বিভা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চৌদ্দ বছরের ছটফটে দুরন্ত কিশোর ছেলে দিন দিন তার বাবার অবিকল আদল নিয়ে নিচ্ছে। সেই ঊজ্জ্বল চোখ, টোলপড়া হৃদয়হরণ হাসি! ছেলেতো কোনদিন বাবাকে দেখেও নি, জানেও না কে তার বাবা, স্বভাবগুলোও এক হল কি করে?
“মা, তুমি কিছু বলছো না কেন? মাঝে মাঝে তুমি আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে কেন থাক? কি যে হয় তোমার? মাআআ, শুনছো?”
বিভা অর্কের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে ছেলের নাকটা আলতো করে ছুঁয়ে আহ্লাদি স্বরে ডাকলেন তার সবচেয়ে আদরের ডাক, “তুই আমার জানবাচ্চা, তোর সব কথা আমি খুব মন দিয়ে শুনি। শুনি না বল?“
“হুমমম, তাহলে বল কেন আমাকে ফ্রাইস কিম্বা বার্গার খেতে দাও না, চিজ খেতে দাও না? কোন সোডা খেতে দাও না? খালি বোরিং ভেজিটেবল, ভাত আর রুটি খেতে দাও?”
বিভার বুকটা কেঁপে উঠল কষ্টে। যেদিন যুই ফুলের মত শুভ্র, পেঁজা তুলার মত নরম দেবশিশুর মত অর্ককে ডাক্তার ওর কোলে তুলে দিলেন, তার সমস্ত বুক ভরিয়ে, সব জ্বালা জুড়িয়ে, সেদিন একই সাথে তার ক্ষুদ্র পৃথিবীটা গুড়িয়ে দিলেন এক নিমেষে। অর্কের পারফরেটেড মিট্রাল ভালভ, হার্টের জটিল এক কন্ডিশন যাতে রক্তের গতিধারা উলটো বয়। এমন হবার সম্ভাবনা দশলক্ষে এক। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন বিভা। কেন? নিয়তির একি খেলা তাকে নিয়ে? কোলের অনিন্দ্য শিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে পারেন নি। না হার তিনি মেনে নিবেন না। ডেস্টিনির সাথে তার বোঝাপড়া হবেই একদিন। কেন তার জীবন এমন হবে? কি তার অপরাধ?
ছেলে তার হাত ধরে টানছে আর ঠোট ফুলিয়ে অভিমান ভরা আদুরে গলায় বলছে, “মা, আবার তুমি ড্রিম ওয়ার্ল্ডে হারিয়ে গেছ, আমার কথা শুনছো না!”
বিভা হাসলেন। এই আহ্লাদি ছেলে তার কাছ থেকে পেয়েছে। অনিক তাকে কতবার বলেছে, “তুমি একটা আহ্লাদি বেইবি, এত আদর খেতে পার বাব্বা! তোমার চেহারা পালটে যায় একদম!”
ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনিও অনেক আদুরে স্বরে বল্লেন, “বাবু, তুমি জান, ইউ হ্যাভ আ মেডিকেল কন্ডিশন। ডাক্তার মানা করেছে গ্রিসি খাবার খেতে! তোমার ফেভারিট স্যামন গ্রিল করে দেই জানবাচ্চা? খাবে?”
ছেলে দুই গালে টোল ফেলে সেই একই জগত ভোলানো হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকাল। তারপর এসে মাকে জাপ্টে ধরে গালে একটা চুমু খেয়ে “থ্যাঙ্কস মা, ইউ আর দা বেস্ট!” বলে লিভিং রুমে গিয়ে পিয়ানো নিয়ে বসে গেল।
ফ্রিজ থেকে স্যামন বের করে কাটা দিয়ে সামান্য খুঁচিয়ে লেবুর রস, সল্ট আর পেপার দিয়ে মাখালেন। ওভেন গরম হতে হতে যতটুকু ম্যারিনেট হয়। চুলায় আলু সিদ্ধ দিলেন ম্যাসড পটেটোর জন্য। মটরশুটি মাইক্রোওয়েভে সিদ্ধ করে দিবেন। ওভেনে মাছ ঢুকিয়ে আলু স্ম্যাশ করতে করতে ছেলের বাজানো শুনছিলেন। বলতে নেই, দারুন বাজায় ছেলে! অনিকও খুব গান ভালবাসতো। কত যে গানের কালেকশন ছিল ওর! বাউলগানের পাগল! কোথায় কোথায় চলে যেত গান শুনতে!
পৃথিবীর দুইপ্রান্তে থেকে কি করে অমন দিক-তালহীন প্রেমে পড়তে পারে মানুষ? প্রতিদিন জিমেইলে চ্যাট, অসংখ্য টেক্সট আর মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলা—কিন্তু কি ঘোরের মধ্যে, কি ভালবাসায় ডুবে থাকতেন সেই সময়গুলোতে!
দেশে ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে প্রথম দেখার সেই দিন! নীলরঙ অনিকের প্রিয় বলে নীলশাড়ি পড়ে গিয়েছিলেন বনানীর এক কফির দোকানে। সেটাও অনিকের খুব প্রিয় এক জায়গা, নামটাও মজার! রোল-এক্সপ্রেস! বাইরে একটা কোনায় বসে মুগ্ধ তাকিয়ে ছিলেন দুজন দুজনের দিকে। সেই কবে কোন সুদূর অতীতের কথা যেন। হঠাৎ অনিক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তার দিকে, দুই হাত দিয়ে সেই হাত ধরে বুকের ভিতর সেকি তিরতির ভাললাগা।
“চল যাই—তোমাকে নদী দেখিয়ে আনি।” তার হাত মুঠোবন্দী করে সেখান থেকে বের হয়ে ধামরাইয়ের রাস্তা ধরে তুরাগ নদীর পাড়ে চলে গেছিলেন সেদিন। কি যে সুন্দর সেই নদী, চারদিকে সবুজ ক্ষেত। এক বটগাছের নীচে বসে অনিক একটার পর একটা গান গেয়ে শুনিয়েছিল। কখনো নিজেও গলা মিলিয়েছিলেন— “খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।“
সেদিন বাসায় ফিরে যেতে চাননি বিভা—চেয়েছিলেন সময় থমকে যাক, কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝামাঝি এই সময়টাকে চিরদিনের ফ্রেমে আটকে ফেলতে পারলে কি দারুনই না হত! তাকে নামিয়ে দেবার সময়, অন্ধকারে তার হাতে চুমু খেয়েছিল অনিক। বাড়ি ফিরে সারারাত সেইখানে কতবার যে ঠোঁট ছুইয়েছেন মনে পড়ায় হেসে ফেললেন! আঠাশ বছর বয়সে আঠার বছরের তরুনীর মত উচ্ছলতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
এরপর আরেকবার মাত্র দেখা হয়েছিল তাদের। তার চলে আসার সপ্তাহ খানেক আগে। অনিক তাকে তুলে নিয়ে সোজা চলে গেছিল ব্রাক-ইন নামের এক গেস্ট হাউসে। ভালবাসার চুড়ান্ত রূপ জেনেছিলেন সেদিন—“দো দেহা এক প্রাণা” দুই জন মানুষের “মাইন্ড বডি আর সোল” এক হয়ে যাওয়া, যেন পরমাত্মা আর জীবাত্মার মিলন।
কত জল্পনা কল্পনা তাদের। কি করে তারা এক হবে। কবে বিয়ে করবে। তাদের বেড রুমে কোন সাউন্ড সিস্টেম থাকবে। কার ছবি কিনে দেয়ালে লাগাবে। গাছে গাছে সারা ঘর হবে সতেজ আর সবুজ! অনিকের স্ত্রীর সাথে তার কোন মানসিক যোগসূত্র নেই, একটি ভালবাসাহীন কাগুজে সম্পর্ক শুধু সামাজিক কারণে টেনে নিয়ে যাওয়া। শিঘ্রি ও বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করবে— ইতিমধ্যে বিভা আমেরিকার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে চলে আসবে দেশে।
আমেরিকা ফেরত এসে কাজের পাহাড়। তবু রাত জেগে জেগে প্রতিদিন কথা হত তাদের। কি যে আকুলতা বুকের ভিতর। মাস খানেক পেরিয়ে গেল। একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে খুব শরীর খারাপ লাগতে লাগল—ভীষন পেট ব্যাথা। তখন মনে হল প্রতি মাসের অতিথির কথা তো ও ভুলেই গেছিল। হিসাব করে তো মাথা খারাপ হবার জোগাড়--প্রায় দুমাস তার পিরিয়ড হয়নি। হয়তো দেরীতে হচ্ছে বলেই এমন পেট ব্যাথা। কিছুটা ব্লিডিংও হল—ব্যাথা ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছিল। আর সহ্য না করতে পেরে বাধ্য হয়ে সুসানকে ফোন করলেন। ইমার্জেন্সিতে গেলেন। ডাক্তার তাকে জানালেন তার পেলভীক ক্যাভিটিতে ইনফেকশনের জন্য ব্লিডিং হচ্ছে কিন্তু তার বাচ্চা সম্পূর্ণ সুস্থ্য আছে!
তার মনের যে তখন কি অবস্থা! কি অদ্ভুত খুশী, দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক, ভয়, ভাললাগা! কখন অনিককে জানাবেন। বাবুটার কোন ক্ষতি হবে নাতো! দুদিন হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেই অনিককে ফোন করলেন। গলা শুনেই বুঝলেন অপরপারে ঝড় বয়ে গেছে—এক বিদ্ধস্ত, পরাজিত সৈনিক যেন কথা বলছে তার সাথে। বুকটা গুড়িয়ে গেল এক লহমায়,
“কি হয়েছে বাবু? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“বিভা, এরা আবার আমাকে আটকে ফেলেছে—আমার উপায় নেই। আমি তোমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারব না বেইবি।“
কি যে হাহাকার ওর গলায়! বুক চিড়ে উঠে এল বাকি কথা গুলো--
“আমার স্ত্রী সুমি পাঁচমাসের অন্তর্সত্তা। আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি ও। গতকাল জানিয়েছে আমাকে। আমার মা জানিয়েছেন আমি মানুষ হলে তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে। এই দায়িত্বের বেড়া জালে আমি আটকে গেছি—আমাকে বন্দী করে ফেলেছে বিভা। আমি থাকব কি করে? কি করে বুঝাবো এদের, আমি চাই না এই সন্তান, চাই না এই স্ত্রীকে।“
অনিকের ডুকরে কেঁদে উঠার শব্দে বিভার চোখে নামল প্লাবন।
রিসিভার হাতে নিয়ে নির্বাক বসে রইলেন দুইজন পৃথিবীর দুইপ্রান্তে। কোন কথা না বলে, বল্লেন ক-ত কথা। কত আদর করলেন একে অন্যকে মনে মনে। আর যে তাদের কোন দিন কথাও হবে না! কি করে বেঁচে থাকবেন ভালবাসাহীন শুন্যতায়?
“ভাল থেক বাবু! আমিও ভাল থাকব।“
সেই শেষ কথা তাদের। অর্কের কথা জানেও না অনিক। কোনদিন জানবেও না। অর্ককে বলেছেন তার বাবা নেই, মনে মনে বলেছেন, “ও আরেক জনের বাবা জানবাচ্চা, আমিই তোমার মা আর বাবা!” অর্ক জানে মাকে বাবা নিয়ে প্রশ্ন করলে মা সারারাত কাঁদে। বুদ্ধিমান ছেলে কখনোই আর কোন কিছু জানতে চায় না।
নিয়তি তার আর অনিকের মাঝে কর্তব্যের দেয়াল তুলে দিয়েছিল, যেন বিশাল এক প্রাচীর, দুই পারের দুইজনের শত ইচ্ছা দেয়ালে মাথা কূটে মরেছে শুধু! কিন্তু কি আশ্চর্য প্রকৃতি তার অপুর্ণতা মুছেও দিয়েছে! মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে অর্ক কি প্রকৃতির প্রসন্নতা? ক্ষতিপূরণ? নাকি তার ভালবাসার প্রতিদান?
বেকড স্যামনের সুগন্ধে ঘর মম করছে। অর্ক চেঁচিয়ে বলল, “মাআআআ, তোমার ফেইভারেট গান বাজাচ্ছি এখন---“
টুংটাং সুর লহরী ভেসে এল—
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।
কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে॥
প্রভাতে পথিক ডেকে যায়, অবসর পাই নে আমি হায়--
বাহিরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক'রে॥
যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি
পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি।
যে আমার নতুন খেলার জন তারি এই খেলার সিংহাসন,
ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে॥
----------------------------
গানটির লিন্ক:
Click This Link