বইতে ছাপা কবিতার বাইরেও যে আছে নানা রকম কবিতা তা আমরা জেনেছিলাম কৈশোরে, যখন বিস্ময় খুলে দিচ্ছে আধফোটা চোখ, আমাদের চোখ আমাদেরকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে নানা জায়গায়, যখন মানুষ নয় আমরা ছুটছি মানুষের গানের দিকে, তার নানা ঘটনার আনন্দ ও বেদনার দিকে। গাছে গাছে কুড়াপাখি বসতো বলে যে হাটের নাম কুড়াগাছার হাট সেই হাটে গিয়ে দেখি, লোকের ভিড় থেকে একটু দূরে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কবি সুর করে করে কবিতা পড়ে চলেছেন। দুটাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এক ফর্মার ভাঁজ করা কাব্যপত্র। অনেকে না কিনলেও কবিকে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়িয়ে মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছেন নতুন ছাপা কবিতা। ধূলিমলিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা শ্যাম-বর্ণের লোকটির মাথাভরতি ঝাঁকড়া চুল আর দুই চোখ অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল। নিজের লেখা কাব্যপত্রটি থেকে যখন সৃষ্টিতত্ত্ব পাঠ করছেন তখন সৃষ্টিলগ্নের উষার আলো যেন এসে পড়েছে তার চোখে। সুর করে পঞ্চ পাঞ্জাতন বর্ণনা শেষে তিনি পাঠ করেন: তারপর বারিতালা/ নাম তার লাশারিকালা/ যে কালিতে কোরান লেখা হয়।/ আছে কোরান লহু মাফুজে,/ আসল কোরান তারে কয়,/ আদমের কালেবে কোরান/ সেইটাকে আরশ মাল্লা কয় পাঠক কিন্তু এরপর ক্রমশ এক কাহিনির আঙিনায় প্রবেশ করে। সবাই বুঝতে পারে, এ কাহিনি অনতিপূর্ব কালে কোথাও ঘটে গেছে। এতে কবিতা ও সংবাদ দুই-ই আছে। আমরাও সেই কাহিনির সঙ্গে দারুণ এক বিষাদ কিংবা আনন্দ নিয়ে যুক্ত হয়ে পড়ি। হাট থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের মনে গুঞ্জরিত হতে থাকে সেই কবিতার সুর আর ছন্দ।
একদিন শোনা গেল, ভানুডাঙা থেকে দুজন কবি আসতেছেন; পশ্চিমের ভিটায় মঞ্চ বানানো হয়েছে; কবির লড়াই হবে। সন্ধ্যা নামতেই হ্যাজাকের আলোয় ভিটা আলোকিত হয়ে গেল। কালচে হয়ে যাওয়া পাতার বহু পুরাতন আমগাছগুলোর যে বাগিচা রাতের বেলায় ছিল ভুতপ্রেতের বাসস্থান সেই জায়গা ঝকঝকে আলোর এক রহস্যভূমি হয়ে উঠল। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে কত যে মানুষ এসে জড়ো হলো, ভিটা উপচে পুকুর পাড়, পাশের বাড়ির উঠান থেকে কুয়াতলা পর্যন্ত লোকজনের ভিড় ছড়িয়ে গেল। অনেক মানুষের চীৎকার চেঁচামেচি আর কথাবার্তার গুঞ্জন একেবারে থেমে গেল যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কবি মঞ্চে উঠলেন। গায়ে শাল জড়ানো দুধশাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সৌম্যকান্তি দুই কবি মঞ্চের দুদিকে যার যার দোহার দলের লাগোয়া হয়ে দাঁড়ালেন। যন্ত্রসংগীত বাজলো কিছুক্ষণ। একসময় কবিদের একজন উঠে দাঁড়ালেন। শুরু হয়ে গেল জীব পরম কি গুরু-শিষ্যের পালা। কেউ একে বলেন বিচারগান। পালাক্রমে একজনের পর আরেকজন বলেন বলে কেউ এর নাম দিয়েছেন পালা। যে নামেই বলা হোক, সুর যুক্ত করে ছন্দ-মিল উপমা উৎপ্রেক্ষা দিয়ে তারা যা বলে যাচ্ছিলেন তা কবিপদবাচ্য। আমরা দেখতে পাই চারদিকে ভিড়ের ভেতর আন্দোলিত হয়ে চলেছে অপূর্ব সেই কথাবস্তু। তাদের কথার যমক গমক শ্লেষ বা ব্যাজুক্তির সবটা না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারি যে, জীব হোক আর পরম হোক তা নিয়ে যে কথাই তারা বলছেন, তাকে সুন্দর করে বলবার একটা ব্যাপার আছে, কল্পনার মিশেল দিয়ে অলঙ্কারের এমন এক একাত্মতা, জহুরি শ্রোতাকে তা তৃপ্ত করবেই। কিন্তু রাত গভীর হলে কবিতার ছন্দস্পন্দন আমাদের তন্দ্রার সঙ্গে ক্রমশ সেলাই হয়ে যায়।
কোনো রাতে পাশের বাড়ির বারান্দায় দেখা গেল, সামান্য একটু ভিড়, হারিকেনের আলোর পাশে একজন লোক ঝুঁকে আছেন একখানা পুঁথির উপর আর তাকে ঘিরে বারান্দায় এবং উঠানের নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেকে। পরে জেনেছি, লোকটাকে নৌকায় করে পাশের গ্রাম থেকে অনেক বলে-কয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। জীর্ণ হয়ে যাওয়া একখানা খাতা থেকে তিনি যা পড়ে চলেছেন তা ছন্দমিল যুক্ত কথামালা, পড়াও হচ্ছে সুর করে করে। বিষয়বস্তু রূপকথার মতো, কাহিনিতে আছে পরির দেশ, পাতালপুরি, রাক্ষস-খোক্ষস, অলৌকিক ফলফুল, এইসব। কুড়াগাছার হাটে পথের ধারে দাঁড়িয়ে যে কবিতা শুনেছি, তাতেও আখ্যান ছিল। কিন্তু সেটা ছিল বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নিয়ে। পড়ার সুরও আলাদা। অনেক পরে বুঝেছি, পাশের গ্রাম থেকে আসা লোকটা হারিকেনের আলোয় যে কাহিনি-কবিতাটি পড়েছেন, সেটা অবাস্তব কাহিনি হলেও তার তাৎপর্যের জায়গাটি সত্য। সত্য হচ্ছে কারো ষড়যন্ত্রে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা আর সঙ্কটগুলো, বন্ধুর জন্য মন্ত্রীপুত্রের আত্মদান, নিয়তির নির্মমতা, উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিপদ পাড়ি দিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা। বারান্দায় ও উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে লোকেরা বসে ছিলেন তাদের কেউ চাষী, কেউ দিন-কামলা, কেউ কামার, কেউ করাতি, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবাসায়ী; তাদের চোখগুলোকে আমি ভাবাচ্ছন্ন হতে দেখেছিলাম। বৃষ্টি হয়ে যাবার পরে নিচু জায়গায় যেভাবে জল জমে যায়, কাহিনি থেকে সেভাবে সত্যগুলো আটকে যাচ্ছিল তাদের মনের আনন্দ-বেদনার সঙ্গে। আরেকবার শুনলাম, উত্তর পাড়ায় বহ্মগাছা থেকে একটা দল এসেছে একদিল গাইবে। রাত একটু গভীর হলে বেরিয়ে পড়লাম। পুবের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় প্রতি বাড়ির আঙিনাতেই আড়া বেঁধে কাঁচা পাট শুকাতে দেয়া হয়েছে; মাদকতাময় একটা গন্ধ বাতাসে। পুবের বাড়ির বাঁশঝাড় থেকে নেমেই ছোট একটা খাল। বাঁশের সাঁকোতে পার হয়ে অল্পদূর হেঁটে গেলে উত্তর পাড়া। গিয়ে দেখলাম, আঙিনায় খড় বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। বাদ্য বাজছে, দলের প্রধান লোকটি দাঁড়িয়ে আসর বন্দনা শেষ করে কাহিনি বর্ণনা শুরু করছেন। পূঁথির কাহিনির সঙ্গে এর মিল আছে। গল্পটি কাল্পনিক আর অলৌকিক ঘটনা দিয়ে গড়ে ওঠা। পুঁথি-পাঠক যেভাবে বসে সুর-ছন্দ-অন্তমিল বজায় রেখে পড়ে যাচ্ছিলেন, এখানে ব্যাপারগুলো ঐরকম ভাবে ঘটছে না। গায়েন লোকটি অঙ্গভঙ্গি করে উড়–নি উড়িয়ে কাহিনির চরিত্রগুলোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। আবার কাহিনির বর্ণনাকারীও তিনিই। কখনো কখনো দোহারেরাও তার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিচ্ছে, কোনো চরিত্র হয়ে। দেখতে পাচ্ছিলাম কখনো কখনো গায়েনের বর্ণনা কবিতার উচ্চতা পাচ্ছে, যখন তিনি একদিলের ভাইদের বিদায়দৃশ্য বর্ণনা করছেন বা নায়িকার স্নানের দৃশ্য বর্ণনা করছেন কিংবা মায়ের নির্দেশে স্বর্গের বাকোয়ালি ফুল খুঁজে আনতে গিয়ে গভীর অরণ্যে এক কুহকী রাজকন্যার প্রাসাদে তার সঙ্গে পাশা খেলায় হেরে একে একে সব ভাই যখন বন্দী হয়ে পড়ছে আর যখন কনিষ্ঠ ভাইটি প্রাসাদের বাইরে সেই অরণ্যে বসে মায়ের কথা ভাবছে। গায়েন কাহিনির এই আর্কিটাইপাল জায়গাগুলোতে এসে কখনো কবিতা থেকে চলে যাচ্ছিলেন গানের দিকে, বেজে উঠছিল বাদ্য।
অনেক পরে ব্যালাড বা গীতিকার কাহিনিগুলোর ক্ষেত্রে দেখেছি এর বেশির ভাগের আখ্যানই বাস্তব ঘটনানির্ভর আর সমস্ত কাহিনি জুড়েই বিষাদের একটা সুর। অত্যন্ত করুণ কোনো বিয়োগ-বিধুর ঘটনাকে মনে রেখেই কোনো কবি রচনা করেন এই গীতিকা। এটি শুনতে গিয়েও মন এক ব্যথাতুর আবেগে ভরে ওঠে। কিন্তু যখন লীলাগান শুনতে গেছি বংশাই নদীর ধারে প্রসিত দাদার বাড়িতে, অষ্টকালীন সেই লীলাগান যা দূরদূরান্ত থেকে আসা কীর্তনীয়ারা পালাক্রমে গেয়ে চলেন, তাতে ধর্মীয় আবেগেই আপ্লুত হতে দেখেছি বেশির ভাগ মানুষকে। কানাইয়ের ঘুম ভাঙে, তিনি রসোদগার করেন, গোষ্ঠে যান এবং ফিরে আসেন, এইভাবে তার আট প্রহর কাটে। তার সঙ্গে ভক্ত শ্রোতারাও তাকে অনুসরণ করে চলেন। গোষ্ঠলীলায় শ্রীরাধিকার গায়ে যখন ব্রজের বাতাস লাগে, কৃষ্ণ ছাড়া কিছুই তার ভাল্লাগে না, শ্রোতা তখন ভক্তিগদগদ হয়ে ওঠেন, কান্নার রোল পড়ে যায় চারদিকে। ভগবৎ প্রেম শ্রমঘামরক্তমাংসের মানুষকে চিরায়তের নিকটবর্তী করে। আমরা কীর্তনীয়াদের কথা আর গানের বাণীকে ঘিরে কবিতার কৃত্যই অনুষ্ঠিত হতে দেখি। বংশাইয়ের তীরে প্রসিত দাদার বাড়ির আঙিনা থেকে সামান্য দূরে ছোট ছোট সামিয়ানার নিচে নেশায় বুঁদ হয়ে বসে থাকতে দেখি রক্তচক্ষু বাউলদের। কীর্তনের মূল আসর থেকে নিরাপদ দূরেই তারা আস্তানা গেড়ে বসে। কোনো এক কালে নদীয়ার তিন পাগল যে ভাবের সাগরে ভাসিয়েছিল মানুষকে তার স্রোতে ব্রাহ্মণের পিতৃতর্পণের জল মিশতে শুরু করলে এই বাউলেরাই সহজ ভাবকে গান আর কবিতার আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ওই আসর থেকে। বসিয়েছিলেন নতুন আসর। বাউলদের মাধ্যমে আমরা পেয়ে যাই কবিতার নতুন কৃত্য। সহজিয়া সিদ্ধারা বুঝি ফিরে এসেছেন আরেক রকম চর্যা নিয়ে, এই বাংলা মুল্লুকে।
কবিতার আনন্দকে তখন বুঝেছি, সেই বয়সের মতো করে। বহুকার পরে সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র পড়ে জেনেছি, কবিতার সারাৎসার এক অনির্বচনীয় কথাবস্তু। বেঁচে থেকে মানুষের প্রাপ্তি কী হিতোপদেশে এই প্রশ্নের এক বিস্ময়কর জবাব আছে। বলা হয়েছে দুটি জিনিসের কথা; কবিতার আনন্দ ও সজ্জনের সঙ্গ। এই দুটো বস্তুই মানুষ হয়ে বেঁচে থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সব থেকে বড় লাভ।
মানুষের ভাবুকতা, সাধন-চর্চা জীবন নিয়ে তার বিস্ময়, জিজ্ঞাসা সিদ্ধান্ত এসব জানানোর জন্য হাজার বছর ধরে আমাদের প্রাচীনজনেরা বেছে নিয়েছেন কবিতার ভাষাকে। সে-কারণেই যেন খানিকটা বেশি করে মহত্ব ও কল্যাণ ভাবনা, কিছু রহস্যিকতা, মরমীচেতনা যুক্ত হয়ে কবিতার পাঠ পেয়েছে কৃত্যের মর্যাদা। সহজিয়া বুদ্ধদের রচিত চর্যাগীতিকার পদগুলো কিংবা বৈষ্ণব কবিদের রচনা এর সাক্ষ্য দেয়। মঙ্গলকাব্য, ব্যালাড বা গীতিকাগুলোর পাঠাভিনয়ের সঙ্গে আমাদের যৌথজীবনের মননধর্মিতার উদযাপন অচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত হয়ে আছে।
কোথাও যেন কাব্যের অনির্বচনীয়ত্ব তার ভেতরের রহস্যময়তা ধর্মরহস্যের ছদ্মবেশ নিয়ে মানুষের আত্মাকে আচ্ছন্ন করে, সেই নিশ্চেতনার মর্মমূল থেকেই কি শাস্ত্রগুলো মন্ত্রের মতো করে ছন্দ সুর নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে? জগৎ-কারণের ভেতর অস্তিত্ব, চেতনা সহ যে আনন্দ থাকে, অস্তিত্ব ও চেতনার প্রকাশটাই যদি হয় আনন্দ, তবে ভাষার সব উচ্চারণই আনন্দের। সেই আনন্দটাই স্ফটিকীকৃত হয়ে থাকে কবিতায়। গসপেলের জন কথিত সুসমাচারের শুরুতে বলা আছে, আদিতে বাক্যই ছিলেন ঈশ্বর। তাহলে প্রকাশিত হবার ব্যাপারটি কেবল আনন্দেরই নয়, তা ঐশীও বটে এবং তারই অব্যবহিত উপস্থিতি আছে কবিতায়।
একবার কোনো এক রাত্রিতে আমরা কয়েকজন এক গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, দেখলাম, উঠানে চন্দ্রালোকে এসে বসেছেন বিভিন্ন বয়সের কিছু মানুষ। সঙ্গে দোতরা খঞ্জনি ঢোল খোল ইত্যাদি আছে। বোঝা যাচ্ছিল, অনেক রাত অব্দি তারা বসবেন, সেখানে, উঠানের সেই চন্দ্রালোকে। আমরা তাদের পাশে গিয়ে বসি। সেখানে বসে আমরা যা শুনি, সুরসহ তাদের সেই উচ্ছারণের সকলই ছিল কবিতা, কেউ বলবেন ভাবসঙ্গীত। পরম মমতা ও বিনয় নিয়ে তারা গাইছিলেন সেইসব পদাবলি। বলছিলেন দয়ালচাঁদের কথা, যিনি আনন্দ দিয়ে গড়া এবং ঐশী। তাদের ভক্তির কারণ, আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভাষা রূপে তাদের সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি আনন্দ-স্বরূপা-- সকল সৃষ্টির মাতা-- তিনি পরমেশ্বরী-- কবিতা।