বিয়ে
আর দুইদিন পরে আমার বিয়ে, কেউ জানে না শুধু আমি আর অয়ন ছাড়া। পালিয়ে বিয়ে তো আর ধুমধাম করে হয় না। কিন্তু পালাবার প্রস্তুতিও কিন্তু কম নয়। নেয়াটা জরুরীও। ভালবাসার মানুষটির হাতে হাত রাখতে পারার উত্তেজনাতো আছেই কিন্তু অনিশ্চয়তাও কম না। বিয়ের পরদিনই তো বলা যায় না, আমার স্যানিটারী ন্যাপকিন লাগবে, লাক্স সাবান লাগবে এক্ষুনি এনে দাও। প্রেমের উপহার আর বউয়ের আবদার দুইটা দুই মেরুর। একসাথে থাকা-থাকির আস্থা তৈরী না হলে কি আবদার করা যায়? অয়ন আমাকে পই পই করে বলেছে আমার বান্ধবীদের না বলতে। মেয়েরা নাকি পেটে কথা রাখতে পারে না। গত দুই মাস ধরে কত প্লানিং। সাক্ষী হবে ওর দুই বন্ধু। একটা লম্বু আর একটা বাটু। বন্ধু দুইটাকে আমার একদম সহ্য হয়না, ইতর শ্রেণির। আমার সামনে মেয়েদের নিয়ে কি বাজে বাজে কথা বলে। অয়ন যে কেন এদের বন্ধু, কে জানে।
ঠিক হয়েছে, আমি মগবাজার কাজীর অফিসে চলে যাব। ও ওখানে থাকবে। বিয়ের পর্ব সমাধা হলে ওদের সাভারের ফার্ম হাউসে যাওয়া হবে। তারপর দুই বাসায় কথা বললে সবাই মেনে নিবে। আর না নেওয়া পর্যন্ত সাভারেই থাকা হবে। অয়নের মা নাকি রাজি, উনি বাবাকেও রাজি করাবেন।
মাত্র উনিশ বছর বয়স আমার। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবি নাই। দুই বছর হল অয়নের সাথে সম্পর্ক। ও বিএ পাশ করে ওর বাবার সাথে ব্যাবসা করে। ওর বাবা নাকি ওর বিয়ে ঠিক করেছেন মোটা যৌতুকের বিনিময়ে। ও তাই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে। আমি অনেক বলেছি তুমি বুঝাও, বল আমাদের কথা। ওর এক কথা তাতে নাকি লাভ নাই। এখন এক মাত্র উপায় বিয়ে করা। এইটাই নাকি আমার ভালবাসার পরীক্ষা। ভালবাসলে পরীক্ষা দিতে হবে কেন! কিছু মাথায় ঢুকছে না। ওকে ভালবাসি, নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসি। বিয়ে করলে ওকেই করব, কিন্তু এত আগে? চোরের মত?
বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে, ছেলেবেলা থেকে পুতুল বিয়ে দিয়ে দিয়ে তারা একটু একটু করে নিজেদের তৈরী করে। ঘরকন্না তাদের অস্থি-মজ্জ্বায়, সংসারের জন্য মায়া তাদের রক্তকণিকায়। সবচেয়ে আপনার যে জন, তাকে নিজেকে উজার করে দেবার প্রস্তুতি না বুঝে সেই শৈশব-কৌশোর থেকে শুরু। দিনাপি সিলেট যাবার পর থেকে বাসার সব কাজ আমি করি। রুমা খালা প্রায়ই আম্মা কে বলে, তোমার এই মেয়েটা এমন লক্ষ্মীমন্ত, ওর শ্বাশুড়ি খুব লাকি, এমন মেয়ে যেখানে যাবে, সেখানেই বাড়-বাড়ন্ত। খালার ডায়াবেটিস, চায়ে চিনি বারণ, আমি ইচ্ছে করেই ওর চায়ে সামান্য চিনি দেই, এত মিষ্টি কথার বদলে অল্প একটু চিনি। বুঝে খালা, কিন্তু কি যে খুশী হয় চা খেয়ে। বলে, তোর হাতের চা, মা; চা নয় অমৃত, অমৃত। আর আমি মনে মনে হাসি।
আমি ঠিক এমন বিয়ে চাই না। কিন্তু উপায় কি? আমার মা বাবা কে বললে, উনারা কিছুতেই রাজী হবে না, উল্টো আমাকে গৃহবন্দী করে রেখে দেবে। আমার থেকে দুই বছরের বড়, দিনাপিরই বিয়ে বাকী। সিলেট মেডিকেলে পড়ছে, ওর পড়া শেষ হতেই আরো বছর চারেক লেগে যাবে। মা বাবাকে কি চিঠি লিখে যাব, সিনেমায় যেমন দেখায়? নাকি ফোনে বলব? একাজটা কি আমার করা ঠিক হচ্ছে? কি অদ্ভুত দোলাচলে দুলছি আমি। কোন দিকে যাব? কোনটা আমার নিয়তি? বালিশে মাথা চাপা দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করি, কোন লাভ হয়না। সব ইন্দ্রিয়েরা চরম সজাগ, ঘুমের আশা, নিরাশা।
আচ্ছা, কয়টা সেলোয়ার কামিজ নিব? শাড়িও একটা দুইটা নেয়া দরকার। শাড়ী না পড়লে বউ বউ ভাবটাই আসবে না। কিন্তু নিবই না কিসে? বিশাল একটা সুটকেস নিয়ে তো আর যাওয়া যাবে না। আর কত ব্যাপার আছে। বিয়ের পরে ওসব যখন হবে, তখনকার জন্যও তো ভাবতে হচ্ছে। পার্লারে গিয়ে ভ্রু, ফেসিয়াল, ওয়াক্সিং, ফেয়ার পলিস করিয়ে নিতে হবে। নিজেকে যাতে সব চেয়ে সুন্দর দেখায়। ভাবতে একটু লজ্জ্বা লজ্জ্বা লাগলেও ফার্স্ট ইম্প্রেশন বলে কথা। বিয়ের কনেরা এক মাস আগে থেকে প্রিপারেশন নেয়, কত বাজার করে, কত সাজগোজ, কত প্লানিং। আমারতো এসব করতে হবে না। কিন্তু পার্লারে কখন যাওয়া যায়? কত টাকা লাগবে তাই বা কে জানে। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কই অয়ন তো এসব নিয়ে ভাবছে না। তার খালি এক কথা। কখন বিয়ে হবে, কখন সাভার যাব আর কখন সে আমাকে আদর করবে। কার্জন হলে, কেমিস্ট্রি ল্যাবের কোনায় বারান্দায় বসে, একবার দুবার চুমু খেলেও, আর কিছু করার সাহস হয়নি। সব সময় আমাকে টিজ করে বলে, মেয়েরা নাকি একমাস প্রেম করেই লাভমেক করে, মেইক আউট করে, খালি আমি নাকি মান্ধাত্তার আমলে আটকে আছি। আমার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আবার সাথে সাথে বলবে, এই জন্য তুমি স্পেশাল বেইবি, তোমার জন্য অপেক্ষা করা যায়। কি পাগল ছেলে, কি বলে, মুখের কোন লাগাম নেই।
হুরমুড়িয়ে এসেই গেল আমার বিয়ের দিন। আম্মা বাজারে গেছে। তাই সময় নিয়ে সেজে, লালশাড়ি, লালটিপ পরে ব্যাগ ঘুছিয়ে বের হলাম। মগবাজার গিয়ে দেখি ও আর ওর তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে অয়ন এগিয়ে এসে বলল, কনা, একটা সমস্যা হয়েছে। মগবাজারের কাজি বিয়ে পড়াতে রাজি না। তোমার বয়স ১৯, তবু উনার এক কথা, বাসায় কথা বলে বিয়ে করেন। এসব বিয়েতে নাকি হুজ্জুত বেশি। উনি ঝামেলাতে জড়াবেন না। ঘুষ দিলেও লাভ নাই। এখন একমাত্র উপায়, সাভার যেয়ে বিয়ে করা। সাথে সাথে আমার মন কুডাকা শুরু করে দিল। তার উপর অয়ন একটা পাঞ্জাবিতো পরতে পারত। একটা পুরান কোচকানো টী-শার্ট পরে চলে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম ও কত ফুল নিয়ে আসবে, খুব সুন্দর করে হেসে আমাকে বলবে, অপ্সরার মত লাগছে, কই তার ধারে কাছেও নেই।
কি আর করা। মুখ বেজার মাইক্রোতে গিয়ে উঠলাম। ঢাকা ছাড়ার পরই চারদিক সবুজ, রাস্তার দুই ধারে বড় বড় ছায়াময়ী, মায়াময়ী বৃক্ষ, দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, খাল, ডোবা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে, এখন আর অত খারাপ লাগছে না। কিন্তু সাভার বাজার পৌছে আবার শহুরে ইট পাথরের জঞ্জাল, মার্কেট, মানুষের ভিড়। আমি দেখলাম কাজি অফিসের সাইনবোর্ড পার হয়ে গেলাম।
“অয়ন, আমরা কোন কাজি অফিস যাব? একটাতো পার হয়ে গেলাম।“ওরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। গাড়িটা ডানে একটা মাটির রাস্তা ধরে এগুতে লাগল। আমি হতবাক। কাজি অফিসে না গিয়ে এখানে যাচ্ছি কেন, আর এরা নিজেরা কি বলাবলি করছে। অয়ন আমার দিকে তাকাচ্ছেও না।
আমার হঠাৎ রাগ উঠে গেল।
“অয়ন গাড়ী থামাও। আমি নেমে যাব।“
“তুমি কি গাধা নাকি কনা? এখনো বোঝনি? তোমার পিছনে দু-দুইটা বছর ঘুরেছি, প্রেম প্রেম খেলেছি, আজকের দিনের জন্য। বিয়ে ফিয়ে কিছু না। উই উইল এঞ্জয় আওয়ারসেল্ভস টুডে। এখন ঝামেলা না করে চুপ করে থাক। তুমিও এঞ্জয় করবে, চেচামেচি করো না। “
সাথেসাথেই অনেক জায়গা নিয়ে, অনেক গাছপালার মাঝে নির্জন এক বাগানবাড়ির সামনের গেটে গাড়ি এসে থামল। বাটু ফ্রেন্ডটা ঘটাং করে আমার পাশের দরজা খুলে আমাকে টান দিয়ে নামিয়ে নিল। অয়ন নেমে আমার সামনে। লম্বুটা বলল, তুই আগে যা, হেল্প লাগ্লে জানাস।
অয়ন আমাকে টেনে হিচড়ে ঘরের দিকে নিয়ে চলল। আমার চিৎকার, আচঁড়, ছুটে পালানোর চেষ্টা সবই বৃথা। পিছনে শুনতে পাচ্ছি লম্বু আর বাটুর ইঙ্গিত পূর্ণ অশ্লীল কথা আর গা-গুলানো হাসি। আমার রাগ আর ভয় একি সাথে আমাকে প্রায় হতবুদ্ধি করে দিল। আমার সমস্ত সত্ত্বা আমাকে বলছে পালা কনা, পালা এখানে থেকে। অয়ন ঘরে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে চুমু খেতে চাইল, আমি ওকে আমার সব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলাম। চোখের পানির জন্য ওর মুখটা ঝাপসা। এই প্রতারক পশুর কাছে আমার অভিমানের কি মূল্য। আমার উপর আমার নিয়ন্ত্রন থাকছে না, ও আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, বিছানার দিকে, আমি শুধু চিৎকার করে বলছি, কেন, তুমি এমন কেন করছ? পায়ের নিচে মাটি টলমল, কেউ যেন আমাকে দখল করে নিচ্ছে, আমি সর্বশক্তি দিয়ে ওর হাত কামড়ে দিলাম, এক মুহূর্তের জন্য আমাকে ছেড়ে দিল, ব্যাথায়। আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দেখি ওরা দুই জন দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে।
আমি বুঝে গেলাম, পালাবার পথ নেই। নিশ্চিত মৃত্যু সামনে দাড়াঁলে ভয় আর কাজ করে না। আজ আমার স্বপ্নের বাসর হবার কথা, আজ তিন হায়েনা আমাকে ছিড়ে গুড়িয়ে দেবে। এর থেকে মৃত্যু লক্ষ গুনে ভাল। অয়ন এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে খাটে ফেলে দিল। আমি ওর চোখে চেয়ে বললাম, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম, তুমি এমন করো না, দয়া কর প্লিজ। ওরা এগিয়ে আসতে লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সবকিছু থেমে গেল যেন। আমার এই ক্ষুদ্র সারাজীবনটা ফ্ল্যাসব্যাকের মতন আমার চোখের সামনে দেখলাম। আজকে, কিম্বা আর কোনদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে বলবে না, “কনা মা রে, এক কাপ ফার্স্টক্লাস চা নিয়ে আয়।“ সন্ধ্যায় টিভি খুলে মা বলবে না, এই কনা, “পটলকুমার গানওয়ালার গান শুনে যা। কি মিষ্টি গলা, শুনলেই কান্না পায়!” দিনাপির, সিলেট থেকে নীলরঙের মনিপুরী শাড়ি এনে দেবার কথা। সাতকড়ার আচার নিয়ে আসার কথা। ও কি শাড়িটা কিনে ফেলেছে?
এরা আমায় ছাড়বে না। আমার ছেড়া দুমড়ানো লাশটা কি বাবা মা ফেরত পাবে? নাকি ওদের কাছে আমি আজীবন নিখোঁজ হয়ে থাকব! তাই-ই যেন হয় আল্লাহ। আমার আগে হাজার হাজার মেয়ে, শিশু, কিশোরী, মহিলা, বোন, কন্যা, জায়া জননী যেমন অসহায় হয়ে আকূল হয়ে ডেকেছিল, আমিও ডাকলাম, “হে আল্লাহ, হে ঈশ্বর আমাকে মৃত্যু দিন, এরা আমাকে ছোঁবার আগেই আমাকে তুলে নিন।“ সীতার মতন চাইলাম, “মাটি তুমি ভাগ হও। আমাকে বুকে স্থান দাও। নরপশুদের হাত থেকে বাঁচাও। অপবিত্রতার, অপমানের হাত থেকে বাঁচাও।“
সেই আবহমানকাল থেকেই এই দুঃস্বপ্নের রাত আর রক্তাত্ত সময়ের বিভীষিকা আজো শেষ হয়নি, সর্বশক্তিমান কি কখনো সাড়া দেন আমাদের এই আকুল ডাকে?
--------
"আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?"
-রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাতাসে লাশের গন্ধ, ১৯৭৭