আমি সদ্য মা হয়েছি। অপার আনন্দে নিজেকে পৃথিবীর চরম সুখি মানুষদের একজন মনে হয়, সবচেয়ে ধনী রাজকন্যাদের থেকেও সমৃদ্ধশালিনী মনে হয়। তবে নিদ্রাদেবীর অপার রোষে শেষ কবে টানা চার ঘন্টা ঘুমিয়েছি মনে নেই। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই, আমাকে দেখলে এখন রূপকথার সবচেয়ে কুৎসিত ঘুটেকুড়ানীও নিজেকে বিশ্বসুন্দরী ভাবতে পারে। মাতৃত্ব পরবর্তী ডিপ্রেসনের কারণে মেজাজও এদানিং বেশ চড়ে থাকে। নিজের সম্পর্কে এতবড় বিস্তারিত বিবরণ দেবার কারন ক্রমশ স্পষ্ট হবে পাঠক।
আজ সকালে (12/7/2013), মধ্যপ্রহর বলা বরং সঠিক হবে, ঘন্টাদুয়েক সাধ্য সাধনা করে মেয়েকে খাইয়ে, পরমুহুর্তে তার সবটা উগলে দেয়া বমি পরিষ্কার করে, ঘুম পাড়িয়ে, মেয়েকে অভুক্ত-প্রায় রেখে, বিধ্বস্ত আমি নাস্তা করছি আর প্রথম আলোর পাতা উল্টাচ্ছি। স্বপ্ন নিয়ে সাপ্লিমেন্টালের প্রথম পাতায় হুমায়ুন আহমেদের ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ এর সংক্ষিপ্ত ভার্সান ছাপা হয়েছে। আগামী ১৯শে জুলাই উনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে। উনি জননন্দিত লেখক, সপ্তাহখানিক শোক-স্মরণ হতেই পারে। আমি উনার বই হাতে পাওয়া মাত্র দ্রুতগতিতে গোগ্রাসে পড়ে শেষ করে ফেলি, কিন্তু সাহিত্য আড্ডায় উনার প্রসংগ আসলেই বোচা নাকটা সামান্য কুচকে বলি “হুমায়ুনের বই নিজের গাটের টাকা খরচ করে কিনে পড়ার জন্য না”!
এই হেন সদ্যপ্রসুতি, স্নবিশ, বদমেজাজি আমি, আবার এই গল্প পড়লাম। পড়েই মেজাজ গেল খিচড়ে। উনি বিশেষ মেধাবী ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু এভাবে প্রত্যক্ষ প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতির মত নিজের ঢোল নিজে পিটিয়েছিলেন, এইটা তো আগে খেয়াল করি নাই। মিসির আলীর মত ভাবগাম্ভির্যে বলতে ইচ্ছা করছে, “স্যার, আপনার গল্পে অনেক অসংলগ্নতা আছে।“
হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকলে, আমার মত নামহীন গুনহীন মানুষের কথা শুনে উনি নিশ্চয়ই হাসতে হাসতে বলতেন, “কি অসংলগ্নতা পেলেন, আর পেলেই বা কি?”
সেটা ঠিক, পেলেই বা কি। সাহিত্য আর বাস্তব এক নয়। মনের মাধুরী মিশিয়ে সাদা পানিকেও বেহেস্তি শরবত বানানো জায়েজ এইটা যেমন ঠিক, তেমনি সত্যের অপলাপের মাত্রা সহনীয় রাখাও উচিত।
আমি অনেক গোঁয়ার। মাথা নেড়ে বলতাম, “আপনি এমনভাবে লিখেছেন যে নর্থ ডাকোটা স্টেট আমেরিকার সেরা স্কুলগুলার অন্যতম, সেখানে পড়তে পাওয়া ভাগ্যের কথা। প্রতিবছর নর্থ আমেরিকার স্কুলগুলার যে র্যাংেকিং বের হয়, তাতে কিন্তু আপনার আলমা-মাটার এর পসিশন খুব উপরের দিকে কোনদিন ছিল না!”
“তারপর আপনি লিখলেন, ফোর আর ফাইভ হান্ড্রেড লেভেলের কোর্স গ্রাজুয়েট লেভেলের। কিন্ত ফোর হান্ড্রেড লেভেলের কোর্স আসলে সিনিয়র আন্ডার গ্রাজুয়েটদের জন্য। পিএইচডি স্টুডেন্টরা শুধুমাত্র প্রি-রিকুইজিট হিসাবে, না-পারতে আন্ডারগ্রাড লেভেলের কোর্সে এনরোল করে। সাধারনত এই প্রি-রিকুইজিট কোর্স করা না থাকলে পিএইচডি এডমিশন পাওয়াই দায়।“
নিজেকে অসাধারণ মেধাবী দাবী করে বলেছেন, “এই চেয়ারম্যানকেই (নর্থ ডাকোটার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলী নওয়াব আমার প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন--ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্প সংখ্যক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তৈরী করেছে, হুমায়ুন আহ মেদ তাদের অন্যতম।“ অন্যকে লেখা চিঠির বক্তব্য আপনি জানলেন কি করে? তাছাড়া স্যার, রসায়ন নিয়ে আপনার কয়টি প্রকাশনা, কোন জার্নালে তা নিয়ে কোথাও কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
তবে এইগুলা নিয়ে আমার মেজাজ চড়েনি। আপনার গল্পে আপনি কঠিনতম কোয়ান্টাম মেকানিক্স ক্লাস নিলেন, মিডটার্মে ফেল করলেন, শিক্ষক ডেকে নিয়ে কোর্স ড্রপ করতে বল্লেও আপনি করলেন না। বাংলাদেশি ছাত্রদের মান রাখতে, এক অন্ধ ছাত্র পারলে আপনিও পারবেন এই ব্রতে সেমিস্টার শেষার্ধে আপনি অসাধ্য সাধন করে ১০০ তে ১০০ পেলেন! খুব অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প সন্দেহ নেই। স্পেসালী “বাংলাদেশি ছাত্র” এঙ্গেল আপনার দেশপ্রেমের ইঙ্গিত দিয়ে আপনাকে আরো জনপ্রিয় করেছে। কিন্তু আপনি আপনার সাফল্যের ওজন বাড়াতে এক জায়গায় বল্লেন, “আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু অন্ধ ছাত্র-ছাত্রী আছে, তবে তাদের বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা দর্শন। কিন্তু থিওরেটিক্যাল কেমেস্ট্রি যে কেউ পড়তে আসে, আমার ধারণা ছিল না।“
“স্যার, আপনি কাকে অপমান করলেন? এই বিষয়গুলি একটি ইন্দ্রিয় ছাড়াই পড়া যায় এমনই জল-বত-তরলং? নাকি অন্ধদের কেমেস্ট্রি পড়ার ক্ষমতা নিয়ে আপনি সন্দিহান?”
তারপর গল্প শেষ করলেন আপনার বীরত্বগাঁথা দিয়ে। মিডটার্ম অব্দি দিন রাত পড়েও কূল পেলেন না, পেলেন শূণ্য; কিন্তু এক অন্ধের কাছে হারবেন না বলে, টার্মের বাকি অর্ধেকে দুনিয়া উলটানো রেসার্ল্ট করলেন, পেলেন সর্বোচ্চ নম্বর, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত হয়ে গেলেন, ফেলোশিপ পেলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন আপনি যদি মিডটার্মের পরে অসাধ্য সাধন করতে পারেন, তাইলে প্রথমে পারলেন না কেন? শূণ্য কেন পেলেন? পরে অনুঘটক কি ছিল? এক অন্ধ ছাত্রের অন্ধত্ব? কিন্তু স্যার বিনীতভাবে বলতে চাই, গল্পটির নাটকীয় পরিণতির জন্য অপরিহার্য হলেও, অন্ধরা লেসার হিউমেন নয়।
পরিশেষে পাঠক, আপনাকে বলি, লেখক হুমায়ুনের অনেক গল্প পড়ে আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছি। তার প্রয়াণে আমাদের সাহিত্যের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। মেজাজ খিচড়ে ছিল বলেই এই কাল্পনিক কথোপকথন। কিছু মনে করবেন না।