অন্নপুর্না বেসক্যাম্প ট্রেক-১
কাঠমন্ডু থেকে পোখারার সমস্ত বাস সকাল সাত থেকে আটটার মধ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রোবাস টাইপের ভ্যানে করে ও যাওয়া যায়। থামেলের লাগোয়া কান্তিপথ থেকে এসব বাস ছাড়ে। সকাল গিয়ে দেখি জায়গাটি ততক্ষনে নানা দেশের পর্যটকে মুখরিত। কাঠমন্ডু থেকে পোখারার দুরত্ব ১৭৪ কিলোমিটার, সাত থেকে আট ঘন্টার জার্নি। রাজা পৃথ্বি নারায়ন শাহ্ এর নামে এই হাইওয়ের নামকরন। চীন সরকারের সহায়তার পাহাড়ের পাথুরে গা কেটে ত্রিশুল নদী ঘেষে নয়ন মনোহর এই রাস্তা তৈরী সম্পন্ন হয় ১৯৭৪ সালে। কাঠমন্ডু থেকে প্লেনে করেও পোখারা যাওয়া যায়, কিন্তু এয়ারপোর্টে প্লেনের সাইজ দেখে সমস্ত সাহস বাস্পের মত উবে গেল শুরুতেই। বাস গুলো আমাদের দুরপাল্লার বিলাসবহুল বাসের তুলনায় নস্যি কিন্তু দু পাশের চমৎকার পাহাড়ি পথের সোন্দর্যে তা ভুলে থাকা গেল। কাঠমন্ডু থেকে পোখারার পথে রয়েছে নেপালের কিছু গুরুত্বপুর্ন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। প্রায় আধাআধি যাওয়ার পর পথের ধারেই পড়ে মনোকামনা, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান, এটি সেন্ট্রাল নেপালের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। রাস্তার ধার থেকে কেবল কারে করে পৌছানো যায় পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়া থেকে মানাসলু আর অন্নপুর্না রেঞ্জের তুষার আচ্ছাদিত চূড়াগুলোর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। মনোকামনা থেকে আরেকটু পশ্চিমে পোখারার দিকে এগিয়ে সামান্য ডিট্যুর নিলেই পড়বে শাহ্ ডাইনাস্টির প্রাক্তন রাজধানী গোর্খা, এছাড়া আছে ছোট পার্বত্য শহর বান্দিপুর, নেওয়ারি কালচার আর স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। রোমাঞ্চপ্রিয়রা চাইলে অনেক নিচে গিরিখাদের মধ্যদিয়ে সগর্জনে বয়ে চলা ফেনিল ত্রিশুল নদীতে র্যাফটিং করতে পারেন। আমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু ট্রেকিং, কোথাও থামা হলোনা শুধু সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবারের বিরতি ছাড়া।
কাঠমন্ডু-পোখারা হাইওয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ত্রিশুল নদী
দুপুরের খাবারের জন্য এমনি একটি জায়গায় বিরতি
অন্নপুর্না ট্রেক ম্যাপ
অন্নপুর্না বেসক্যাম্প ট্রেকটি দুভাবে শেষ করা যায়। প্রচলিত পথটি হচ্ছে পোখারার অদুরে ফেদি নামক জায়গা থেকে শুরু করে মোটামুটি সরল রেখা ধরে ঝিনুডান্ডা, চমরং, দোবান, মাচাপুছরে বা ফিশটেইল বেসক্যাম্প হয়ে এবিসি এবং একই পথে নেমে আসা, আরেকটি রুট হচ্ছে ফেদি থেকে আরেকটু দূরে নয়াপোল নামক জায়গা থেকে শুরু করে কিছুটা সার্কুলার পথে টিকেধুংগা, ঘোড়েপানি, পুনে হিল, তাদাপানি হয়ে চমরং গিয়ে প্রচলিত পথ ধরে বেস ক্যাম্প। এতে আরো দুইদিন সময় বেশী লাগে। সময় বাচানোর জন্য ঠিক করলাম সোজা রুট ধরেই যাবো তাতে মোটামুটি দশ কি এগারো দিনে কাঠমন্ডু থেকে কাঠমন্ডু হয়ে যাবে।বাসে পরিচয় হলো ধ্বলাগিরি-অন্নপুর্না রিজিয়নের এক গাইডের সাথে। সে পরামর্শ দিলো দ্বিতীয় অর্থাৎ ঘুরপথের ট্রেইল ধরে যেতে তা না হলে এই ট্রেকের আসল সৌন্দর্য নাকি দেখা হবেনা। হোক না হয় একটু বেশী কষ্ট, দেখতেই যেহেতু এসেছি তাই রুট বদলে দ্বিতীয় পথেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিউডো লাক্সারী বাসের স্কিন টাইট সিটে বসে যখন প্রায় বিরক্ত হতে শুরু করেছি বাস তখনই পোখারা শহরে প্রবেশ করলো। বেলা তখন প্রায় দুপুর দুটো। আমাদের গাইড বল বাহাদুর ওরফে বিবি ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো আগে থেকেই, প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে হোটেলে পৌছানোর আগেই কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেললাম। অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেকটি অন্নপুর্না কনজার্ভেশন এরিয়া প্রজেক্টের (ACAP) অধীনে বিধায় প্রজেক্ট এরিয়ায় ঢুকতে ACAP পারমিট নিতে হয়, সেই সঙ্গে সকল ট্রেকার আর গাইডকে TIMS (Trekkers’ Informaiton Management System) কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। তারপর কোন গুরুতর বিপদে পড়লে ইমার্জেন্সী ইভ্যাকুয়েশনের জন্য ইন্সুরেন্স। এসব শেষ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে আসে।
সন্ধায় ফেওয়া লেক
হোটেলের ছাদ থেকে ফেওয়া লেক
সকালে হোটেলের ছাদ থেকে (আমার ট্রেক মেট)
হোটেলের নাম থার্ড পোল। দেখে পছন্দ হলো। লেকের একদম প্রান্তে, মুল রাস্তা থেকে প্রায় একশ মিটার ভিতরে, আশেপাশে ঝুট ঝামেলাহীন খোলামেলা জায়গায়। এক পাশে বিখ্যাত ফিশ টেইলের পিরামিড আকৃতির ঝকঝকে চূড়াকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে পাহাড় সারির শুরু, রাস্তা পার হয়ে সামনে ফেওয়া লেক, রুম লাগোয়া বারান্দা থেকে দৃষ্টি অবারিত চলে যায় পোখারা শহর ছুঁয়ে পাহাড়ের দিকে। বিছানায় শুয়েই সারাংকোট আর ফিশ টেইলের দুর্দান্ত ভিউকে বাড়তি পাওনা। হোটেলের ছাদ খানিও ভারি চমৎকার, পুরো পোখারার প্যানোরেমিক ভিউ পাওয়া যায়। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাষ্ট সহ ডাবল রুমের ভাড়া ২৫০০ রুপি। রিজনেবলই মনে হল।
চেক ইন করে, লাগেজ বহর রুমে ডাম্প করে রাতে আবার বিবি কে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম ট্রেকিংয়ের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র যেমন ওয়াকিং স্টিক, ডাউন জ্যাকেট, ডাউন স্লিপিং ব্যাগ, হেড ল্যাম্প আর ও কিছু টুকিটাকি জিনিষ ভাড়া করতে। হাজার তিনেক টাকার চকলেট বার, মিক্সড নাট, পাওয়ার বার, লজেন্স কেনা হলো পথে শক্তি যোগানোর জন্য। গাইড আর পোর্টার ঢাউস ব্যাগ দুটো বহন করবে আর আমরা দু’জন প্রত্যেকে চল্লিশ লিটারের ছোট ব্যাকপ্যাক বইবো যাতে নিত্য ব্যাবহার্য প্রয়োজনীয় জিনিষপাতি থাকবে। নিয়ম অনুযায়ী একজন পোর্টার সর্বোচ্চ বিশ কেজি বহন করবে এর বেশী নয়। ট্রেকের জন্য অপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র যেমন সাধারন জামাকাপড় আর ঢাকা থেকে বয়ে আনা বঙ্গের ঢাউস জ্যাকেট ইত্যাদি হোটেলের জিম্মায় রেখে ব্যাগ যতখানি সম্ভব হালকা করে নিলাম। সামনের দিনগুলোর সাধারন খাবারের কথা চিন্তা করে রাতে পাঞ্জাবী হোটেলে জম্পেশ ডিনার সেরে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিয়োজিত হলাম।
রুম থেকে তোলা ফিস টেইল চূড়া
ছাদ থেকে ফেওয়া লেক
রুমের বারান্দা থেকে দেখা
প্রস্তুতি সম্পন্ন
আগেই বলেছি পরিবর্তিত রুটে আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে নয়াপোল থেকে, পোখারা থেকে এক ঘন্টার কিছু বেশী সময়ের পথ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা শেষ করে হোটেলের একটি মাইক্রোবাসে করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম নয়াপোলের উদ্দেশ্যে। রৌদ্রজ্জল ঝলমলে দিন। চমৎকার নীল আকাশ, এক ফোঁটা মেঘের চিহ্ন নেই। নীলের পটভুমিতে ঝক ঝক করছে তুষারআচ্ছাদিত ফিশ টেইলের সূচালো চূড়া। সব ঠিক থাকলে এর বেসক্যাম্পেও একদিন থাকা হবে। পোখারা শহর পার হয়ে পাহাড়ি রাস্তায় পড়তেই এক সারিতে দৃশ্যমান হলো সুর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠা ফিশটেইল সহ অন্নপুর্না রেঞ্জের হিমচুলি, গঙ্গাপুর্না, অন্নপুর্না-৩, গ্লেসিয়ার ডোম সহ আর ও অনেক নাম না জানা চুড়া। অসাধারন সৌন্দর্য, এখানকার লোকজনকে রীতিমত ইর্ষা হলো। এই চমৎকার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। উচু নিচু পথে পাহাড়, সবুজ বনানী আর তুষারাচ্ছাদিত অন্নপুর্নার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় সোয়া একঘন্টা পর পৌছলাম আমাদের ট্রেকিংয়ের প্রারম্ভিক স্থান নয়াপোল। পৌছে দেখি আগে থেকেই নানা দেশের নানা বয়সের ট্রেকার, গাইড আর পোর্টারে গিজ গিজ করছে জায়গাটি। কোন কোন দল ইতিমধ্যেই যাত্রা শুরু করে দিয়েছে আবার কোন কোন দল শেষ মুহুর্তের গোছগাছ সেরে নিচ্ছে। বেশ উৎসব মুখর পরিবেশ। এখান থেকেই সব জিনিষপত্রের দাম বৃদ্ধি শুরু হল, যত উপরে তত বেশী দাম। এক লিটার পানির বোতলের দাম ইতিমধ্যেই ২০ রুপি থেকে বেড়ে ৫০ রুপিতে দাড়িয়েছে। চারিদিকের আনন্দঘন তামাশা দেখার জন্য কিছু সময় কাটিয়ে আমরা যে যার যার ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে ধীরলয়ে যাত্রা শুরু করলাম। শুরু হলো গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ।
নয়াপোল যাবার পথে
নয়াপোল
যাত্রা হল শুরু
প্রথমদিন গন্তব্য টিকেধুংগা, ১৪৯৫ মিটার উচ্চতায় সবুজে ছাওয়া উপত্যকার ঢালে ছোট একটি পাহাড়ী সেটেলমেন্ট। ছবির মতো কয়েকটি সুন্দর টি-হাউস রয়েছে এ পথে। সহযাত্রী হিসেবে আশে পাশে আছে আরো নানা দেশের ট্রেকার। দেখা মিললো কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, পোলান্ড, রুমানিয়া, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিন আফ্রিকা এমনকি লেবানন থেকে আসা ট্রেকারদের সাথে, টুকটাক পরিচয় ও হলো অনেকের সাথে। লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার যে ট্রেকারদের প্রায় চল্লিশ শতাংশ মেয়ে। টোকিও এবং ইয়োকোহামা থেকে আসা সত্তরোর্ধ জাপানী বৃদ্ধদের এক দলকেও পেয়েছি আমরা। ট্রেকিংয়ের প্রথম কয়েক ঘন্টা আমাদের মত সমুদ্র সমতলের মানুষদের জন্য বেশ কষ্টকর। ধীরে ধীরে অবশ্য সয়ে আসে। ছোট বড় পাথর ছড়ানো পাহাড়ী গ্রাম্য পথ, এক পাশে অন্নপুর্না সাউথ গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্ট খরস্রোতা মোদিখোলা নদী আর অন্য পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো পাহাড়, তার গায়ে ধাপ কেটে বানানো ফসলের ক্ষেত, বিক্ষিপ্ত ঘরবাড়ি আর পাইনের ঝাড়। পথে দু জায়গায় নাম নিবন্ধন করা হল এবং পারমিট চেক করা হলো। আস্তে আস্তে ভু-প্রকৃতি বদলাতে শুরু করলো। একে বেঁকে উপরে চলা ট্রেইলের এক পাশে পাথুরে পাহাড় উঠে গিয়েছে খাড়া আর আরেক পাশে সগর্জনে বয়ে চলছে মোদি খোলা। দূরে পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কেটে যবের চাষ করা হয়েছে, এখানকার প্রধান ফসল ও তাই। পাহাড়ের ঢালে ছবির মতো সুন্দর ছোট ছোট গ্রাম। যেতে যেতে ছবি তোলা হচ্ছে, সঙ্গে পানি আর ক্যান্ডি ব্রেক। প্রথম দিন, তাই চলার গতি কিছু ধীর।
পারমিট চেক করা হচ্ছে
ট্রেইল থেকে দেখা ফিস টেইল
এমন ঝুলন্ত ব্রিজ পার হতে হয় বেশ কটি
পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম
স্কুল
অবশেষে টিকেধুংগা
বিবির হিসেবে এদিন ৫ ঘন্টার হাটা কিন্তু আমার হিসেবে কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা। পুর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি পাহাড়িদের এস্টিমেটের সাথে সব সময় ৩০-৪০% বাফার যোগ করে রাখা ভালো। পথে নেপালী থালি দিয়ে লাঞ্চ। এটুকু খাবারের দাম ৩৫০+ রুপি, এক কাপ চা ৪০ রুপি। পথ কখনও সবুজ, কখনও রুক্ষ ধূসর আর ফাকে ফাকে চকিতে ফিসটেইলের উঁকি দেয়া। অবশেষে আমার ধারনা মত প্রায় ৭ ঘন্টা হেটে পৌছালাম আকাংখিত প্রথম গন্তব্য টিকেধুংগা। অনাভ্যাসের ধাক্কায় শরীর চরম ক্লান্ত। পাহাড়ের ঢালে বাড়তি একটু সমতল জায়গায় কংক্রিট, কাঠ আর টিনের আড়াইতলা বিল্ডিং নিয়ে এই টি হাউস। আমাদের জায়গা হলো বাথরুমের পাশের রুমটিতে। খুশিই হলাম। রাতের বেলায় এই ঠান্ডায় এত দূর ঠেঙ্গিয়ে টয়লেটে যেতে হবেনা। সন্ধ্যা সাতটায় ডিনার সেরে ৮ টার মধ্যে ঘুম। হিমালয়ের পাহাড়ী বসতিগুলোয় সন্ধে মানেই মাঝরাত। খাবারের দাম নাই বা বললাম। ডিনারে পরিচয় হলো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আগত এক দলের সাথে। পেশায় সবাই একাউটেন্ট। ট্রেকিং শেষে নিজেদের খরচ এবং শ্রমে একটি স্কুল বানানোর পরিকল্পনা আছে দলটির। চিত্ত বিনোদন হল, সাথে সাথে সামাজিক দায়িত্ব পালনও সম্পন্ন হল। কনসেপ্টটা ভালো লাগলো। পরিচয় হলো ভারতীয় বংশদ্ভুত দক্ষিন আফ্রিকার নাগরিক রাজন দার সাথে। কথা বার্তায় আর আঁচ ভীষন পলিশড্ এবং স্মার্ট রাজনদা পেশায় এমিরেটস্ এর পাইলট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমান এয়ারবাস A380 চালান ইউরোপ আর নর্থ আমেরিকান গন্তব্যে।
গুরুং আদিবাসী শিশু
নেপালী থালি (এই প্লেটের দাম পড়েছে প্রায় ৪০০ টাকা)
পরদিন ৬ ঘন্টার হাটা (আমার হিসেবে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা), গন্তব্য ঘোড়েপানি, পুরো ট্রেকের সবচেয়ে কঠিন দিন (পরে বুঝেছি)। একদিনে উঠতে হবে ১৩০০ মিটারের ও বেশি আর কিছু জায়গায় ট্রেইল একদমই খাড়া। সকালে পরিজ, দুধ, মধু দিয়ে নাস্তা শেষ করে লেমন টি খেয়ে শরীর চাঙ্গা করে রওনা হলাম ঘোড়েপানির উদ্দেশ্য। প্রথম গন্তব্য ৪০০ মিটার খাড়া উপরে উল্লেরী নামক একটি জায়গা। পথের দিকে তাকিয়ে মনটা দমে গেলো। একদম খাড়া পাথুরে এবড়োথেবড়ো ট্রেইল। হাজার হাজার পাথুরে ধাপ হাটুর কি রকম দফারফা করবে তা ভেবে উদ্বিগ্ন হলাম। প্রায় দু ঘন্টা লাগলো উল্লেরী পৌছতে। দু হাটু ততক্ষনে প্রায় অবশ। কিন্তু কষ্ট ভুলে গেলাম উল্লেরী থেকে অন্নপুর্না সাউথ আর হিমচুলির অসাধারান দৃশ্য দেখে। নিচে চারিদিকে সবুজে ছাওয়া পাহাড় সারি, তা ছাপিয়ে অন্নুপুর্না আর হিমচুলির তুষার শুভ্র চূড়া নীল সবুজের মাঝে দারুন সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে।
উল্লেরীর পথে
উল্লেরী থেকে অন্নপুর্না সাউথ ও হিমচুলি
উল্লেরীতে বিশ্রামের পর আবার পথচলা। গন্তব্য আরও আড়াইশো মিটার উচুতে বানথানটি। চলার গতি ধীর। টিকেধুংগা থেকে ঘোড়েপানি পর্যন্ত পুরো ট্রেইলের কোথাও সমতল হাটা নেই, শুধুই খাড়া উঠে যাওয়া। যখন বানথানটি পৌছলাম ততক্ষনে প্রায় দুপুর গড়িয়ে এসেছে। লাঞ্চ শেষ করে আবারো সেই একই কাজ, হাটা। গাইড বিবি যখন জানালো দিবসের শেষ যাত্রায় প্রায় ছ’শ মিটার উঠতে হবে, আমাদের দুজনেরই উদ্যম নষ্ট হয়ে যাবার মত অবস্থা। রিমোট এরিয়ায় যতই ঢুকছি জিনিসপত্রের দামও পৌনঃপুনিক হারে বেড়ে চলছে। এক লিটার পানির দাম ইতিমধ্যে ৮০ রুপিতে গিয়ে ঠেকেছে। ওক আর রডোড্রেনডন বনের ভিতর দিয়ে একে বেঁকে পথ উঠে গেছে। ভয় হচ্ছিলো সন্ধের আগে হয়তো পৌছতে পারবনা। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে নাংগেথানটি নামক জায়গায় চা বিরতি। অবশেষে যা ভয় করছিলাম তাই হলো, সন্ধা নেমে গেল খুব দ্রুতই, ঘোড়েপানি তখন ও প্রায় এক ঘন্টার পথ। ঠান্ডা বাড়ছে, পথ ভালো ঠাহর করা যাচ্ছেনা। মাথার হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে উঠতে থাকলাম। অবশেষে প্রায় ১২ ঘন্টা হেটে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌছে যখন ঘোড়েপানি পৌছলাম তখন সময় প্রায় সাতটা। এখানকার হিসেবে প্রায় মাঝরাত। গেষ্ট হাউসে নিজেদের রুমে মালপত্র রেখেই ডাইনিং রুমে ছুটলাম কয়লার রুম হিটারে গা গরম করার জন্য। ঠান্ডায় জমে একাকার। ভাত, ডাল, সবজি, পাপড় এর নেপালি থালি দিয়ে ডিনার শেষ করে এক গ্লাস হট চকলেট নিয়ে আয়েশ করে বসলাম উনুনের ধারে। দু হাতে গরম মগ ধরে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। পরদিন সকালে গন্তব্য প্রায় ৩২০০ মিটার উচ্চতায় পুনেহিল অবজারভেটরি টাওয়ার যেখান থেকে পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ ধ্বলাগিরি রেঞ্জের দুর্দান্ত প্যানোরামা দেখা যায়। (চলবে)
অন্নপুর্না সাউথ পিক (উল্লেরী থেকে ঘোড়েপানি যাবার পথে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:৫৬