প্রথমেই বলে রাখি এটি কোন মুভি রিভিউ না। মুভি দেখে রিভিউ কিভাবে লিখতে হয় আমি জানিনা। পর্বতারোহনের প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা, আর তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম থ্রিমাত্রিক পর্দায় এভারেষ্ট ছবিটি দেখার। এই লেখা মূলত মুভিটি দেখার পর এ নিয়ে আমার কিছু এলোমেলো ভাবনা, বিভিন্ন সময়ে ছিয়ানব্বইয়ের ঘটনার উপর পড়া বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের এক জগাখিচুরি মিশেল। এই লেখায় এভারেষ্ট ছবির রানিং কমেন্ট্রির পাশাপাশি ছিয়ানব্বইয়ের এভারেষ্ট দুর্ঘটনার খন্ড খন্ড সত্য কাহিনী তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এই সমস্ত তথ্যই আমার সংগ্রহে থাকা চারটি বই থেকে নেয়া- ছিয়ানব্বইয়ের সারভাইভার বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার জার্নালিষ্ট জন ক্রাকাউ (যিনি ইন টু দ্যা ওয়াইল্ডের ও লেখক) এর ইন টু দ্যা থিন এয়ার, প্রথম আমেরিকান হিসেবে চৌদ্দটি আটহাজারি মিটার শৃঙ্গ জয় করা পর্বতারোহী এড ভিশ্চার্সের নো শর্টকাট টু দ্যা টপ, বিখ্যাত আমেরিকান ডিরেক্টর, ক্লাইম্বার, অ্যাডভেঞ্চারিষ্ট ডেভিড ব্রেশার্সের হাই এক্সপোজার- অ্যান এনডিউরিং প্যাশন ফর এভারেষ্ট এবং কিংবদন্তি কাজাখ পর্বতারোহী আনাতলি বুকিরেভের দ্যা ক্লাইম্ব।
১৯৯৬ সালের এভারেষ্ট দুর্ঘটনা মাউন্টেনিয়ারিং এর ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। ১৯৯৬ সালে পুরো সিজন ধরে মোট ১২ জন পর্বতারোহী এভারেষ্টে মৃত্যুবরন করেন যা ২০১৪ এর আগ পর্যন্ত একক বছরে সর্বোচ্চ।১৯৯৬ সালের এই ঘটনার পরেই এভারেষ্ট এক্সপিডিশনের অতি বানিজ্যিকরন এবং তার সাথে সম্পৃক্ত ঝুঁকির ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচকরা বলেন টাকার বিনিময়ে গাইডেড এক্সপিডিশনে এভারেষ্টে যাওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবনতা এভারেষ্টে মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভারেষ্টে সামিটে পৌছার ব্যাপারে একটি থাম্ব রুল আছে তা হলো দুপুর দুইটার মধ্যে সামিট করতে না পারলে সেটাকে নো গো হিসেবে ধরে নেয়া হয় এবং ফিরে আসাটাই সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করা হয় এমনকি আপনি যদি চূড়া থেকে মাত্র শ’খানেক ফুট দূরে থাকেন তা হলেও। কেননা মাউন্টেন থেকে যাবে আরো হাজার হাজার বছর কিন্তু একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনে আপনি হয়তো চলে যাবেন না ফেরার দেশে। এই উচ্চতায় সামান্য সময়ের হিসেব নিকেশ জীবন মৃত্যুর মাঝে ব্যাবধান গড়ে দেয়। দেখা গেছে দুপুরের পর থেকেই সাধারনত আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে এবং ঘন মেঘে চূড়া ঢেকে যেতে থাকে যা নিচে নেমে যাওয়াকে অধিকতর কঠিন করে তুলে। এছাড়া যারা অক্সিজেন নিয়ে সামিট করেন (গুটি কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই) তারা মোটামুটি ১৮ ঘন্টার সম পরিমান অক্সিজেন বহন করেন যা ক্যাম্প-৪ থেকে চুড়ায় পৌছে আবার ক্যাম্প-৪ এ ফিরে আসা পর্যন্ত সাপোর্ট দিতে পারে। সে হিসেবে দুপুর দুইটা হলো শেষ সীমা। এরপর বৈরী আবহাওয়ার কারনে নেমে আসা ধীর গতি হয়ে যেতে পারে, পথ নির্দেশনা হারিয়ে যেতে পারে এবং অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়ে পর্বতারোহীরা ডেথ জোনে ইডিমায় আক্রান্ত হতে পারে বা অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ না করায় কনফিউশন ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে যা পরিশেষে মৃত্যু ডেকে আনে।
ছিয়ানব্বইয়ের ১০ই মে’র ঘটনায় সাউথ কোল দিয়ে সামিটে পৌছার প্রচেষ্টায় একদিনেই মৃত্যুবরন করে আটজন পর্বতারোহী। তখনকার এই ঘটনা আজও পর্বতারোহীদের মাঝে আলোচনার বিষয়। সেদিন ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আমেরিকার পর্বতারোহী স্কট ফিশার ও তার প্রতিষ্ঠান মাউন্টেন ম্যাডনেসের আটজন ক্লায়েন্ট সহ ১৯ জন পর্বতারোহী, নিউজিল্যান্ডের রব হল ও তার প্রতিষ্ঠান অ্যাডভেঞ্চার কনসালটেন্টের আটজন ক্লায়েন্টসহ ১৯ জন পর্বতারোহী এবং তাইওয়ানিজ দলের প্রায় ৬ জন পর্বতারোহী যারা ১০ মে রাত্রে ক্যাম্প-৪ থেকে এভারেষ্টের চুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে যাকে পর্বতারোহীরা বলে সামিট পুশ। এছাড়া অন্যান্য দল যারা সেদিন বিভিন্ন ক্যাম্পে উপস্থিত ছিল তারা হলো বিখ্যাত পরিচালক, পর্বতারোহী ডেভিড ব্রেশার্সের আইম্যাক্স দল যারা এভারেষ্টের উপর একটি ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য তখন ক্যাম্প-২ এ অবস্থান করছিল এবং পরবর্তীকালে উদ্ধার অভিযানে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে, ছিল দক্ষিন আমেরিকার একটি দল, আমেরিকার একটি দল সহ ব্রিটেন, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ডের একটি যৌথ দল। যাই হোক সেদিন মাউন্টেন ম্যাডনেস, অ্যাডভেঞ্চার কনসালটেন্ট এবং তাইওয়ানিজ এই তিনদলের দুই দলনেতা সহ মোট আটজনের মৃত্যুর মূল কারন হলো একসাথে একই সময়ে অনেক জনের সামিট পুশ, কয়েকজনের ধীরগতিতে আরোহন, হিলারি ষ্টেপে সময়ক্ষেপন, রব হলের তার ক্লায়েন্ট ডগ হ্যানসেনের জন্য চুড়ায় বিকেল চারটা পর্যন্ত রয়ে যাওয়া যা বিচারবুদ্ধিহীনতার চুড়ান্ত নিদর্শন, স্কট ফিশারে তার দলের সবাইকে সামিট করানোর জন্য দুপুর ২টার ডেডলাইন ভঙ্গ করে চুড়ায় থেকে যাওয়া এবং নিজের অসুস্থতাকে আমল না দেয়া, ফেরার পথে সবার ঘন্টায় প্রায় একশ মাইলেরও অধিক গতির তুষার ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে দ্বিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়া, তীব্র ঝড়ের কারনে যথাসময়ে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হয়ে পড়া এবং ডেথ জোনে অনেকের অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়ে বিপদে পড়া- এসবের সম্মিলন। তৎকালীন তারকা গাইড কাম পর্বতারোহী আমেরিকান স্কট ফিশার, আরেক তারকা গাইড এবং পর্বতারোহী এডমুন্ড হিলারির দেশ তথা নিউজিল্যান্ডের রব হল, সেভেন সামিটের শেষ সামিট প্রত্যাশী জাপানিজ নারী পর্বতারোহী ইয়াসুকো নামবা, আমেরিকান ডগ হ্যানসেন ও অ্যান্ডি হ্যারিস সহ মোট আটজন মৃত্যুবরন করে।
এভারেষ্ট ছবিটিতে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রব হল এবং তার দলের প্রতি সম্ভবত এই কারনে যে প্রথমত রবের দলের সবচেয়ে বেশী লোক মারা যায় এই ঘটনায়, দ্বিতীয়ত রব সাউথ সামিটে আটাশ হাজার ফুট উচুতে প্রায় ৩৬ ঘন্টা জীবিত ছিল এবং ওয়াকিটকিতে ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কিন্তু তাকে উদ্ধারের সকল প্রচেষ্টা একে একে ব্যার্থ হয়। একেবারে অন্তিম সময়ে রব স্যাটেলাইট ফোনে নিউজিল্যান্ডে তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে বিদায় জানায় যা সেই পরিস্থিতেতে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। সুতরাং সিনেমায় দর্শকদের জোড়ালো ইমোশনাল ট্রিটমেন্ট দেয়ার একটি আদর্শ উপাদান। আরেকটি কারন সম্ভবত হলো রবের ক্লায়েন্ট বেক ওয়েদারের অলৌকিক ভাবে বেঁচে ফিরে আসা। বেককে মৃত ভেবে শেরপারাও ফেলে রেখে যায়। কিন্তু স্নো ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত, গ্লাভস্ বিহীন দু হাত চরমভাবে ফ্রষ্টবাইটেড বেক পরদিন কিভাবে ক্যাম্প-৪ এ এসে হাজির হয় তা আজও এক রহস্য। শুধু বেক ওয়েদারকে নিয়েই ডকুমেন্টারি হয়েছে আলাদা করে। তার ফিরে আসাটা ইতিহাসের অন্যতম সেরা হাই অলটিচ্যুড সারভাইভালের অন্যতম।
সিনেমা হলে একটু দেরি করে ঢোকার কারনে প্রথম পাঁচ সাত মিনিট দেখতে পারিনি। শুরুতেই দেখা যায় রব হল তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর কাছে থেকে বিদায় নিচ্ছে। স্ত্রীর চরিত্রে কিরা নাইটলি খুব আবেগঘন অভিনয় করেছেন, বিশেষ করে মৃত্যুর আগে রবের সাথে শেষ কথোপকথনে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার ক্লোজআপ শট খুব বাস্তব মনে হয়েছে যা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আর রবের চরিত্রে জ্যাসন ক্লার্ক মানানসই অভিনয় করেছেন। একজন অভিজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্ববান এবং ক্লায়েন্ট অন্তপ্রান গাইডের চরিত্রে তিনি উৎরে গেছেন। কাহিনী এগিয়ে যায় দ্রুতলয়ে- অ্যাডভেঞ্চার কনসালটেন্ট দলের কাঠমন্ডুতে আগমন, হোটেলে চেক ইন করে রব হলের সবাইকে ওরিয়েন্টেশন স্পিচ দেয়া অতঃপর হেলিকপ্টারে করে লুকলা পৌছানো, সেখান থেকে ট্রেকিং করে বেসক্যাম্পে। বেসক্যাম্পে রব হল দেখা পায় বন্ধু এবং একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী স্কট ফিশারের (জ্যাক গিলেনহাল)। বাস্তবে স্কট ফিশার পোড় খাওয়া সুদর্শন এবং দৃঢ়চেতা এক পর্বতারোহী। জ্যাক গিলেনহাল সুদর্শন কোন সন্দেহ নেই কিন্তু ঠিক পোড় খাওয়া মনে হয়নি। আর বেসক্যাম্পে বেশ কয়েকবার তাকে মদের বোতল হাতে নিয়ে দেখা গেছে এবং সারকাষ্টিক চরিত্রের মানুষ হিসেবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে যা বাস্তবের স্কট ফিশার অন্তত আমি বিভিন্ন বই পড়ে স্কট ফিশারের যে রকম চিত্র পেয়েছি তার সাথে সাদৃশ্যপুর্ন নয়। একজন বিখ্যাত গাইড একদল ক্লায়েন্ট নিয়ে এভারেষ্ট চড়তে এসে বেসক্যাম্পে বসে মদ্যপান করছে ব্যাপারটা প্রফেশনাল গাইডের জন্য মানানসই ও বাস্তবসম্মত হয়নি।
যা হোক কিছু সময় বেসক্যাম্পের গতানুগতিক জীবন দেখানো হয়। বিভিন্ন দলের টিম মিটিং, রোপ ফিক্সিং নিয়ে আলোচনা, কে কবে সামিট পুশ করবে তা নিয়ে বাদানুবাদ, পরিবারের সাথে স্যাট ফোনে যোগাযোগ, বিভিন্ন জনের আত্মমগ্নতা এই সব। এই অংশটি কিছুটা ঝুলে যাওয়া মনে হয়েছে, অবশ্য ঝুলে যাওয়া বললে একটু বেশী বলা হবে, বরং বলা যায় একটু কম গতিশীল মনে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে ও বেসক্যাম্পের জীবন তেমন নাটকীয় হয়না অবশ্য ২০১৪ সালের খুম্বু আইসফলের অ্যাভালাঞ্চ আর ২০১৫ এর প্রলয়ংকরী ভুমিকম্প পরবর্তী অ্যাভালাঞ্চের কথা বাদ দিলে। বেসক্যাম্প থেকে পর্বতারোহীরা সাধারনত বারবার এক্লামাটাইজেশন ক্লাইম্বিং, রোপ ফিক্সিং, হাই ক্যাম্প তৈরী, সেখানে রসদ পৌঁছানো ইত্যাদি কাজ করে থাকে। এসব কিছু অল্প সময়ের মধ্যে দেখানো হয়েছে। এই অংশে কিছুটা নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হয়েছে বিপদজনক খুম্বু আইসফলে ক্র্যাভার্স পার হতে গিয়ে বরফ ধ্বসে মই নড়বড়ে হয়ে বেক ওয়েদারের খাদে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার দৃশ্যে। যা হোক সময় সময় স্কট ফিশার এবং তার দলের পর্বতারোহীদের ও উপস্থাপন করা হয় যদিও স্কট ফিশার চরিত্রটি আরেকটু মনোযোগের দাবী রাখতে পারতো।
এক্লামাটাইজেশনের পর চুড়ান্ত আরোহনের দৃশ্যে সামিট দলকে ক্যাম্প-২ এবং ক্যাম্প-৩ এ দেখা যায়। লোৎসে ফেস ধরে উঠার দৃশ্যটি আরো লম্বা সময় ধরে দেখানো যেতে পারতো কেননা ফিক্সড রোপ ধরে লোহার মত জমাট ব্লু আইসের বিশাল লোৎসে ফেস ধরে উঠার দৃশ্যটি খুবই নান্দনিক হত। এখানেও একটু মেলোড্রামা তৈরী করা হয়েছে বরফ ধ্বসে দুজনের ছিটিকে যাওয়া এবং সেলফ্ অ্যারেষ্ট করে আত্মরক্ষা। বরফের টুকরো ছিটকে আসার দৃশ্যে আমি নিজেই নিজের অজান্তে মাথা সরিয়ে নিয়েছি, মনে হচ্ছিল যেন আমার মাথায় আঘাত করতে যাচ্ছে। থ্রিডির এই মজা। অতঃপর চুড়ান্ত আরোহনের জন্য ক্যাম্প-৪ আশ্রয়, প্রবল বাতাসে ভালো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা, বেস ক্যাম্পের সাথে আবহাওয়া সংক্রান্ত খবর আদান-প্রদান। ১০ মে রাতে ভালো আবহাওয়া পাওয়া গেলে সামিট পুশের জন্য যাত্রা করে তিন দল। পথিমধ্যে বেক ওয়েদার থেমে পড়ে, স্নো ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত হয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হয়ে আসে। রব হল তাঁকে সেখানেই থাকতে বলে এবং প্রথম ফিরতি দলের সাথে নেমে আসতে বলে। বাস্তবে যা ঘটেছিল ঠিক তেমনি জাপানিজ ইয়াসুকা নামবার অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়ে কিন্তু তবুও সেভেন সামিটের শেষ অর্জন সে বিসর্জন দিতে রাজি হয়না। পুরো সামিট দলের হিলারি ষ্টেপে ফিক্সড রোপ না থাকায় বেশ কিছুটা অমুল্য সময় নষ্ট হয় যা জীবন মৃত্যুর মাঝে ব্যাবধান গড়ে দেয়। স্কটের ডেপুটি গাইড কিংবদন্তি কাজাখ পর্বতারোহী আনাতলি বুকারেভ বীর বিক্রমে দুপুর একটায় সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ছাড়াই সামিট করে এবং নেমে আসার সময় ক্লায়েন্টকে সঙ্গ না দিয়ে একাই সাউথ কোলে নেমে আসতে থাকে। মার্কিন ডাকবিভাগের কর্মকর্তা ডগ হ্যানসেন ধুকতে ধুকতে উঠতে থাকে, পিছপা হতে রাজি নয়। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বেক ওয়েদার সাউথ সামিটের আগে একই জায়গায় বসে থাকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। এই অংশে ছোট ছোট লং ও ক্লোজ শটে অনেকরই নিজের সাথে, বৈরী পরিবেশের সাথে ব্যাক্তিগত লড়াই দেখানো হয়।
রব হল এবং স্কট ফিশার দুজনেই সামিট করে কিন্তু বেশ দেরীতে। স্কটের অবস্থা ইতিমধ্যে আরো খারাপ হয়। রব নেমে আসতে থাকে কিন্তু সাউথ সামিটের কাছে ডগ হ্যানসেনকে পায়। বাস্তবে ডগ তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে রবের সাথে চুড়ার মাত্র তিনশত ফুট আগে থেকে ফিরে এসেছিল বৈরী আবহাওয়ার কারনে। এবারও তার শারীরিক অবস্থা সুবিধের নয় তবু সে সামিটে পৌছতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রব তাকে বোঝায় যে সামিটের জন্য ইতিমধ্যে তারা অনেক দেরী করে ফেলেছে। ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু ডগ গোঁ ধরে থাকে। সে এবার চূড়া জয় করবেই। এই অংশটায় রব যেন কিছুটা অপরাধবোধে ভুগে। মধ্যবিত্ত ডগ সর্বস্ব ব্যয় করে এই অভিযানে এসেছে, এবার যদি চূড়া ছুঁতে না পারে তবে হয়তো আর কোনদিনই পারবেনা। রব একবার নির্নিমেষে কয়েকশ ফুট দূরে চুড়ার দিকে তাকায় তারপর ডগকে নিয়ে রওনা হয়। বিকেল প্রায় চারটার সময় রব হল ও ডগ হ্যানসেন চুড়ায় পৌছে। ডগের স্বপ্ন পুরন হয়। কিন্তু এত দেরীতে ডগকে চুড়ায় নিয়ে এসে রব মূলত নিজের এবং ডগের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে। উচ্চতা মানুষের উপর এমনই প্রভাব ফেলে। অভিজ্ঞ, বিবেচক এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম রব এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো যা কোন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী অন্তত সজ্ঞানে করবেনা। এই অংশে মূল ঘটনা থেকে কাহিনী কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। রব আসলে শুরু থেকেই ডগের সাথে ছিলো এবং ডগের সাথে একবারই সামিটে পৌছে বিকেল চারটায়। যা হোক যখন তারা নামা শুরু করলো সাউথ সামিট অতিক্রম করার আগেই হঠাৎ প্রবল তুষার ঝড় শুরু হয়। নেমে আসা পর্বতারোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ডগ হ্যানসেন সম্ভবত পালমোনারি ইডিমায় পুরো নেতিয়ে যায়। রবের পক্ষে ডগকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্যাম্প থেকে রবকে দ্রুত নেমে আসার তাগাদা দেয়া হয়। কিন্তু রব সাউথ সামিটের নিচে ডগকে ছেড়ে আসতে পারেনা, সাথে থেকে যায় এবং আরেকবার নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করে। ডগকে টেনে হিচড়ে সাউথ সামিট অতিক্রম করে ক্যাম্প-৪ এ নিয়ে আসার রবের সমস্ত চেষ্টা ব্যার্থ হয়। ডগ ফিক্সড রোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে এবং পর্বতের কাংশুং ফেসের বিপদজনক খোলা ঢালে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে যায়। রব ও অক্সিজেনের অভাবে নিস্তেজ হয়ে বসে পড়ে। রবের ওয়াকিটকি তখনও জীবিত। ক্যাম্প থেকে রবকে মোটিভেট করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার সমস্ত চেষ্টা ব্যার্থ হয়। সারা রাত রব আটাশ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রবল বাতাস আর ঠান্ডায় পড়ে থাকে কিন্তু টিকে থাকে। পরদিন রবকে উদ্ধার করার জন্য সর্বশেষ প্রচেষ্টা বৈরী আবহাওয়ার জন্য ব্যার্থ হয়। রবের জন্য আর কোন আশা থাকেনা। ক্যাম্প থেকে স্যাট ফোনে নিউজিল্যান্ডে রবের স্ত্রীকে ফোন করে রবের সাথে ওয়াকিটকির মাধ্যমে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয় শেষ বিদায়ের জন্য। হৃদয় ভেঙ্গে দেয়া এই দৃশ্যে জ্যাসন ক্লার্ক এবং কিরা নাইটলি দুজনেই অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
ওইদিকে স্কট ও নেতিয়ে পড়ে এবং তার শেরপা সঙ্গীকে নেমে যেতে বলে। এক সময় স্কট ও চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ে। আনাতলি পরদিন স্কটকে উদ্ধারের জন্য গিয়ে মৃত্ দেখতে পায় এবং স্কটের মৃতদেহ ব্যাকপ্যাক দিয়ে ঢেকে দেয়। বাকিরা ক্যাম্প-৪ এর উপরে কাংশুং ফেসের কাছে বরফ গাত্রে নেতিয়ে পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আনাতলি এই বৈরী আবহাওয়ায় প্রবল বিক্রমে আপন জীবন বিপন্ন করে তিনজনকে উদ্ধার করে। এই অংশটি আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে দেখানো যেত। এ বিষয়ে পরে বলবো। বেক ওয়েদার বরফে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এবং প্রায় কোমায় থাকা অবস্থায় সে তার পরিবারকে দেখতে পায়। এক অজানা শক্তি ভর করে তার উপর। অন্ধ, খোলা দু হাত প্রবল ফ্রষ্টবাইটে কালো ও রক্তাক্ত বেক ওয়েদার টলোমলো পায়ে ক্যাম্প-৪ এর দিকে রওনা দেয় এবং পরদিন বিকেলে ক্যাম্প-৪ এ এসে পৌছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ক্যাম্প-১ থেকে নেপালী এয়ারফোর্সের লেফট্যানান্ট কর্নেল মদন ছেত্রী হেলিকপ্টারে করে তাকে কাঠমন্ডু নিয়ে যায়। বাস্তবে এই এয়ার রেসকিউটি ও ইতিহাসের অন্যতম দুধর্ষ একটি রেসকিউ মিশন। ক্যাম্প-১ এর উচ্চতা হেলিকপ্টার এর সর্বোচ্চ উচ্চতার ও অধিক এবং ক্র্যাশের পুরো সম্ভাবনা ছিল। অসম সাহসী নেপালী পাইলট এর এই বীরত্ব ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। শেষ দৃশ্যে বেঁচে ফিরে আসা সবাইকে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে দেখা যায়। দু হাতের কবজি হারানো বেক মিলিত হয় তার স্ত্রীর সাথে। রবের স্ত্রী জেনকে জড়িয়ে ধরে হেলেন। এভাবেই ধীরে ধীরে যবনিকা ঘটে এই বিয়োগান্তক কাহিনীর।
কাহিনীতে যে ক’টি জিনিষ যোগ করা যেত তা হলো বাস্তবে আনাতলি বুকারিভকে এই ঘটনার পর বিরাট খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয় নিজে সামিট করে ক্লায়েন্টদের সঙ্গ না দিয়ে একা নেমে আসার কারনে যা গাইডেড ট্যুরের চুড়ান্ত রীতি বিরুদ্ধ। যদিও আনাতলি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে যে স্কট তাকে দ্রুত ক্যাম্প-৪ এ নেমে বাকিদের জন্য গরম পানি আর চায়ের বন্দোবস্ত করতে বলেছিলো। কিন্তু স্কট মৃত্যুবরন করায় এর সত্যতা আর যাচাই করার উপায় ছিলনা। জন ক্রাকাউ, এড ভিয়েশ্চার্স সহ অনেকেই নিজেদের বইতে আনাতলি কে চুড়ান্ত স্বার্থপর হিসেবে অভিহিত করলেও এই আনাতলিই সেই প্রবল ঝড়ো আবহাওয়ায় পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতায় ডেথ জোনে নিজ জীবনের ঝুকি নিয়ে তিনজনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে যা মাউন্টেনিয়ারিং এর ইতিহাসে অন্যতম সেরা হাই অলটিচ্যুড রেসকিউ হিসেবে স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর এই অবদানটি একটু বিশেষভাবে দেখানো যেত। সম্ভবত জাতিতে কাজাখ বলেই পশ্চিমা মিডিয়ার সুনজর সে পায়নি কোনদিন। সেদিন আইম্যাক্স টিমের ডেভিড ব্রেশার্স, এড ভিয়েশ্চার্স ও উদ্ধার কার্যে ব্যাপক ভুমিকা পালন করে যা মোটামুটি ইগনোর করা হয়েছে। এড ভিশ্চার্স তার দীর্ঘদিনের বন্ধু রব হলের সাথে ওয়াকিটকিতে কথা বলে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন কিন্তু দেখানো হয়েছে শুধু রবের পুরোন বন্ধু ও প্রাক্তন ডেপুটি গাই কটারকে। তেমনি আরেক মার্কিন তারকা পর্বতারোহী পিট ইথান্স ও নিজ সামিট অভিযান ত্যাগ করে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহন করেন। তার অবদানও কোথাও স্থান পায়নি। অবশ্য দু ঘন্টার সিনেমায় সব কিছু দেখানোর আশা করাও ঠিক না।
ছবির আবহ সঙ্গীত পরিস্থিতির সাথে সর্বতোভাবে মানানসই হয়নি এবং কিছু কিছু জায়গায় রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিকে কমপ্লিমেন্ট করতে পারেনি। লর্ড অব দ্যা রিংয়ের আবহ সংগীতকে যদি চমৎকার বলি, তাঁর সাথে তুলনা করলে একে নিতান্তই চলনসই বলা যায়। সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারন। প্যানোরামাগুলো দারুন এসেছে। হিমালয়ের শ্বাসরুদ্ধকার ল্যান্ডস্কেপ আর আইম্যাক্সের বড় ফরম্যাটের অবদান এতে অনেক। ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট কিছু কিছু জায়গায় অন্তত আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। স্কট, বেক ওয়েদার আর আনাতলির ক্যারেক্টার আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। জন ক্রাকাউয়ের ক্যারেক্টারও খুব খোলেনি। ওয়েষ্টার্ন কুম, লোৎসে ফেস আর সাউথ কোলের আরো বেশি থ্রিডি ফরম্যাটের প্যানোরামা দেখতে পারলে ভালো লাগতো।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবি করার অনেক সমস্যা। দর্শক আগে থেকেই সব কিছু সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত থাকে এবং নিজেদের মত প্রত্যাশা তৈরী করে রাখে। সেই প্রত্যাশাকে পুরন করে ছবিকে দর্শকপ্রিয় করা খুব সহজ কাজ নয়। ৯৬ সালের ১০ই মের এভারেষ্ট দুর্ঘটনার মূল উপজীব্য যদি হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে হাই অলটিচ্যুড ক্লাইম্বিং এর ঝুঁকি তুলে ধরা, সেদিনের সেই ঘটনাপ্রবাহের যথাসম্ভব বাস্তব সম্মত এবং দর্শকদের চিত্তকে নাড়া দেওয়ার মত করে উপস্থাপন করা যেন দর্শক হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে স্বজন হারানোর ব্যাথা, উপলব্ধি করে চরম দুর্যোগে অনিশ্চিত অবস্থায় মানসিক টানাপোড়েন আর মোটের উপর থ্রিডি ফরম্যাটে দর্শকদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া পৃথিবীর সবচে উচু স্থানের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের সাথে, তবে এভারেষ্ট মুভিটি আমার মতে অন্তত ৭০ ভাগ সফল। পর্বতের প্রতি প্রবল ভালোবাসার কারনে হয়তো আমি একটু বেশীই দিয়েছি। আমার ভালো লেগেছে এটাই বড় কথা। আর কিছু না হোক শুধু হিমালয় তথা এভারেষ্টের বুক কাঁপানো ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ত্রিমাত্রিক ফরম্যাটে দেখতে হলেও ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে যেতে পারেন। শুধু ল্যান্ডস্কেপ দেখেই চার পাঁচশ টাকা উসুল হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫