ অর্থাৎ পাঁচ কার্যদিবস আছে যাওয়ার দিনের। টাকা দেবে গৌরী সেন, অতএব তৃতীয়বারের মত আবেদন করলাম। সাথে সবিনয় অনুরোধ করে চিঠি দিলাম যে আমি এ দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন শান্তিপ্রিয় নাগরিক, ইতোমধ্যে বেশকটি দেশ ভ্রমন করেছি এবং উক্ত দেশসমুহের কোনরূপ ক্ষতি করা ব্যাতিরেকে সহিসালামতে আপন দেশে ফিরত এসেছি, সুতরাং আমাকে ভিসা দিলে কোনরূপ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই এবং পরিশেষে ভিসা যদি দেওয়ার মর্জি হয় হয় তা যেন দেয়া হয় ১৯ তারিখের আগে। ব্রিটিশ এম্ব্যাসিকে সময় দিলাম ৫ কার্যদিবস। ধরে নিয়েছি এবারো হবেনা, এর আগে একমাস সময় নিয়ে দু দুবার রিফিউজ করেছে, এবার এত কম সময়ে দেওয়ার কোন কারন নেই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তৃতীয়বার আবেদনের চারদিনের মাথায় ভিসা দিয়ে দিল। সম্ভবত রবার্ট ব্রুসের সাথে আমার মিলে খুজে পেয়েছে। যেতে হলে আমাকে সেদিন রাতেই যেতে হবে। অফিসের নির্ধারিত ট্রাভেল এজেন্টকে বললাম টিকেট ম্যানেজ করতে। এমিরেটসের বিজনেস ক্লাসের টিকেট পাওয়া গেল আগুন দামে। অফিস বলল ওরা পে করবে। সুতরাং টিকেট ও কনফার্ম হল।
রাত ন’টায় ফ্লাইট। অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা গড়িয়ে গেল। বাসায় ঢুকে একটি ঢাউস স্যুটকেসে দ্রুত কিছু জামা কাপড় ভরে শীত সামাল দেওয়ার জন্য হিমালয় ট্রেকিংয়ের ডাউন জ্যাকেটখানি আর একটি ভদ্রস্থ ভারী জ্যাকেট ঢুকিয়ে পায়ে একজোড়া সস্তা বিলাতি হান্টিং বুট গলিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। সারা ঢাকা শহরের সকল গাড়ি বোধহয় সেদিন এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিয়েছে। যখন সাড়ে ছয়টা বাজে আমি তখনও ফার্মগেট পৌছাইনি। ভাবলাম ব্রিটিশ এম্ব্যাসি শেষ পর্যন্ত ভিসা দিলেও এই জ্যাম নিশ্চিত ফ্লাইট মিস করাবে। অফিসের বস ফোন করে বলল রাত আটটায় এমিরেটসের কাউন্টার বন্ধ হয়। কাউন্টার বন্ধ হবার পর ওরা কোন প্যাসেঞ্জার এন্টারটেইন করেনা। টেনশনে প্রায় বাথরুম পেয়ে গেল। বনানী কাকলী পার হতে হতে সোয়া সাতটা। অতঃপর ভাগ্যদেবী সদয় হল বোধহয়, বাকি পথ এক টানে চলে আসি কিন্তু এয়ারপোর্টের ঢোকার মুখ থেকে ডিপার্টচার লাউঞ্জ পর্যন্ত পুরোটা গায়ে গায়ে লাগালাগি করা জ্যাম। পৌনে আটটা। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মুল রাস্তার মাথা থেকে ল্যাপি ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে ঢাউস স্যুটকেসখানা টেনে টেনে হাটা দিলাম। সাতটা পঞ্চান্ন। সিকিউরিটি চেক করিয়ে দৌড়ে এমিরেটসের কাউন্টারে গেলাম। শীতেও ঘেমে একসার। বিজনেস ক্লাসের লাইনে আরও দুইএকজন দাঁড়িয়ে। ফ্লাইট আধাঘন্টা লেট স্বস্তির এক পরশ বুলিয়ে দিল।
যা হোক, ন’টার ফ্লাইট সাড়ে ন’টা নাগাদ ছাড়ার প্রস্তুতি নিল। এমিরেটসের ছুরির ফলার মত ধারালো বিমানবালা সম্ভাষন জানিয়ে সিট দেখিয়ে দিল। বোয়িং ট্রিপল সেভেন-থ্রি হান্ড্রেড ই আর গো গো করে আকাশে উড়াল দিল। কিছুক্ষন পর সেই বিমানবালা জুস নিয়ে আসল আর আমার জ্যাকেটখানা ক্লজেটে ঝুলিয়ে রেখে দিতে চাইল যেন আরেকটু আরামে বসতে পারি। সুন্দরীর হাতে জ্যাকেটখানা ধরিয়ে দিলাম, আমি না হই, অন্তত জ্যাকেটখানা ঐ চম্পাকলি আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে ধন্য হোক। তারপর তরিবত করে অরেঞ্জ জ্যুসে চুমুক দিতে দিতে এভারেষ্ট মুভিখানা চালিয়ে দিলাম। মুভি শেষ হবার আগেই রাতের খাবারের আহ্বান আসলো। ষ্টার্টার আর মেইন কোর্স সিলেক্ট করে দিলাম। বিজনেস ক্লাস বলে বেশ জামাই আদর। সামনের সিটের এক মাঝ বয়সী সাদা চামড়া সেই ধারালো বিমান বালার সাথে বেশ বাকবাকুম করে চলছে। আলাপে বুঝলাম বালিকার আদিনিবাস কাশ্মির (তাই তো বলি), ইংল্যান্ডে সেটল্ড অনেক বছর ধরেই। পাশের যাত্রীর সাথে আলাপ হল। শক্তপোক্ত চেহারার টাক মাথার ষাটোর্ধ ভদ্রলোককে প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানী। সাথে বিদেশিনী স্ত্রী। বিমান বালার সাথে কথা বলছিলেন চোস্ত ইংরেজীতে। তারপর সুন্দরীর কাশ্মিরি অরিজিন জানতে পেরে খাটি উর্দু এবং পরিশেষে চমৎকার হিন্দি। কিছুক্ষন পর সুন্দরীকে ক্ষান্ত দিয়ে আমার সাথে যখন খাস ঢাকাইয়া ভাষায় আলাপ শুরু করলেন বুঝলাম আমার মতই বাঙ্গাল। ভদ্রলোক পুরান ঢাকার লোক, জার্মান দেশে থাকেন সেই চৌষট্টি সাল থেকে। আগে বছরে দু’বার আসতেন। গত কয়েক বছরে আসেন একবার করে। বাংলাদেশ আর জার্মান দু’দেশেই ছোটখাট ব্যাবসা আছে। কিসের ব্যাবসা তা আর জিজ্ঞেস করিনি। মাঝে মাঝেই ঝরঝরা জার্মানে বউয়ের সাথে কথা বলছিলেন। এটা ওটা আলাপের পর অনেক দিন বিদেশে থাকা লোকজনের যা হয়, দেশের বদনাম শুরু করলেন। দেশের এই খারাপ, ওই খারাপ। কোন সিষ্টেম নেই। কোন নিয়মনীতি নেই। আইন নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা সত্য, তারপর ও বিদেশে থাকা লোকজনের কাছে দেশের বদনাম শুনলে মেজাজ খারাপ হয়। তারপর আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমাদের মত ইয়ং ছেলেদেরে এগিয়ে আসতে হবে এই দেশকে পরিবর্তন করতে। আমাকে উপদেশ প্রদান করতে করতে ক্লান্ত হয়েই বোধহয় হোয়াইট ওয়াইনের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিলেন। আর আমিও তাকে দেশ উলট পালট করে ফেলার আশ্বাস দিয়ে অনিয়ন স্যুপে মনোযোগ দেই আর একটি শক্ত রুটিকে ছুরি দিয়ে কায়দা করায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ি।
রাতের খাবার শেষ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে সিটখানাকে খাট বানিয়ে আরাম করে মুভি দেখতে দেখতে ঘুম। ঘুম থেকে জেগে দেখি দুবাই মাত্র আধাঘন্টার কিছু বেশী। দুবাই নেমে দ্রুত এমিরেটসের লাউঞ্জ খুজে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম আর ফ্রি ওয়াইফাইতে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলাম আধাপথ এসেছি। দুঘন্টা পর আবার যাত্রা। দেড় ঘন্টা বিজনেস লাউঞ্জের ফ্রি খাইদাই আর ফেসবুকিংয়ে কাটিয়ে দিলাম। এবার এয়ারবাস থ্রি এইট জিরো, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় প্যাসেঞ্জার প্লেন আর সময় সাতঘন্টার কিছু বেশী।এই ঢাউস বিমানটি কিভাবে আকাশে উড়ে ভেবে অবাক হলাম। বিমান যথাসময়ে ছাড়লো, সব ঠিকঠাক থাকলে সকাল সোয়া সাতটায় হিথরো পৌছবো। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে সোজা ইউনিভার্সিটিতে দৌড়াতে হবে। একদিন দেরি করে রওনা দিয়েছি ভিসা দেরিতে পাবার কারনে। তাই ইউনিভার্সিটি ডরমিটরিতে লাগেজ রেখেই সোজা ক্লাসে জয়েন করতে হবে। ক্লাস শুরু সাড়ে আটটায়। কাঁটায় কাঁটায় সাতটা দশে ঢাউস বিমানটি হিথ্রো স্পর্শ করলো। দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার জন্য প্লেনেই এমিরেটস থেকে প্রায়োরিটি পাস দিয়েছে। নেমেই দ্রুত দৌড়ালাম ইমিগ্রেশনের প্রায়োরিটি কাউন্টারের দিকে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের বিলাতি কৃষ্ণ সুন্দরী তেমন একটা পুছতাছ করলোনা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভাইটেশন লেটারখানা দেখতে চাইলো। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে লাগেজ কালেক্ট করে এমিরেটসের হেল্প ডেস্ক খুজতে লাগলাম। ফ্রি লিমো সার্ভিস দেবার কথা। কাউন্টারে গিয়ে বললাম আমার জন্য একটা লিমোজিন সার্ভিস বুক করা আছে। বিলাতি মেম বোর্ডিংপাস চেক করে পাঁচ মিনিট বসার অনুরোধ করলো। কিছুক্ষন পর একজন এইড এসে আমার ঢাউস লাগেজ খানা কালো মার্সিডিসে তুলে দিল। আরামদায়ক সিটে গা এলিয়ে দিয়ে আমি চললাম লন্ডন শহরের উদ্দেশ্যে। ইউনিতে পৌছতে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগবে। (ছবি আগামী পর্ব থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৯