যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আহমেদ মূসা ‘যেমন দেখেছি ওয়ান-ইলেভেন’-এর নির্বাচিত অংশ অবলম্বনে ধারাবাহিক প্রতিবেদন-প্রথম পর্ব> ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার আগ্নেয়াস্ত্রের ঔরস এবং ফখরুদ্দিন আহমদ সরকারের জঠর থেকে ওয়ান ইলেভেন ‘ভূমিষ্ঠ’ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার গুলশানের বাসায় গেলাম পরিস্থিতি বোঝার জন্য। গিয়ে দেখি ড্রইংরুম ভর্তি মানুষ। মান্নান ভুঁইয়া এর-ওর কথায় মাথা নাড়ছেন, কখনও ডানে-বাঁয়ে, কখনও উপরে-নিচে। এক পাশে কালো চশমা পরা হারিস চৌধুরী। আমি বসার পর ডক্টর মঈন খান আমাকে প্রশ্ন করলেন, ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ভাষণ শুনে কি মনে হলো? ‘দেশ দুর্নীতিতে ভরে গেছে’- এ লাইনটি কেমন হয়ে গেল না?
আমি বললাম, ভাষণটি কলম-কালি দিয়ে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছে বেয়োনেট দিয়ে।
সায় দিলেন অন্যরা। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর সবাই উঠে গেলেন আস্তে আস্তে। হারিস চৌধুরীও। এরপর হারিস চৌধুরীকে বাংলাদেশে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি এখনও নিখোঁজ। ওয়ান ইলেভেনের সময় কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে একটি ক্ষুদ্র পদে আমার অবস্থান থাকলেও তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে প্রায়-সর্বক্ষণ থাকার সুবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আমি নীরব সাক্ষী। অনেক দিন ধরেই অনেকে আমাকে বলে আসছেন, সংস্কার প্রস্তাবের আদ্যোপান্ত অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন, বিভিন্ন জনের ভূমিকা প্রকাশ করেন না কেন। জবাব না দিয়ে আমি নিশ্চুপ থেকেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সব সময়ই নিশ্চুপ থাকব। কারণ, আমি দেখেছি, ওয়ান ইলেভেনের সময় যারা মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সেটা তারা অনেকটা করেছেন প্রাণের ভয়ে, সম্মানহানির ভয়ে, গ্রেপ্তারের ভয়ে। মানুষের অসহায় অবস্থা নিয়ে কাহিনী ফাঁদা বা তাদের দুর্বল জায়গায় আঘাত করা আমার সংস্কৃতি ও রুচি অনুমোদন করে না। আবার সমসাময়িক কালে বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিশ্বাস ও আস্থাভাজন হিসেবে অনেক ক্লাসিফায়েড তথ্যের সঙ্গেও আমাকে জড়িত থাকতে হয়েছে। নৈতিক কারণে সে-সবও প্রচার-প্রকাশ থেকে বিরত থাকবো। তবে এসবের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে, যেগুলো ইতিহাসের উপাদান হতে পারে। ভবিষ্যতের গবেষকদের গবেষণায় এসব কাজে আসতে পারে। কাজে আসতে পারে রাজনৈতিক কর্মীদেরও। সেই লক্ষ্যে নিয়েই আমার এই স্মৃতিচারণ।
মান্নান ভুঁইয়া জরুরি টেলিফোন পেয়ে ড্রইং রুম থেকে মোবাইল হাতে উঠে গেলেন ভেতরের দিকে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি তার জন্য। ফাঁক পেয়ে মান্নান ভুঁইয়ার ড্রাইভার জাহাঙ্গীর এসে আমাকে বললেন, স্যার, সেদিন যে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেটা হলেও আজ এই অবস্থা হতো না।
‘সেদিন’ মানে জানুয়ারির দুই বা তিন তারিখের ঘটনা। বিএনপি অফিসে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমি ও সাংবাদিক নেতা আবদুর রহমান খান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অনেক যুক্তিতর্কের পর আমরা তিনজনই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপির একটি আশু করণীয় সম্পর্কে একমত হলাম। ফর্মুলাটি হচ্ছে, বিএনপি ঘোষণা করে দিক, যেহেতু সব দলই নির্বাচন বর্জন করেছে, সেহেতু বিএনপিও নির্বাচনে যাবে না। এই পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যা ভাল হয় করবে। তাতে বিএনপির কোন দায়দায়িত্ব থাকবে না, কারণ বিএনপি তো আর সরকারে নেই। জটিল পরিস্থিতি থেকে বিএনপির বের হয়ে আসার এটাই হবে সম্মানজনক পন্থা। কিন্তু এই ফর্মুলা সর্বোচ্চ মহলে কিভাবে পৌঁছানো হবে। আমরা তো বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কেউ না। তখন গয়েশ্বর রায় ও আবদুর রহমান খান আমাকে বললেন, বিষয়টা মহাসচিবের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তুলে ধরতে। এর মানে আমি মহাসচিবকে বলব, তিনি ম্যাডামকে বলবেন। জরুরি কাজে মান্নান ভুঁইয়া তখন শিবপুর। বিকালে ফিরে হাওয়া ভবনে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা। আমি তার বাসায় গিয়ে বসে থাকলাম। বিকালে উনি ঢুকেই হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে হাওয়া ভবনে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ভাবছিলাম চা খাওয়ার সময় কথাটা তুলব। কিন্তু তিনি চা না খেয়েই গাড়িতে উঠলেন। আমি পাশে গিয়ে বসলাম। বাসা থেকে হাওয়া ভবন খুব বেশি দূরে নয়। আমি দ্রুত আমাদের ‘ফর্মূলা’ তুলে ধরলাম। মনে হলো সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। তার সহকারী শাহানশাহ শাহীনও সায় দিলেন। মান্নান ভুঁইয়া কিছু টেকনিক্যাল প্রশ্ন করলেন, আমি সাধ্যমতো জবাব দিলাম। বাকি দুজনের রেফারেন্সও দিলাম। অনুরোধ করলাম বিষয়টি ম্যাডামের কাছে তুলে ধরতে। উনি দ্রুত ম্যাডামের রুমে ঢুকে গেলেন। এই অফিসে আমার খুব একটা আসা হয়নি। আমার কর্মক্ষেত্র নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় অফিস ও মহাসচিবের বাসা। হাওয়া ভবন তখন ২২শে জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনপন্থিদের দখলে। এর মধ্যেই ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ অনেকে নির্বাচিত হয়ে বসে আছেন। অনেকেই এই নির্বাচনের বিপক্ষে হলেও মুখে তেমন প্রতিবাদ করেন নি। কারণ সর্বোচ্চ মহল ছিল নির্বাচনের পক্ষে। যাদের আগে কখনও হাওয়া ভবনে দেখা যায়নি তাদের কেউ কেউ নিয়মিত এক ধরনের ‘পাহারা’ দিতো, যাতে অন্যপক্ষ ম্যাডামের কাছে ঘেঁষতে না পারে। অবশ্য মহাসচিবের যাতায়াত ছিল অবাধ।
>>দ্বিতীয় পর্ব>>
ঘণ্টা খানেক পর ম্যাডামের কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন মান্নান ভুঁইয়া। বাইরে অপেক্ষারত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে গাড়িতে উঠলেন। আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম। কিছু বললেন না তিনি। শেষে জিজ্ঞেসই করে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ধমকে উঠলেন, রাখেন আপনেগো ফর্মুলা। ওইখানে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে তোড়জোর চলছে আর আপনারা বলছেন নির্বাচন বর্জন করতে।
তার কথায় তখন বুঝতে পারলাম না, আমাদের বক্তব্যটা তিনি ম্যাডামের কাছে তুলতে পেরেছিলেন কি না। আমরা সবাই চুপ করে রইলাম। একটু পর তিনি স্বগতোক্তি করলেন, আমি অবশ্য ম্যাডামকে বলে এসেছি, ম্যাডাম আপনি ২২ তারিখ পর্যন্ত যেতেই পারবেন না। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। একথা শুনে মনে হলো তিনি হয়তো আমাদের বক্তব্যটা তুলে ধরেছিলেন। তার স্বভাবের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, কথা পুরোটা শেষ করতেন না। বাকিটা ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হতো। আমাদের পুরো ঘটনার নীরব সাক্ষী ছিলেন শাহিন ও জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর সেটাই বলতে চাইছিলেন।
মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে তোড়জোর ভালভাবেই চলছিল। ওয়ান ইলেভেনের আগের দিন আমি বিএনপির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাড়িতে গিয়েছিলাম দলের কাজে। কথায় কথায় সেই নেতা আমার কাছে জানতে চাইলেন, এবার তথ্যমন্ত্রী কাকে করা হলে ভাল হবে। আমি বিএনপির তথ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলেই হয়তো ভদ্রতাসূচক জিজ্ঞাসা। সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। আমি বললাম, একটু চিন্তা করে জানাবো। তারপর বললাম, মন্ত্রিসভার চিন্তা করছেন, আমার তো মনে হয় মার্শাল ল’ হয়ে যাবে। তারা আমার কথা কানে তুললেন না। প্রায়-মার্শাল ল’ হওয়ার দিন-তিনেক পর তাদের সঙ্গে আবার দেখা হলে দুজন চেপে ধরলেন আমাকে, সেদিন আপনি কি করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আপনি কি আগে থেকেই কিছু জানতেন? আমি জবাব দিলাম, না, জানতাম না। স্রেফ ইন্টুয়েশন থেকে বলছি। আমার সিক্সথ সেন্স প্রবল।’
একটি দল লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেও আসলে কিভাবে হেরে যায়, বাংলাদেশে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৯৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। এর পরও বিএনপি ২০০৭ সালে আবার আরেকটা একতরফা নির্বাচনের দিকে গেল। আর আওয়ামী লীগের সামনে দুটো উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি মহা-একতরফা নির্বাচন করল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া হলো না।
ওয়ান ইলেভেনের পরপরই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলো। কাউকে বাসা থেকে তুলে নেয়া হলো, কাউকে খবর দেয়া হলো ডিজিএফআই অফিসে যোগাযোগের জন্য। গেলেই গ্রেপ্তার করে জেলে। অনেককে ফোন করা হতো গভীর রাতে। যেতে ইতস্তত করলে বলা হতো, আপনার অসুবিধা থাকলে আমরা বরং আর্মির গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি...। তখন হুড়মুড় করে চলে যেতেন সবাই। এতে জান কিছুটা ঝুঁকিতে পড়লেও মানটা বেঁচে যেত। মন্দের ভাল। এভাবে খবর দেয়া হলো মোসাদ্দেক আলী ফালুকে যাওয়ার জন্য। তিনি যাওয়ার আগে দেখা হলো তার সঙ্গে। এমরান সালেহ প্রিন্স কিছু একটা বলতে গেলে প্রায় ধমক দিয়ে তিনি বললেন, প্রিন্স বেশি বুঝতে যেও না। বেশি বুঝতে গেলে কি হয় দেখছো না? চুপ করে গেলেন প্রিন্স। ফালু সাহেব সবার সঙ্গে বিদায়ী করমর্দন করে হাত বাড়ালেন মান্নান ভুঁইয়ার দিকে। মান্নান ভুঁইয়া ম্লান কণ্ঠে বললেন, ‘উইস ইউর গুডলাক’। সবাই হেসে উঠলেন। যদিও ব্যাপারটা ছিল করুণ। দেখা করার পর তাকেও যথারীতি জেলে পাঠানো হলো। শুনেছি তার ওপর অনেক ধকল গেছে।
>>তৃতীয় পর্ব>>
দুর্নীতির জন্য হোক বা অন্য যে কারণেই হোক বাংলাদেশের বহু রথী-মহারথীকে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা জেলে ছিলেন, তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে শাপে-বর হলো। পরবর্তীকালে তারা চিহ্নিত হলো ‘সংগ্রামী’ বলে। যারা পালিয়ে গেলেন তারাও ‘বীরের মর্যাদা’ পেলেন পরে। সমস্যায় পড়লেন তারা, যারা জেলে যাননি এবং পালাননি। যাদের জেলে নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ বা অপরাধী ছিলেন না এমন নয়, তবে অনেক ঠুনকো অভিযোগেও জেলে যেতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু একথা সত্য যে, মন্দের ভাল যারা তাদের বড় অংশ খপ্পরে পড়েন বন্দুক-তাড়িত সংস্কারের। একটি ক্ষুদ্র অংশ জেল ও সংস্কারের বাইরে থেকে সনাতনপন্থি বিএনপির পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের অনেককেও এজন্য জেল খাটতে হয়েছে। অবশ্য তারাও দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ান ইলেভেন গংয়ের দ্বিধাবিভক্ত একটি গ্রুপেরই ইশারা পেয়ে। দুর্নীতির জন্য হোক বা অন্য যে কারণেই হোক বাংলাদেশের বহু রথী-মহারথীকে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা জেলে ছিলেন, তাদের জন্য রাজনৈতিক ভাবে শাপে-বর হলো। পরবর্তীকালে তারা চিহ্নিত হলো ‘সংগ্রামী’ বলে। যারা পালিয়ে গেলেন তারাও ‘বীরের মর্যাদা’ পেলেন পরে। সমস্যায় পড়লেন তারা, যারা জেলে যাননি এবং পালাননি। যাদের জেলে নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ বা অপরাধী ছিলেন না এমন নয়, তবে অনেক ঠুনকো অভিযোগেও জেলে যেতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু একথা সত্য যে, মন্দের ভালো যারা তাদের বড় অংশ খপ্পরে পড়েন বন্দুক-তাড়িত সংস্কারের। একটি ক্ষুদ্র অংশ জেল ও সংস্কারের বাইরে থেকে সনাতনপন্থি বিএনপির পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের অনেককেও এ জন্য জেল খাটতে হয়েছে। অবশ্য তারাও দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ান ইলেভেন গং-এর দ্বিধাবিভক্ত একটি গ্রুপেরই ইশারা পেয়ে। ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা যাদের সংস্কারের টার্গেট করেছিলেন তাদের ভয়ভীতি দেখানোর সব কৌশলই প্রয়োগ করেন। একদিন দেখা গেল মান্নান ভুঁইয়া যে ভবনে থাকেন সেটি সেনাবাহিনী ঘেরাও করে সেই ভবনের এক ফ্ল্যাট থেকে তুচ্ছ এক রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করেছে। অনেকেই অনুমান করেন, এটি ছিল মান্নান ভুঁইয়াকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য। গভীর রাতে মান্নান ভুঁইয়াকে তুলে নিয়ে বিশেষ বাহিনীর গাড়িতে ঘুরিয়ে আবার নামিয়ে দেয়া হতো। এটা করা হয়েছে বস্তুত গাড়িতে বসে আলোচনার নাম করে, যদিও এসব আলোচনা ফোনেই করা যায়। তাছাড়া, ফোনে যারা আড়ি পাতেন, ঐসব গাড়ি তো তাদেরই। আমার ধারণা, এসব ঘটনায় মান্নান ভুঁইয়া ভয়ও পেয়েছিলেন। এমন অবস্থার মধ্যে একদিন সকালে তার বাসায় গিয়ে দেখি খুব চিন্তিত মুখে বসে আছেন। কথা শুরুর পর তিনি বললেন, আমাকে কিছু লোক খুব বিপদে ফেলেছে। আমাদের শতাধিক এক্স-এমপিকে ওয়ান ইলেভেন ওয়ালাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ফেরদৌস কোরাইশীর পিডিএফ পার্টিতে যোগ দিতে। কিন্তু তারা সবাই একই কথা বলে এসেছেন যে, ফেরদৌস কোরাইশীকে দিয়ে পার্টি হবে না, বরং মান্নান ভুঁইয়া ও আওয়ামী লীগের আবদুল জলিলকে সামনে রেখে কিছু করতে পারেন কিনা দেখেন। ডিজিএফআই এখন সে লাইনে এগুচ্ছে। ঘটনা সেভাবেই গড়াতে থাকে। মান্নান ভুঁইয়া কয়েকদিন ধরে তার কাছের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এ ধরনের আলোচনার সময় আমি সাধারণত চুপই থাকতাম।
>>চতুর্থ পর্ব>>
ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা দুই নেত্রীকে মাইনাস করার জন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকার পাশাপাশি দুই নেত্রীকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার জোর তৎপরতা শুরু করে। যখন এটা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, দুই নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে তখন মান্নান ভুঁইয়া সংস্কারের ব্যাপারে সিরিয়াস হন। সেই পর্বে তার তুলে ধরা যুক্তি ছিল, ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা যদি বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে না-ই দেয় বা বিদেশে পাঠিয়ে দেয় তা হলে বিএনপির নেতৃত্ব এমনিতেও তার ওপর এসে পড়ে। সুতরাং অবস্থান নিতে দোষ কোথায়। অর্থাৎ মান্নান ভূঁইয়া তার মৌলিক চিন্তাটাই শুরু করেন ‘খালেদা জিয়া দেশে থাকবেন না’ সেখান থেকে। তার মৌলিক জায়গাটি বা ভিত্তিটি যে যেকোন সময় নড়ে যেতে পারে সেটা তিনি হিসেবের মধ্যে রাখেন নি। মান্নান ভুঁইয়ার তুলে ধরা প্রস্তাবের একটি বাক্য ‘বিএনপির চেয়ারপারসন পদে দুই টার্মের বেশি কেউ থাকতে পারবে না’র সঙ্গে যোগ করা হয় ‘ইতিমধ্যে যিনি দুই টার্ম ছিলেন তিনিও থাকতে পারবেন না’- শেষের অংশটি নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক বিতর্ক হয়। এই বাক্য অনুযায়ী খালেদা জিয়া এমনিতেই বাদ পড়ে যান। সংস্কার প্রস্তাব যখন চূড়ান্ত করা হয় তখন শেষের বাক্যটি ছিল না। কিন্তু পরের দিন তিনি এই বাক্যটি যোগ করতে বলেন। খটকা লাগায় আমি তাকে বলি, ‘আপনি নিজেই বলছেন ম্যাডামকে ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা রাজনীতি করতে দেবে না, তাহলে এই বাক্যের দরকার কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, দরকার আছে, কারণ ওরা চাচ্ছে। ম্যাডামকে বাইরে পাঠাতে চাপ সৃষ্টির জন্য এই বাক্য ওরা দরকার মনে করছে। ‘ওরা’ কারা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। ২০০৭ সালের জুনে এই বাক্যসহ-ই উপস্থিত নেতাদের সবাইকে একটি করে কপি দিয়ে এবং পড়ে শুনিয়ে মান্নান ভুঁইয়া সাংবাদিকদের সামনে পাঠ করেন। কথা ছিল পাঠের সময় সব নেতাও উপস্থিত থাকবেন ড্রইং রুমে। কিন্তু প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার এতো বেশি সংখ্যক সাংবাদিক সেদিন উপস্থিত থাকায় অর্ধেক লোকেরও দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। বিশেষ করে টিভি ক্যামেরা স্থাপনের কোন জায়গাই ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত হলো, ভবনের নিচে গ্যারেজে মান্নান ভুঁইয়া সংস্কার প্রস্তাব পাঠ করবেন। অন্য নেতারা ড্রইং রুমেই থাকবেন, তবে সম্মেলনের আগেই অন্য নেতাদের ছবি তুলে নেয়া হবে। সে অনুযায়ী সাইফুর রহমানসহ বাকি সব নেতার ছবি তোলা হলো। মান্নান ভুঁইয়া তৈরি হলেন নিচে যাওয়ার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সব ধরনের ক্যামেরা এড়িয়ে চলতাম। সব সময় মান্নান ভুঁইয়া বা অন্য নেতাদের স্ক্রিপ্টটি ধরিয়ে দিয়ে পেছনে বা এক পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। এ ক্ষেত্রে আমার লজিক ছিল, আমার কাজ দলের প্রচার বাড়ানো, নিজের প্রচার নয়। বরং নিজের প্রচার বেশি করতে গেলে নানাজনের ঈর্ষার শিকার হতে হয়। তার চেয়ে লো-প্রোফাইলে থেকে কাজ করার সুবিধে বেশি। কিন্তু সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণার দিন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। নিচে নামার সময় সিঁড়িতে প্রচণ্ড চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কোন রকমে নিচে নেমে মান্নান ভুঁইয়া একটা চেয়ারে বসলেন। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কিতে তার ঘাড়ের ওপর যাতে কেউ এসে না পড়েন সে জন্য আড়াল দিয়ে রাখতে গিয়ে এগার বছরের মধ্যে বলতে গেলে এই প্রথম তার কাছাকাছি আমিও ফ্রেমবন্দি হয়ে পড়ি।
‘কেউ কেউ সংস্কারের পক্ষে বিপ্লবী কথাবার্তা বলেছিলেন’
তিনি সংস্কার প্রস্তাব পাঠ করে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এর আগে নেতাদের পাঠ করিয়ে শোনানোর সময় কোন নেতাই আলোচিত বাক্যটির প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু সংস্কার ব্যর্থ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ার পর কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, তিনি ঐ বাক্যটির পক্ষে ছিলেন না। বিএনপিতে নতুন করে ঠাঁই পাওয়ার জন্য তারা আরো অনেক কথাই বলতে থাকেন। এমন কি তারাও, অল্প কয়েক দিন আগেও যাদের কেউ কেউ সংস্কারের পক্ষে বিপ্লবী কথাবার্তা বলেছিলেন। সংস্কার প্রস্তাব একক কারো লেখা বা সম্পাদনা নয়। বেশ কিছু সময় ধরে অনেক আলোচনার পর এটি চূড়ান্ত হয়। মান্নান ভুঁইয়া আরেকটু সময় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কারের পক্ষে ওয়ান ইলেভেন ওয়ালাদের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ মান্নান ভুঁইয়ার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। তাদের একজন এমনকি আমাকেও বলেন যে, মান্নান ভুঁইয়া আরো দেরি করলে তাকে পে করতে হবে। অর্থাৎ, গ্রেপ্তার শুরু হয়ে যাবে। তাদের কারো নাম বলে এখন বিপদ ও বিতর্ক বাড়াতে চাই না। সেনাবাহিনী ও বিএনপির শীর্ষ মহলের সবই জানা। আলেচিত বাক্যটি নিয়ে প্রথম মান্নান ভুঁইয়ার কাছে এমন একজন প্রশ্ন তুলেছিলেন যার অবস্থান থেকে তা করার কথা নয়। তার নাম হাবিবুল আলম চৌধুরী ববি, ঢাকা মহানগর বিএনপির প্রচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। জবাবে মান্নান ভুঁইয়া ববিকেও একই যুক্তি দিয়েছিলেন। আমার জানা ও জ্ঞানমতে, ওয়ান ইলেভেন-সংস্কার মূলত ব্যর্থ করে দেন বেগম খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা দেশ থেকে বের হয়েই গিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকেও বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।
‘ছকমতো ঘটলে ম্যাডামকে প্রেসিডেন্ট করে নিয়ে আসবো’
তিনি বের হয়ে গেলে শেখ হাসিনাও আর দেশে ঢুকতে পারতেন না। খালেদা জিয়ার তৎকালীন বিজয়ের বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া টিকে যাচ্ছেন দেখে শেখ হাসিনা মরিয়া হয়ে দেশে ঢোকেন। না ঢুকতে পারলে তখনই শেখ হাসিনার রাজনীতির কবর হয়ে যেত। ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে দেশে টিকে যাওয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। তাকে জেলে যেতে হয়েছে। তারেক রহমানের ওপর নেমে এসেছে ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও নির্বাসন। আরাফাত রহমানও নিগৃহীত ও নির্বাসিত হন। পরিবারটি ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার নিকট-আত্মীয়দের অনেকেও নির্যাতন-হয়রানির শিকার হতে হয়েছেন। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। সে তুলনায় কিছুদিন জেলে থাকা ছাড়া শেখ হাসিনা বা তার পরিবারকে কোন বিপদে পড়তে হয়নি। এরপরও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো বিএনপির ওপর ভয়ঙ্কর ভাবে চড়াও হয়ে দলটিকে নির্মূল করতে চাইছে। রাজনীতির এই নির্দয়তা খুবই মর্মান্তিক। সংস্কার নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন মান্নান ভুঁইয়ার অতি নিকটের কেউ কেউ তার সঙ্গে যোগ দেননি। ওদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে কথাবার্তা বলতেন। তাদের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্ঠতা আগে থেকে। তখন তারা মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে একমত না হলেও ব্যক্তি মান্নান ভুঁইয়ার ওপর তাদের সম্মান-সহানুভূতি ছিল। তারা অনেক আক্ষেপ করতেন ফোনে। বেগম খালেদা জিয়াকে যখন দেশের বাইরে পাঠাবার আয়োজন শেষের দিকে, একদিন একা পেয়ে আমি মান্নান ভুঁইয়াকে বললাম, আপনার বহু প্রিয় মানুষ আপনার কাজ সমর্থন করছে না। আপনার ভূমিকা ইতিহাস কিভাবে দেখবে বলে আপনি মনে করেন। বিশেষ করে ম্যাডামের বিষয়ে আপনার এখনকার অবস্থান?
জবাবে অনেকক্ষণ চুপ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা সেদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন। জানি না, এ কথা তিনি আরো কাউকে বলেছিলেন কিনা। তিনি বলেছিলেন, সব কিছু আমার ছকমতো ঘটলে ম্যাডামকে আমরা প্রেসিডেন্ট করে বিদেশ থেকে নিয়ে আসবো। তার পরিবারও নিরাপদে থাকবে।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ওয়ান ইলেভেনওয়ালারা এটা মানবেন কেন?
তিনি বললেন, সেনাবাহিনীকে বলবো, এব্যাপারে জনগণের চাপ আছে। তাছাড়া, পরিস্থিতি তখন আমাদের অনুকূলে থাকবে। বিএনপির কিছু লোকের প্রতি আর্মির কারো কারো খেদ থাকলেও তারা বিএনপিকেই আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি সামনে রাখবে। সুতরাং আমরা তখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবো।
এ কথা তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে বলতে পেরেছিলেন কিনা জানতে পারিনি। তারেক রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কি কথা হয়েছিল প্রকাশ করেন নি। বেঁচে থাকলে হয়তো পরবর্তীকালে জানা যেত। আবদুল মান্নান ভুঁইয়া যতদিন বিএনপির মহাসচিব ছিলেন তার দলীয় লেখাজোখার কাজ আমি চালিয়ে গেছি। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে বিএনপির মহাসচিব করে যান আরেক অসাধারণ মেধাবী ও দৃঢ়চিত্তের খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে, যিনি ছিলেন আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠতমদের একজন।
‘এখনও সামনের কাতারে প্রাক্তন বামেরাই’
আজকাল বিএনপির কেউ কেউ বামপন্থিদের যতই গালাগালি করুক না কেন, বিএনপিকে সামনে রাখা বা পাতে তোলার মতো লোক বাম-ঘরানা ছাড়া এখনও তেমন নেই। এখনও সামনের কাতারে প্রাক্তন বামেরাই। এখনকার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও বাম-ঘরানার এবং মান্নান ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠতমদের একজন। আমি দলে থাকতে বলেছি এবং আগে-পরে বার বার লিখেছি যে, বিএনপি সৃষ্টি হয়েছিল আওয়ামী লীগ বহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, মওলানা ভাসানীর লোকদের হাতে। বিএনপির গঠনতন্ত্র শুরুই হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি দিয়ে। রণাঙ্গনের বহু উজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধা এই দলে ছিলেন। অন্যদিকে, জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে মওলানা ভাসানীর লোকেরাই বিএনপিকে মানুষের ঘরে ঘরে নিয়ে গেছেন। এমন কি মওলানা ভাসানীর ন্যাপের প্রতীক ধানের শীষও তুলে দেয়া হয়েছিল বিএনপির হাতে। এরাই বিএনপির মূলধারা। জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী ছাড়া অন্যদলের কিছু রাজাকার ও স্বাধীনতা-বিরোধী ব্যক্তি বিএনপিতে এলেও এরা সব সময়ই ছিল বিচ্ছিন্ন শক্তি। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নরাই জোটের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং তদজাতীয় কতিপয়ের সঙ্গে মিলে বিএনপিকে মূল জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হওয়ায় ওয়ান ইলেভেন-জাতীয় নানা সঙ্কটে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। সে সব বিতর্র্ক ভিন্ন। খোন্দকার দেলোয়ার মহাসচিব হওয়ার পর সংস্কারপন্থি অংশের বিএনপিতেও রদবদল ঘটিয়ে সাইফুর রহমানকে সভাপতি ও মেজর হাফিজকে মহাসচিব করা হয়। আমারও ফুরোয় মহাসচিবের হয়ে দলীয় লেখার কাজ। অবশ্য আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার জীবনী অনুলিখনের কাজ অব্যাহত রাখি তার মৃত্যু পর্যন্ত। পাশে থাকি বন্ধু ও সুহৃদ হয়ে। আমার অনুলেখন করা মান্নান ভুঁইয়ার দুইটি গ্রন্থ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
‘গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব প্রাধান্য পাওয়ায় মান্নান ভুঁইয়া সন্তুষ্ট ছিলেন না’
অনেকে আমাকে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে থাকেন, যে, আবদুল মান্নান ভুঁইয়া আসলে কি কি কারণে সংস্কারের সঙ্গে জড়িত হয়ে ছিলেন। আমার দেখা ও জানার ওপর ভিত্তি করে আমার ধারণাটা তুলে ধরতে পারি। বিএনপি-জামায়াত সখ্যতার প্রশ্নে, রক্ষণশীলদের প্রধান্য বৃদ্ধির কারণে, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর দলে ও সরকারে একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় এবং বিশেষ বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব প্রাধান্য পাওয়ায় মান্নান ভুঁইয়া সন্তুষ্ট ছিলেন না একথা ঠিক। দলে গণতন্ত্রের ঘাটতি ও পরিবারতন্ত্রের ঝোঁক তার পছন্দের ছিল না। এমন কি ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন বছরে নানা মতবিরোধের কারণে বার কয়েক পদত্যাগও করতে চেয়েছিলেন তিনি। বার-তিনেক তার পদত্যাগপত্র আমাকে দিয়ে লিখিয়েও ছিলেন। এসব ক্ষেত্রে হাতের লেখা ব্যবহারের পরামর্শ ছিল আমার। কারণ কম্পিউটারে কম্পোজ করতে গেলেও ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। প্রতিবারই লেখা শেষ করে বলেছি, আপনার নির্দেশ মতো লিখলাম, তবে আমার অনুরোধ, এটি জমা দেওয়ার আগে আরো ভাবুন। অবশ্য আমার অনুরোধে জমা দিতে বিরত ছিলেন ব্যাপারটা এমনও নয়। নানাবিধ কারণে জমা দেওয়া হয়ে উঠেনি। প্রথমবার যখন লিখলাম, আমার ‘অসাবধানতার কারণে’ ডেইলি স্টারে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূরুল কবীর সেটি ফাঁস করে দেন যে, মান্নান ভুঁইয়া পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর নানামুখী চাপে এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো, পদত্যাগের কথা ভুলে গিয়ে মান্নান ভুঁইয়াকে রিপোর্টের প্রতিবাদ করতে হলো। সেটিও আমিই লিখলাম। ছাপা হওয়ার পর পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়। সেদিন আমার অনুরোধে নূরুল কবীরের চেষ্টায় মাহফুজ আনাম তথা ডেইলি স্টার একটা ফেবার আমাদের করেছিল। প্রতিবাদপত্র প্রকাশের পাশাপাশি ডেইলি স্টারের ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘আমাদের প্রতিবেদনের বক্তব্যের ওপর আমরা স্থির আছি’- শব্দটি যোগ করা হয়নি। ডেইলি স্টারের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম ছাড়।
ডেইলি স্টারের রিপোর্টে সূত্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘মান্নান ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠ একজনের’। সেই ‘ঘনিষ্ঠ একজন’ আমি কি না, এটা মান্নান ভুঁইয়া আমার কাছে জানতে চাইলে জবাব না দিয়ে আমি চুপ করেছিলাম। তিনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। তবে অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র ব্যক্তিও বড় কাজ করে ফেলতে পারে। সেই পদত্যাগ-চিন্তার কারণ ছিল, বিএনপির উগ্রপন্থী অংশের নেতারা একটি কর্মসূচি পালনের সময় মাথায় কাফনের কাপড় পরার ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেলার পর মান্নান ভুঁইয়া এর প্রবল বিরোধিতা করেন। এ-নিয়ে অনেক বাদানুবাদ ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। দলে এমন আত্মঘাতী, হটকারী ও হাস্যকর চিন্তাও প্রশ্রয় পাওয়াতে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
দ্বিতীয়বার তাঁর পদত্যাগপত্র লিখে তাঁর হাতে তুলে দিয়ে গুলশানের বাসা থেকে সোজা চলে যাই সাদেক হোসেন খোকার গোপীবাগের বাসায়। গিয়ে দেখি সাদেক হোসেন খোকা, কৃষক দলের মুজিবুর রহমান, জিয়া শিশু-কিশোর সংগঠনের সেলিম সাহেব দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। সম্ভবত আবদুস সালামও ছিলেন। আমিও একটি থালা টেনে নিয়ে খেতে খেতে ঘটনা বললাম। সেটা তারা ঠেকিয়ে ছিলেন নানা ভাবে। এ ধরনের পদত্যাগ ঠেকাতে মাহবুব আলম তারাসহ আরো কয়েকজনও ভূমিকা রাখেন।
যা-ই হোক, সংস্কার প্রস্তাবের ঘটনার জন্য উল্লেখিত ব্যাপারগুলো মুখ্য কারণ ছিল না। আমার ধারণা, মূল কারণ ওয়ান ইলেভেন ওয়ালাদের প্রতি ভীতি, কাছের লোকদের গ্রেফতার থেকে রক্ষা এবং দলীয় এমপিদের ফেরদৌস কোরেশীর কিংস পার্টিতে যোগদান প্রতিহত করার প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে দল ও সরকারের শীর্ষতম পদে যাওয়ার ইচ্ছাও কিছুটা কাজ করতে পারে। কারণ, তিনি মানবোত্তর বা দেবদুর্লভ কিছু ছিলেন না, ছিলেন দোষে-গুণেরই মানুষ। অনেকের চেয়ে উন্নত ও সৎ হলেও শেষ পর্যন্ত মানুষইতো। তবে তিনি যে ভয় পেয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আবদুল জলিলকে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে স্বীকারোক্তি আদায়ের পর তিনি আরো ভীত হয়ে পড়েন। চিন্তা ভাবনায় তিনি বেসামরিক জীবনে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিপক্ষে হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকেও গিয়ে পড়তে হয়েছিল সেনাবাহিনীরই কবলে। এটাই তাঁর জীবনের বড় ট্রাজেডি। তার আরেক ট্রাজেডি হচ্ছে, তাঁর কোনো ভুলের জন্য ওয়ান-ইলেভেন আসেনি, অথচ তাকেই এর বড় শিকার হতে হয়েছে। এবং একই ভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপির মন্দের ভালো অংশ, সর্বোপরি বিএনপি নামক দলটি।
ফয়েজি-মার্কা বিচারক দিয়ে এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করিয়ে আগুনে ঘি ঢেলেছেন
বিচারপতির বয়স বাড়াতে আইন করে যারা পাল্লায় গুড় লাগিয়েছেন (যে গুড় খেতে প্রথমে আসে পিঁপড়ে, সেই পিঁপড়েকে খেতে আসে মাছি, সেই মাছিকে খেতে আসে টিকটিকি, সেই টিকটিকিকে খেতে আসে ব্যাঙ এবং সেই ব্যাঙকে খেতে আসে সাপ) সেই গুড়ের ব্যাপারীদের কোন শাস্তি-তিরস্কার হলো না। তিরস্কৃত হলেন না তারা যারা ফয়েজি-মার্কা বিচারক দিয়ে এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করিয়ে আগুনে ঘি ঢেলেছেন। যারা লুটপাট করে দুর্নাম কুড়িয়েছেন তাদের কিছুই বলা হলো না। যারা সেনাবাহিনীর খেদ ও বিরক্তি কুড়িয়েছেন তারা রইলেন সমালোচনার বাইরে। যারা বাংলাভাই-জঙ্গি কারখানা বসালেন তাদের দেয়া হলো বাহবা। যারা ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের জন্য ম্যাডামকে প্ররোচিত করে অবরুদ্ধ রেখেছেন তারা হয়ে রইলেন বিএনপির ‘ত্যাগী’ নেতা-পরামর্শদাতা। এদের কারণে ওয়ান ইলেভেন এসে বন্দুকের নলের মুখে যাদের পরাভূত করা হলো তারা হয়ে গেলেন ভিলেন এবং; এমনকি লুটপাটের জলজ্যান্ত নজির স্থাপনের জন্য যারা জেলে গেলেন, ফিরে এসে তারাও হয়ে গেলেন হিরো। আবার ওয়ান ইলেভেনের রথে চড়ে তারাই এলেন, যাদের বিএনপি সরকারই অনেককে জিঙিয়ে সেনাবাহিনীর শীর্ষপদগুলোতে বসিয়েছে। জিয়া পরিবারের ওপর অত্যাচারটা তারাই করেছেন। আর জোট-দলের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কৌশলও মানুষ পছন্দ করেনি। এতসব বৈপরিত্য যে নৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে, বিএনপি আজ সেই সঙ্কটেরই শিকার। বিএনপির আন্দোলনের ডাকে যে আজ মানুষ নামে না- এসবও এর বড় কারণ। যদিও আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ট মানুষ সুযোগ পেলে হয়তো ভোট দেবে, কিন্তু রক্ত নয়। কিন্তু এ ধরনের ভোট একটা দলকে থোড়াই রক্ষা করতে পারে। এমন নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যের ঝাণ্ডা নিয়ে হাঁটা দলটিকে মানুষ সব সময় মাথায় তুলে রাখবে ভাবলে খুবই ভুল হবে।
দুই: বেয়নেটের শূঁড়-নামানোর কাল
ওয়ান ইলেভেনের বিষয়ে সোজা-সাপ্টা জবাব অনেকের কাছেই নেই। এটি সামরিক শাসন ছিল না, আবার সামরিক শাসনের চেয়ে কমও ছিল না। একটি নির্বাচিত সরকার যত অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরতান্ত্রিকই হোক না কেন, সেটা অবশ্যই সামরিক শাসনের চেয়ে ভালো। প্রমাণ, বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসের দুই রকমের শাসনামল। দুটি দলের বেসামরিক শাসনের সময়ই দেশের অগ্রগতি বেশি হয়েছে। সে অগ্রগতি অর্থনীতি এবং মননশীলতা দুই ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামরিক আমলের চেয়ে বেসামরিক আমলে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াও এ সময়েই জোরদার হয়েছে। আবার বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন কখনো কখনো এমন স্বৈরতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছে যখন তাকে সামরিক শাসনের চেয়েও বেশি নিগ্রহমূলক দেখা গেছে। বেসামরিক আমলেই ঘটেছে অকাম্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কিছু কিছু দেশে হয়েছে স্বাগতিকও। ঘানার নক্রুমা, মিশরে নাসের, লিবিয়ায় গাদ্দাফীর ক্ষমতা দখলকে ইতিবাচক ভাবেই দেখা হয়। আবার পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নেতিবাচক।
‘অনেকেই কনফিউজড হলেও গোড়ায় ছিলেন সমর্থক’
আবার কেউ কেউ সমর নায়কদের রাজনীতিতে আসার ঘোর সমালোচক। কিন্তু জর্জ ওয়াশিংটন, রুজভেল্ট, চার্চিল, দ্য গল প্রমুখ এক সময় সেনানায়কই ছিলেন। বাংলাদেশের ওয়ান ইলেভেন প্রথমে ছিল স্বাগতিকই। কিন্তু তা অনেক বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়ে গেছে। এব্যাপারে পরে অনেকেই কনফিউজড হলেও গোড়ায় ছিলেন সমর্থক। একথা স্বীকার করতেই হবে, ওয়ান ইলেভেনের আগে দেশে নৈরাজ্য ছিল ভয়ঙ্কর। এই নৈরাজ্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব ধরে টান দিয়েছিল। তাই জানুয়ারির ১১ তারিখে জরুরি অবস্থার নামে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর দেশে ৯৫ শতাংশ মানুষই তাকে স্বাগত জানিয়েছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। দেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় প্রচার মাধ্যম সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানিয়েছে। দু’একটি ছিল ব্যতিক্রম। ওয়ান ইলেভেন রাজনীতিকদের বাইরেও এমন কিছু লুটেরা-দুর্বৃত্তকে জেলে ঢুকিয়েছিল যার নজির অতীতে দেখা যায়নি। কিন্তু অতি দ্রুত তারা সঙ্কটে পতিত হয়। এব্যাপারে আমি যতদূর দেখেছি, বুঝেছি ও পরবর্তীকালে শুনেছি সব মিলিয়ে আমার মূল্যায়নে ব্যর্থতার কারণগুলো হচ্ছে:
প্রথমত ওয়ান ইলেভেনের ঘটনার নায়কদের মধ্যে বিভক্তি এসে গিয়েছিল। নিজেরা নিজেদের উচ্চতর পদে প্রমোশন দিয়েছেন। এর আগে-পরের বিভক্তি তাতে আরো জোরদারই হয়। বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও যাননি সেনাবাহিনীর একটি অংশের আশ্বাসে। বিএনপির নতুন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার, হান্নান শাহ প্রমুখ অবস্থান নিতে পেরেছিলেন সে কারণেই। বিএনপির মধ্যস্তরের কিছু নেতা প্রকাশ্যেই বলাবলি করতেন যে, ওয়ান ইলেভেন ওয়ালাদের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ডিজিএফআইয়ের একটি অংশ তাদের সাহায্য করছেন। সংস্কার কর্মসূচি ব্যর্থ করার জন্যও যে সে অংশ কাজ করছিল তার অন্যতম প্রমাণ, সেনাবাহিনীর চাপে সাদেক হোসেন খোকা সংস্কারপন্থিদের পক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের পরদিনই সংস্কারপন্থিদের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি আশরাফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় যে তিনি তার ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি মেয়াদের আগেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনা সংস্কারপন্থিদের কাছে ছিল বড় ম্যাসেজ। এরপর থেকেই তখন একদল মাথা নিচু করে বিএনপিতে ফিরতে শুরু করে। ম্যাডাম জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অল্প কিছু সংখ্যক ছাড়া বাকি সবাই ফিরে যান বিএনপিতে। অবশ্য আশরাফ হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর ওয়ান ইলেভেনওয়ালাদের মূল অংশ মরিয়া চেষ্টা চালায় পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার। কিন্তু এরমধ্যে পানি অনেকদূর গড়িয়ে যায়।
‘সংস্কারপন্থি সব শীর্ষ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করার টোপ দেয়া হয়েছিল’
দ্বিতীয়ত ওয়ান ইলেভেনের সময় গ্রাম-নগরে ব্যাপক ধরপাকড়ের সময় ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা এমন কোন সীমা-রেখার কথা ঘোষণা করেননি, কাদের তারা গ্রেপ্তার করবেন, আর কাদের করবেন না। ‘অন্ধকার ঘরে সাপ মানে সারা ঘরেই সাপ।’ সারা ঘরেই বিরাজ করে ভীতি। এই ভীতি পেয়ে বসেছিল মানুষকে। যে লোক বড় দুর্নীতি করেছে সে যেমন ভয়ে ঘামতে থাকেন তেমনি যারা ছোটোখাটো দুর্নীতি-অনিয়ম করেছে তারাও ভয় পেতে থাকেন। এমন কি যে লোক ইনকাম ট্যাক্সে পাঁচশ টাকা কম দেখিয়েছেন বা কারো ঘরে দুরন্ত কোন যুবক আছে তারাও ছিলেন তটস্থ। শুধু শহরে নয়, গ্রামেগঞ্জেও ভাঙ্গা হয়েছে অসংখ্য দোকানপাট, সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার নামে, তথাকথিত পরিচ্ছন্নতার নামে। গরিব মানুষকেও করা হয়েছে বেকার। এলাকায় এলাকায় গ্রাম্য বিচার সালিশিতেও হস্তক্ষেপ করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ছিলেন ভয়ের ও অসম্মানের শিকার। কোথাও কোথাও জমিজমার দলিল নিয়েও মানুষকে ক্যাম্পে দেখা করতে বলা হয়েছে, প্রতিপক্ষের আর্জির প্রেক্ষিতে। সরকারি কর্মচারীদের ৯০ শতাংশই ছিলেন ভীত, তটস্থ। এই ভীতির স্বরূপও মারাত্মক। কারণ, সেনাশাসন কবলিত দেশে সেনাবাহিনীর আচরণ বা বিচার একেবারে আনপ্রেডিকটেবল। কোন ঘটনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আন্দাজ করা যায় ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, পরিত্রাণের উপায় কি। এমন কি ডাকাতের হাতে পড়লেও পরিণাম আন্দাজ করা সম্ভব। কিন্তু সেনা সদস্যদের কথিত ‘বিচার’ একেবারেই অনুমানের বাইরে। কাউকে হয়তো শত শত লোকের সামনেই কান ধরে উঠবস করতে বলা হলো, কাউকে হয়তো নির্দেশ দেয়া হয় পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের এই অ্যাডভেঞ্চার ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ওয়ান ইলেভেন ওয়ালারা হয়তো ভালো হবে মনে করেই এসব করেন, কিন্তু ফল দাঁড়ায় ভিন্ন।
তৃতীয়ত বেশকিছু বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকেও গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। তারা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। প্রতিকারের চেষ্টায় বিডিআরকে দিয়ে ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলা হয়। এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া কাজে আসেনি এবং এর জের গড়ায় দরবার হলে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তার মৃত্যু পর্যন্ত।
চতুর্থত ওয়ান ইলেভেনের প্রথম অবস্থায় জেনারেল মইন প্রেসিডেন্ট হয়ে নিজেরা সামরিক আইনের কায়দায় দেশ পরিচালনা করলে হয়তো পরিস্থিতি হতো ভিন্ন। মইন তখন তা করতে না পারলেও হয়তো মনে মনে তার ইচ্ছা ছিল ‘নেতা’ হওয়ার। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন বিদ্যমান নেতাদের কাউকে কাউকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে এবং বাকিদের পচিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করবেন, যখন নেতা হিসেবে তার বিকল্প থাকবে না। বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বাইরে পাঠানোর পরিকল্পনা, মান্নান ভুঁইয়া, আবদুল জলিল, তোফায়েল, রাজ্জাক প্রমুখকে পচিয়ে ফেলার কৌশল দেখা গেছে। এমন কি ড. ইউনূসকেও সম্ভবত পচানোর একটা উদ্যোগ নেয়া হয় তাকে দিয়ে নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে। তিনি যথাসময় টের পেয়ে সরে আসেন। ফেরদৌস কোরেশীকে দিয়ে কিংস পার্টি গঠনের ব্যর্থতাও যোগ হয় তালিকায়। পরবর্তীকালে আরো জানা যায়, সংস্কারপন্থি সব শীর্ষ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করার টোপ দেয়া হয়েছিল আলাদা আলাদা ভাবে। মান্নান ভুঁইয়া ও আবদুল জলিল থেকে শুরু করে সাবের হোসেন চৌধুরী পর্যন্ত সবাইকেই ‘প্রধানমন্ত্রী’ করার আশ্বাস প্রদান করা হয়।
------------
সর্বশেষ আপডেট ২৭ জানুয়ারি ২০১৫, মঙ্গলবার