ট্রেকিং এ সময়ের জনপ্রিয় ট্রেন্ড। কিন্তু আমি ও আমার কয়েকজন পাহাড় পাগল বন্ধু প্রায় এক যুগ আগেই ট্রেকিং শুরু করি। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময় আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছি, হ্যা গাড়িতে গিয়ে তারপর হেটে হেটে যাকে এখন সবাই ট্রেকিং বলে। পড়াশুনার পাট চুকিয়ে ২০০৫ এ চাকরিতে যোগদান করার বছরখানেক পর আর্থিক সামর্থ্য একটু বাড়লে হিমালয়ে ঘুরাঘুরি তথা সো কলড্ ট্রেকিংয়ের ভুত মাথায় সওয়ার হয়। গত আট দশ বছরে পদ্মা মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়েছে, আমার ও হিমালয়ে বেশ কটি হাই অলটিচ্যুড ট্রেকিং করা হয়েছে। এ গল্প ২০১২ তে অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেকিং নিয়ে। বিশ্বে ১৪টি আট হাজার মিটার বা তার বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট চূড়া আছে। অন্নপুর্না রিজিয়নের অন্নপুর্না-১ চুড়াটির উচ্চতা ৮০৯১ মিটার বা ২৬,৫৪৫ ফুট, উচ্চতার দিক থেকে দশম উচ্চতম পর্বত শিখর। এই অন্নপুর্নার দক্ষিন বেস ক্যাম্প বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেকিং রুট তার অনবদ্য সৌন্দর্যের কারনে। অন্নপুর্না রেঞ্জটি পোখারা অঞ্চলে। পোখারায় জনপ্রিয় ফিস টেইল বা মাচাপুছরে (মাছের লেজের সাথে সাদৃশ্যপুর্ন বলে) দেখে সবাই আপ্লুত হয় সেটিও এই অন্নপুর্না রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত।
আমি এবং আমার মত আরো পাহাড় বান্ধব দুই বন্ধু মোট তিনজন যাবার সিদ্ধান্ত নেই। যাবার দিনক্ষন ঠিক হয় নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ, কোরবানীর ঈদের ঠিক পরদিন। যাবার সিদ্ধান্ত হবার পর, এবার লজিষ্টিক প্রিপারেশন শুরু। বঙ্গবাজার আর নিউমার্কেট ঘুরে প্রয়োজনীয় গরম জ্যাকেট, থার্মাল ইনার, উইন্ডচিটার, কানটুপি, গ্লোভস্, ট্রাউজার ইত্যাদি সংগ্রহ করলাম। আমাদের দেশে ট্রেকিং উপযোগী পোষাক এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক উপকরন পাওয়া দুস্কর, দু চারটি দোকান যা আছে জিনিসপত্রের ভ্যারাইটি খুব অপ্রতুল এবং দামও সস্তা না। এখন অবশ্য অনেক কিছুই পাওয়া যায় তবে কোথায় খুজতে হবে তা জানা থাকলে। দরকার মত যা যা পাওয়া গেল কিনে ফেললাম, বাকি সব নেপাল থেকে ভাড়া করবো। জুতার জন্য ২০১০ এর দিকে কাঠমন্ডু থেকে কেনা এক জোড়া চাইনিজ মাউন্টেন বুটই ভরসা। ভালো এক জোড়া ট্রেকিং বুট যেমন নর্থ ফেস, কলাম্বিয়া, মামুট, মাউন্টেন হার্ডওয়্যার এসব ব্র্যান্ডের মেলা দাম, মিনিমাম দেড়শ ডলার কিন্তু এফোর্ড করতে পারলে কিনে ফেলাই ভালো। ওসব জায়গায় জুতো বিগড়ে গেলে বেশ বিপদ। উঠতি এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে বসে সম্ভাব্য সকল মেডিকেল ইমার্জেন্সী বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্রের তালিকা করলাম এবং সেইমতো ঔষুধপত্তর নেয়া হল। হিমালয়ের এই দুর্গম প্রান্তরে কোন জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হলে নিজেদের চিকিৎসা নিজেদেরই করতে হবে তাই এই বাড়তি সতর্কতা।
বাকি সব কাজ যেমন কাঠমন্ডু আর পোখারার হোটেল বুকিং, বাসের টিকেট, এয়ারপোর্ট ট্রান্সফারের সব আয়োজন সম্পন্ন করলাম এক নেপালী বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য। অক্টোবর-নভেম্বর পর্বতারোহনের ব্যাস্ত মৌসুম। এসময়ে ট্রেকার আর পর্বতারোহীদের ভীড় লেগে থাকে নেপালের জনপ্রিয় রুট সমূহে। ক্লায়েন্ট হিসেবে সাদা চামড়াদের চাহিদা তুঙ্গে, গাইড, পোর্টারদেরও প্রথম পছন্দ তারাই। আর অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেক পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেকিং ডেষ্টিনেশন। ঝামেলা এড়াতে তাই ঢাকার পরিচিত এক সিনিয়র ট্রেকারের সাহায্যে একজন গাইড আর একজন পোর্টার ১৫ দিনের জন্য বুকিং দিয়ে ফেললাম। গাইডের নাম বল বাহাদুর আর পোর্টারের নাম পাসাং শেরপা। এর মাঝে ওয়েবসাইটে নিয়মিত রুটের টেম্পারেচার ফলো করছি। ভয় পাচ্ছিলাম দেখে যে, সামনের দিনগুলোতে টেম্পারেচার ফোরকাষ্ট শুন্যের প্রায় ১২-১৪ ডিগ্রী নিচে দেখাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে যে সময়ে আমাদের বেস ক্যাম্পে পৌছার কথা সেসময়কার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল শুন্যের নিচে বারো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। আমার আবার অল্প ঠান্ডায় কাবু হয়ে যাবার বাতিক আছে, তাই আমি একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম।
সমস্ত মালসামান ৮৫ লিটারের ঢাউস আকারের বিটকেলে রংয়ের চায়না মেড ক্যামেল মাউন্টেন ব্র্যান্ডের মাউন্টেন ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে কোরবানীর ঈদের পরদিন রৌদ্রজ্জ্বল শীতের সকালে বিমান বন্দরের পথে রওনা হলাম। ঈদের পরদিন ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় বেশ তরিবত করে যাচ্ছিলাম কিন্তু বিধিবাম, যেতে যেতে পথিমধ্যে দুঃসংবাদ। এক বন্ধুর যাত্রা বাতিল, পরিবার যেতে দিবেনা। তার অভিমানী কন্ঠস্বর শুনে বুঝলাম ভালো ঝামেলা হয়েছে। কি আর করা, তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে দ্রুত এয়ারপোর্টে গিয়ে টিকেট ক্যানসেল করলাম, নো শো হবার আগেই। অন্তত সে টাকাটা ফেরত পাবে। আমরা বাকি দুইজন কিছুটা বিরস বদনে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭ এ চেপে কাঠমন্ডুর পথে রওনা হলাম।
৫০ মিনিটের ফ্লাইট দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে গেলো। আকাশ ভালো থাকায় কাঞ্চেনজঙ্ঘা, এভারেষ্ট, মানাসলু হয়ে ধ্বলাগিরি পর্যন্ত পুরো রেঞ্জ পরিস্কারভাবে দেখার সৌভগ্য হল। তবে তার জন্য যাওয়ার সময় বিমানের ডান দিকে আর ফেরার সময় বা দিকে বসতে হবে। আগে থেকেই জানা থাকায় চেক ইন করার সময় ওভাবেই সিট নিয়েছিলাম। চারিদিক পাহাড় ঘেরা ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট খুব ছোট আর প্রযুক্তিগত ভাবেও পিছিয়ে, তার তুলনায় আমাদেরটা মনে হবে অনেক আধুনিক আর বড়। এরাইভাল লাউঞ্জে একটি সাইনবোর্ড নজর কাড়লো ‘Things to do in Nepal takes time, so relax and chill out’। কথাটা সত্যি প্রমান করতেই, অন এরাইভাল ভিসা আর ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে হোটেলে পৌছতে পৌছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। যেহেতু এক রাতের ব্যাপার, পরদিনই পোখারার উদ্দেশ্যে রওনা হব তাই এজেন্টকে বলা ছিলো মোটামুটি সস্তা কোন হোটেল বুক করার জন্য। থামেলের গলি ঘুপচির মধ্যে যে হোটেলে উঠলাম তা একটু বেশিই সস্তা মনে হলো, সিঙ্গেল খাট গুলো স্কিন টাইট, বাথরুম ততোধিক স্কিন টাইট। কমোডে বসলে হাটু সামনের দেয়ালে ঠেকে যায়।
চেক ইন করে লট বহর রুমে রেখেই বের হলাম একটু ঘুরতে। ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। অন্যদের কেমন লাগে জানিনা কিন্তু থামেলের অলিগলির এই গোলকধাঁধা আমার বেশ লাগে। ফেলুদার যত কান্ড কাঠমন্ডুর কথা মনে পড়ে যায়। হরেক রকমের দোকানপাট, সাদা, কালো, পীত বর্ন, গোলাপী, ককেশিয়ান, মঙ্গোলয়েড, দ্রাবিড় ইত্যাদি নানা বর্ন আর জাতের মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত চারিদিক। রঙবেরঙের দোকানে নানা আকৃতির বর্নিল থাঙ্কা (সিল্কের কাপড়ে বিশেষ এক ধরনের নেপালি আর্ট যাতে ফুটিয়ে তোলা হয় বৌ্দ্ধ ধর্মের নানা নিদর্শন। এই আর্টের সৃষ্টি তিব্বতে আর নেপালে আগমন ঘটে রাজকন্যা ভ্রিকুটির মাধ্যমে), বিভিন্ন সাইজের নেপালি কুকরি (এক ধরনের বাকানো ছুরি, অত্যন্ত ধারালো), প্রেয়ার হুইল, বিচিত্র সব এন্টিকস্, ইয়াকের উলের গরম কাপড়ের পসরা, লোভনীয় বইয়ে ঠাসা ছোট ছোট দোকান আর পর্বতারোহনের হরেক রকমের ইকুইপমেন্টের দোকান সহ কি নেই। উইন্ডো শপার্দের রীতিমত স্বর্গরাজ্য বলা যায়। ঘুরে ঘুরে ট্রেকিংয়ের কিছু জিনিসপত্র কিনলাম। ভোরে পোখারার বাস, আর বাইরের ঠান্ডাটা ও তৃপ্তিদায়ক ঠেকছেনা। অতএব ট্রিপ এডভাইজার রেকমেন্ডেড এক ক্যাফেতে গরম গরম স্যুপ আর চাওমিন দিয়ে ডিনার সেরে ঘোরাঘুরি পর্ব শেষ করে হোটেলে ফিরে দ্রুত ঘুম। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৬