কংদুক বা যোগী পাহাড় সামিটের উদ্দেশ্যে : লোহ ঝিরি ধরে ট্রেকিং, দলিয়ান পাড়ার পথে ।
যোগী পাহাড় আর মদক রেঞ্জের আশে-পাশের চুড়াগুলোতে আমার চোখ আটকে যায় প্রথমবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া 'মদক তং' বা 'সাকা হাফং' সামিট করার পরপর-ই। সাকা সামিটে করে দক্ষিণে যাবার সময় খাড়া দেওয়ালের মত চুড়া থেকে কোন ভাবেই চোখ সরাতে পারছিলাম না । সাজাই পাড়া থেকে রেমাক্রি যাবার পথে বেশ কয়বার স্হহানীয় গ্রামবাসীদের কাছে এই চুড়াগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। চুড়াগুলো নিয়ে বিভিন্ন মিথও শুনতে পাই সে সময় । লোকেরা বলছিল ঐ পাহাড় উঠলে মানুষ বাচে না। ঢাকা থেকে এসে একটা দল উঠেছিল কিন্তু তারা বাচেনি, যাবার পথে এক্সিডেন্টে মারা যায় । যোগী পাহাড়ে প্রথম যারা অভিযান করেছিল ফিরতি পথে তাদের এক্সিডেন্ট হয় সেটা সত্য, অভিযাত্রী দলের দুই জন সদস্য ডা: মুগ্ধ আর সুজন মৃত্যু বরণ করে সেটাও সত্য - তবে দলের বাকী সদস্য মাইনুল আর সালেহিন মর্মান্তিক ভাবে আহত হয়ে বেচে যায় সেটাও সত্য ! আর যা থেকে এটাও প্রমাণ হয় একশভাগ মৃত্যু নিশ্চিত - এমন কোন কথা প্রমাণিত নয় ।
যাই হোক পাহাড় চড়ার মরণ নেশা মাথায় চেপে বসলে বাচাতেই হবে এজাতীয় ফন্দি- ফিকির খুব একটা জায়গা পায় না । আর২০১৪র এপ্রিলে জও-ত্লং সামিটের পর মদক রেঞ্জের একমাত্র আকর্ষণ বা মোহাবিষ্টতার অনুঘটক হয়ে দাড়ায় এই যোগী পাহাড় । যোগী নামটা ত্রিপুরা গোষ্ঠীর দেওয়া, যার অর্থ বাতাস। যোগী পাহাড়কে ত্রিপুরারা বলে যোগী হাফং বা বাতাসের পাহাড় । স্হনীয় মারমা ও বোমদের দেওয়া নামও নাম আছে । একটা নাম হচ্ছে কংদুক । সম্ভবত নামটা মারমাদের দেওয়া । বোমরা ওদের ভাষায় এটাকে ডাকে নেড়া পাহাড় । আমাদের অভিযাণের সময় আমারা বেশ কিছু গাছ-পালা পেলেও আগে এই পাহাড়ের চুড়াটি ছিল একদম নেড়া । ত্রিপুরাদের 'বাতাস' আর বোমদের 'নেড়া' এই দুই নাম থেকে যেটা বুঝা যায় তীব্র বাতাস আর পাথুরে ভুমির কারণে এখানে গাছ-পালা কিছু হত না ।
প্রথম অভিযাত্রী দলের প্রয়াত সদস্য মুগ্ধর স্বপ্ন ছিল নাইখ্যামুখ থেকে শুরু করে নাইখ্যাঝিরির শেষ পর্যন্ত এক্সপ্লোর করার । যার গন্তব্য শেষপর্যন্ত কংদুক বা যোগী পাহাড়ে - ঝিরির উৎসমুখে । আর পাহাড়ী ঝিরির স্হানে স্হানে অনেক গভীর 'খুম' বা গভীর জায়গা থাকে যেগুলো পার হওয়া ভেলা ছাড়া সম্ভব নয় । আর এই ভেলা তৈরীর জন্য পাহাড় বেয়ে প্রয়োজণীয় গাছ/বাশ কাটাও একটা সময় সাপেক্ষ ও খুবই কষ্টকর একটা কাজ। তাই মুগ্ধদের অভিযানে প্রচুর শ্রম আর সময় চলে যায় মুল ঝিরির রাস্তা ধরে পথ চলতেই। পরিকল্পনা মাফিক ঝিরি পথ শেষ করে কংদুকের শেষ মাথায় তারা যখন পৌছে তখন স্হানীয়রা পাহাড়ে উঠার বিষয়ে কেউই কোন স হযোগিতা করতে সম্মত হয়নি । দলের সদস্য মাইনুল বলেছিল যে সেখানেও এরকম জনশ্রতি ছিল যে এি পাহাড়ে উঠলে মানুষ মারা যায়, ফিয়ে আসে না ।
বাংলাদেশের অভিযানের ইতিহাসের সবচেয়ে অনবদ্য এই অভিযাত্রায় দলের সদস্যরা কোন প্রকার স্হানীয়দের সাহায্য সহযোগিতা না নিয়ে সব রকম বাধা-বিঘ্ন আর উপেক্ষা করে , নিজেরাই এগিয়ে যায় সামিটের পথে । চুড়ায় পৌছতে পৌছতে সন্ধা নেমে আসে । পর্বতের শীর্ষেই রাত কাটিয়ে দেয় এই অদম্য অভিযাত্রী দল। একটা কঠিন অজানা এবং ভয়াবহ রকমরে খাড়া পথে ধরে নেমে আসে দলের সদস্যরা। পরের ইতিহাসটা খুবই করুণ আর মর্মস্পর্শী । ভয়াবহ দূর্গটনায় মারা যায় মুগ্ধ আর সুজন। আহত হয়ে দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় কাটিয়েছিল মাইনুল আর সালেহীন। আর যোগীতে কোন দলের অভিযানও বন্ধ ছিল প্রায় আড়াই বছর ।
কংদুক বা যোগী পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গা একেবারেই খাড়া আর সেখানে কোন গাছপালাও হয়না । আর এই নেড়া যায়গাটা কতটা খাড়া তা গুগুল আর্থ দেখে বুঝাও যায় না । আর এখানেই ভুল বুঝে সহজতর একটা চুড়া মনে করে ২০১৪র অক্টোবরে আমি আর সাদেক হোসেন রওনা দেই সামিটের উদ্দেশ্যে । সাদেক হোসেন সনি আমাদের দেশের একজন শক্তিশালী ও সম্ভবনাময় পর্বতারোহী । ভারতের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং এসোসিয়েশনের বেসিক ও এডভান্স কোর্স ছাড়াও এভারেষ্টের কাছে কালাপাথার এলাকায় ১৮০০০ ফুট পর্যন্ত ট্রেকিংএর অভিজ্ঞতার অধিকারী সনি ।
যোগীর খাড়া দেয়ালের পাশ বেয়ে উপরে উঠছে নওশাদ( ছবিতে লাল দাগ দিয়ে চিন্হিত করা )
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:১১