ফুটবলের যেমন পেলে, মাউন্টেনিয়ারিং এ মেসনার । তার কালজয়ী রচনা " অল ফোরটিন এইট থাউজেনডারস" - এ লিখেছেন অক্সিজেন ছাড়া সবগুলো উচু চুড়ায় উঠার কাহিণী। আগের পর্ব পড়া না হলে একটু কষ্ট করে দেখে নিন, এছাড়া নীচের গল্পটার মজাই নষ্ট হয়ে যাবে !
----------------------------------------------
৮ই মে অস্ট্রিয়ান টীম তাদের শেরপা সহ সামিট করে, সাথে ফিল্মের ক্যামেরা ম্যানও ছিল । তাদের সামিটের পর শেষ পর্যন্ত আমার আর পিটারের সামিটের সুযোগ এলো। আমরা ক্যামেরাম্যান এরিক সহ আমরা সাউথ কোল পর্যন্ত পৌছে গেলাম ।( ৭৮০০ মিটার, নেপাল দিয়ে আরোহন করলে ,সাধারনত ৪র্থ ক্যাম্প বা সামিট ক্যাম্প এখানে করা হয় ) সেখানে থাকা একটা তাবুতে তিন জনে গাদাগাদি করে উষ্ণতায় রাত কাটালাম।
..........................
সামিট পুশ শুরুর জন্য ৭৮০০ মিটারের সাউথ কোলকে বেছে নিয়েছিলাম যথষ্ট ভেবে চিন্ত আর জেনে বুঝেই। আমরা চাইছিলাম ৮০০০ মিটারের বেশী উচ্চতায় কম সময় থাকতে । আমরা চাইনি ৮৫০০ মিটার উচুতে অক্সিজেন বিহীন অবস্হায় বিভুয়াক ( ক্যাম্প বিহীন সাময়িক বা জরুরী আশ্রয় স্হল ) করে নিজেদের ঝুকির মুখোমুখো করতে । নিশ্চিতভাবেই এই কৌশল ছিল আমাদের সফলতার অন্যতম অনুঘটক।
আমি নিশ্চিত অন্যান্য সব অভিযানে আমি যেটা করি সেরকম যদি এখানেও করতাম - ক্লাইম্বিংটাকে দুই ভাগে ভাগ করে নিতাম, সাউথকোল থেকে ৮৫০০ মিটার, আর সেখানে বিভুয়াক করে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে পরদিন সামিট করে ফেরত আসা - তাহলে এ অভিযানে সফল হওয়া সম্ভব হত না । আমাদের গতানুগতিক স্পীডে না চলে স্বল্প সময় আমরা ৮০০০ মিটারের অধিক উচ্চতায় ছিলাম - যেটা আমাদের হাই অল্টিচিউডে ক্ষতিগ্রস্হ হওয়া কমিয়ে দিয়েছিল।
.....................
সাউথকোল থেকে সামিট পর্যন্ত আমাদের ৮ ঘন্টা লেগেছিল । শেষ অংশে আমি এগিয়ে ছিলাম আর সেখান থেকে পিটারের সামিটে উঠার ছবি উঠিয়েছিলাম । পিটার যেহেতু হিলারী স্টেপ পার হয়েই সামিটে এসেছিল, সামিটে পৌছানোর ঐতিহাসিক মুহুর্তটা আমি ফিল্মে ধারণ করতে পেরেছিলাম । আজো যখন সেই ছবিগুলো দেখি, সেসময়টা আবার এসে যায়, শেষ মুহুর্তটা, যখন আমরা বসেছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে উচু স্হানে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। চুড়ায় পৌছাতে নিজেদের এতটাই নিবিষ্ট করে রেখেছিলাম, এবং সেটা এত দীর্ঘ সময় ধরে যে সেখানে পৌছানোর পর কিছুটা সময় আর কিছু করার মত অবস্হা আমাদের ছিল না ।
সামিট থেকে নেমে আসাটা ছিল একদম হুলুস্হুল একটা ব্যাপার । পিটার তো সাউথ কোল পর্যন্ত প্যান্টের উপর বসে "স্লীপারে পিছলা খেয়ে যেভাবে বাচ্চারা নামে " - সেভাবে আমার আগে আগেই নেমে গেলো ! আমি আরো কিছুটা সময় ছিলাম ফিল্মের কাজ করতে, একটু চারপাশটা চেয়ে দেখতে আর রেকর্ডারে কিছু কথা রেকর্ড করে নিতে। আর এগুলোই বেস ক্যাম্পে সামিটের স্মৃতিকে, কথাগুলোকে, হুবহু প্রকাশ করতে সাহায্য করে - কারণ মানুষের স্মরণশক্তির মত প্রতারক তো আর কেউ না!
.....................
পিটারের পিছু চলতে গিয়ে দেখলাম ও এতটাই এগিয়ে গেছে যে অনেক দূরে কালো একটা বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে। আমি তাড়াহুড়া করিনি । সাউথ কোলে পৌছাতে পৌছাতে আমার চোখে প্রচন্ড যন্ত্রণা বোধ করছিলাম। আমি যেহেতু ফিল্মের কাজ করছিলাম, ভালভাবে ছবি তোলার স্বার্থেই আমি সান গ্লাস খুলে রেখেছিলাম । ( পর্বতে প্রচন্ড সাদা তুষারের মাঝে কালো সান গ্লাস ছাড়া দিনের বেলা পথ চললে স্নো-ব্লাইন্ডনেস হয়ে যায়, তখন সীমাহীন যন্ত্রণা আর জালাপোড়ার সাথে সাথে কিছুই আর দেখা যায় না ) সারাদিন গগলস ছাড়া ছবি তোলায় স্নো-ব্লাইন্ডনেস এটতাই কাবু করেছিল যে সারাটা রাত তার যন্ত্রণাই পোহাতে হয়েছিল। কখনও কখনও যন্ত্রণাটা এতটাই বেশী ছিল যে অনেক সময় চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছিল ।
........................................
ঝড়ো হাওয়া পরদিনও চলছিলো। নীচে নামাটা আমার জন্য ছিল স্বপ্নের মত । আমি শুধুমাত্র কোনকিছুর অবয়ব বুঝতে পারছিলাম । পিটার আগে ভাগেই নেমেগিয়েছিল, ফিক্সড রোপ খামচে ধরে, পথ হাতরে অন্ধের মত নামতে থাকলাম। সে ৩ নাম্বার ক্যাম্প - এ আমার অপেক্ষায় ছিল। এরপর আবার সে এগিয়ে গেলে আমি একাই লো-সে ফেসের নীচ পর্যন্ত নেমে এলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ণ ছিল, এখানেও তাকে অপেক্ষা করতে দেখতে পেলাম। আমার মত ওরও সাহায্য দরকার ছিল। সাউঠ সামিট থেকে পিছলে নামার সময় ওর একটা গোড়ালী মচকে গিয়েছিল, আর সে নিজেও তার পায়ের ব্যাপারে ভরষা করতে পারছিল না। দুইটি পৃথক স্বত্তা ক্যাম্প টু তে নেমে এলাম। কিন্তু একই সময় আমরা খুবই গর্বিত বোধ করছিলাম - যে আমরা করতে পেরেছি । সব ধরনের পূর্বাভাস - সতর্কতা - নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে । আমরা এভারেষ্টের শীর্ষে অক্সিজেন ছাড়া-ই আরোহন করতে পেরেছি !
..................................
সমসময়ের মতই কিছু লোক এখানেও ছিল যারা আমাদের অর্জনকে সন্দেহ করছিল ।কিন্তু দুষ্ট-বচন শুধু তখনই স্তব্ধ হয়েছে - যখন আরো আরো লোকজন অক্সিজেন ছাড়া এভারেষ্ট আরোহন করে দেখিয়েছে, আট হাজারী চুড়ায় এজাতীয় আরোহন নিজেই এখন নিজের প্রমাণ ।
------------------------------------------
এর দুবছর পর মেসনার ১৯৮০ তে একাই নর্থ ফেস দিয়ে এভারেষ্ট- এ আরোহন করেন । সেবার তার কোন সংগি বা সাহায্যকারী ছিলা না। সেটার বর্ননাও এসেছে - তবে সাউঠ ফেস দিয়ে উঠার গল্প এখানেই সমাপ্ত !
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৪