“বিভা জানিস, মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় কারো বাচ্চা চুরি করে পালিয়ে যাই।“
দিবার কথা শুনে আমিতো হতভম্ব। লিভিং রুমের বিশাল কম্ফি কাউচে পা তুলে আরাম করে বসে কফি খেতে খেতে দুই বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয়েরর স্মৃতি রোমন্থন করছি। জয় যে আমাদের গ্রুপের সব মেয়ের একবার করে প্রেমে পড়েছিল; শৈবাল যে নিজের হাতেম নাম বদলে শৈবাল বলে পরিচয় দিত; আমাদের গ্রুপে প্রথম বিয়ে হওয়া প্রিয়ার বর যে বাসরে আড়িপাতা সব বান্ধবীদের কি নাজেহাল করেছিল সে সব মনে করে হাসতে হাসতে আমাদের রীতিমত পেট ব্যথা হবার জোগাড়।
তার মাঝে হঠাৎ ওর এই মন্তব্য এতই খাপছাড়া, আমি বলার কিছু খুঁজে না পেয়ে হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দশবছর পর নেহাতই কাকতালীয় ভাবে ওর সাথে আমার দেখা মীনাবাজারে। ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছি বাসায়। ও আসলেই কেমন যেন হয়ে গেছে, সেই প্রানোচ্ছল মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল এই বিষন্ন প্রতিমার মাঝে। কেমন এলোমেলো। হাসছে আমার সাথে কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। কি হয়েছে ওর?
এই দশ বছরে দিবা কেন আমার কোন বন্ধুর সাথেই যোগাযোগ ছিল না। কিছুই জানি না বন্ধুদের খবর। মাস্টার্স শেষে আমি বাইরে চলে গেলাম পড়তে, দিবা বিয়ে করে সংসার গুছিয়ে বসল। কবির আর ও লালমাটিয়াতে ছয় তালার উপরে চিলেকোঠা টাইপ ছোট্ট একটা এপার্টমেন্টে থাকত। ওদের আসবাবহীন দুকামরায় আলো বাতাসের লুটোপুটি আর হৈ-হুল্লোর। ওরা ছাঁদের খোলা জায়গাটা টবে টবে, সবুজে সবুজে ভরিয়ে ফেলেছিল। আমরা দল বেঁধে প্রায় বিকালে হাজির হতাম-আমাদের হুটোপুটিও কম হত না। কিযে অসাধারণ ছিল সেই দিনগুলি। মনে মনে আমরা সবাই ওদেরকে হিংসা করতাম, আগামী মাসের বাড়িভাড়া কিভাবে দেবে তার ঠিক ছিল না কিন্তু ভালবাসার প্রাচুর্যে ওরা শাহজাহান-মমতাজকে হারিয়ে দিতে পারতো অনায়াসে। সেকি দীপ্তি ওদের চোখেমুখে। সেই স্বর্গাদপী গরিয়ষীর এই বিষন্ন, বেদনার্দ্র চেহারা দেখে বুকের মাঝে কেমন চিনচিন করে উঠল।
কফির মগটা নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে আলতো করে ওর হাতটা ধরে বললাম, “একথা কেন বললি হঠাৎ? কি হয়েছে তোর?”
দিবাও ওর মগ নামিয়ে রাখল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল নিমগ্ন নিরুত্তর। ওর চোখের জল পাপড়ির বেড়াজাল ডিঙিয়ে বাধ-ভাঙ্গা প্লাবনের মত ভাসিয়ে দিতে লাগল ওর দুগাল। আমি অসহায়ের মত কোন কথা খুঁজে না পেয়ে ওকে আঁধা জড়িয়ে ওর হাত ধরে বসে রইলাম। বেশ খানিক পরে ও যেন খানিক ধাতস্ত হল। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, তুইত চলে গেলি আমেরিকায়, তার পরের বছর আমাদের ঘর আলো করে এল নিশাদ। তোকে ছবি পাঠিয়েছিলাম, তুই একগাদা জামা আর বিশাল একটা টেডিবেয়ার পাঠিয়েছিলি মনে আছে? সেটা এখনও আছে ওর ঘরে। তারপর থেকে তুইতো গায়েব হয়ে গেলি!
ওর অভিযোগ এত সত্যি—স্কুলের চাপ আর ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতায় চেনা পৃথিবী থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমি তখন। ওর অভিমান এড়িয়ে পাল্টা বললাম “একদম তোর মতন হয়েছিল দেখতে। ওর বয়স কত হল রে—নয় তাই না?”
দিবার চোখ আবার ভেসে গেল জলে। কিছুপরে বুক চিড়ে উঠে আসা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ, একমাস পরে সেপ্টেম্বরের তিনে ওর নয় হত। গত বছর আগষ্টের ৬ তারিখে গাড়ি এক্সিডেন্টে ও আকাশের তারা হয়ে গেছে বিভা। আমার বেবিটা, আমার জানটা, আমাকে চিরজন্মের মত ছেড়ে চলে গেছে।“ দিবা আকূল হয়ে কাদঁতে লাগল। এত জল চোখের কোথায় লুকিয়ে থাকে? আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। ওকে কাদঁতে দিলাম, কোন সান্তনা দেবার চেষ্টাও করলাম না—কি বলব? নিজের চোখও যে ভেসে যাচ্ছিল।
কতক্ষন আমরা দুই বন্ধু শব্দহীন শোকের জগতে কি খুঁজলাম জানি না। বহুক্ষন পরে দিবা দুহাতে চোখ মুছে বলল, “যখন নিশাদ আমার পেটে আসে, তখন আমাদের কি যে টানাটানি ছিল জানিস। কবির বা আমার কারোরি কোন স্থায়ী চাকরি ছিল না। দুই পরিবারের কেউ আমাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি, কারো কাছে সাহায্য পাবার আশাও ছিল না। বড় ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা ছিল না, দরকারও বোধ করিনি—সবই নরমাল ছিল। কিন্তু ডেলিভারির দিন বার্থ-ক্যানালে ক্রাঊনিং বদলে ওর পশিসন উল্টা ছিল, ইনকমপ্লিট ব্রিচ, ওর পাগুলো ছিল নীচে। তখন তড়িঘড়ি সিজারিয়ান করতে হয়েছিল। পাড়ার অখ্যাত ক্লিনিকে অনভিজ্ঞ ডাক্তার আমার নিশাদকে ঠিক বাঁচিয়ে এনেছিল, পৃথিবীতে এসেই কি তাড়স্বরে চিৎকার ছেলের! বোধহয় মায়ের বিপদ টের পেয়েছিল আমার জানের টুকরা!
ওই সিজারিয়ানের ফলে আমার ইউট্রেসে ইনফেকশন হয়, দুসপ্তাহের মাথায় আমার ইউট্রেস ফেলে দিতে হয়। জানিস, আর কনসিভ করব না, নিশাদের কোন ভাই বা বোন হবে না, তা নিয়ে আমার একটুও দুঃখ ছিল না। কোল আলো করে আমার ছেলে আমার দুনিয়া আনন্দে ভরে দিয়েছিল। অভাব অনটন কিছুতেই কিছু যায় আসত না। কবির পাগলের মতন টাকা উপার্জনের চেষ্টা করত। আমি শুধু আমার ছেলে নিয়ে খেলতাম— কি অপার্থিব খুশী লাগত শুধু ওর মুখ বাঁকা করে হাসি দেখে! আমরা নিজেদের ছোট্ট এক তারা ঝলমলে সুখের জগত তৈরী করে নিয়েছিলাম।
তখনি কবির একটা ভাল কন্ট্রাক্ট পায়। আমাদের সব সমস্যা উবে যায় শূন্যে। নিশাদ হাটি হাটি পা পা করে হাঁটতে শিখল, কথা বলতে শিখল—আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম! এত বুদ্ধিমান এত সুন্দর ছেলেটা আমার ভিতরে ছিল একদিন। কি যে গর্ব হত আমার। তিনে পড়তে ওকে নার্সারিতে ভর্তি করলাম। জানিস, স্কুলের প্রথম দিন, আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম। আমার ছেলে যে বড় হয়ে গেল, ওর জগত, পরিধি অনেক বড় হয়ে গেল—শুধু আমাকে ঘিরে আর থাকল না। সত্যিই তাই হল, স্কুল, প্রাইভেট পড়া, সুইমিং আর গানের টিচার ওর সব সময় কেড়ে নিল। আমার ছেলেটা আধো আধো গলায় কি দারুন রবীন্দ্র সংগীত গাইত, ঠিক ওর বাবার মতন!
আমি সত্যি একা হয়ে গেলাম। সেই সময় স্বয়ং লক্ষী কবিরকে যেন পোষ্য নিলেন। প্রাচুর্যের সাথে বেড়ে গেল ওর ব্যস্ততা। আমাদের একদম সময় দিতে পারত না। আমি সময় কাটানোর জন্য কাজ নিলাম। লেখালেখির কাজ--একটা টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রামের বিবরণ লেখা। খুব বেশী প্রেসার নেই কিন্তু অনেক মানুষের সাথে প্রতিদিন মিটিং করতে হত, যা একদম ভাল লাগত না আমার। মিডিয়ার কিছু লোক মেয়েদের মানুষ না ভেবে “মেয়েমানুষ” হিসাবে দেখে। সুতরাং বুঝতেই পারছিস! কবির বারবার বলত চাকরি ছেড়ে দিতে। আমার বেতনের প্রয়োজন নেই সংসারে সেটা ঠিক কিন্তু আমি তো টাকার জন্য কাজ নেইনি, এটা ওকে বোঝাতে পারতাম না। এ নিয়ে শুরু হল তিক্ততা, ঝগড়া। আমারো কেমন গোঁ চেপে গেল। চাকরী ছাড়লাম না। কবির একদিন রাগের মাথায় বলে বসল, আমার কাজের জায়গায় আমার কোন প্রেমিক জুটেছে, তাই দু-পয়সা বেতনের কাজটা আমি ছাড়ছি না। আমিও বলে ফেললাম, টাকা ওর মনুষ্যত্ব কেড়ে নিয়েছে—ও টাকার মাপে দুনিয়া মাপে, অশিক্ষিতের মত। আস্তে আস্তে একে অন্যের থেকে দূরে সরে গেলাম আমরা। নিশাদ ছিল আমাদের দুই জগতের হাইফেন, একমাত্র যোগসূত্র।
ওকে স্কুলে নামিয়ে কাজে যেতাম আর কবির দুপুরে ওকে তুলে বাসায় নামিয়ে দিত। কখনো আমরা ওকে একা ছাড়তাম না। কিন্তু সেদিন” আবার ওর গলা কান্নায় বুজে এল। দুহাটুর মাঝে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল দিবা। ওর মাথায় হাত রাখতেই, ও কান্নাভরা স্বরে বলে চল্ল, “সেদিন, সেদিন আমার একটা জরুরী মিটিং ছিল সকালে, তাই নিজে না গিয়ে ওকে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়েছিলাম। কবির অনেক ভোরে ওর ফ্যাক্টরীর সাইটে চলে গেছিল। ও বলেছিল, কিছু হবে না, ছেলেকে আর কতদিন ডানার নীচে আগলে রাখবে? স্বাধীন হতে, নিজ-দায়িত্ব নিতে শিখতে দাও। সে যুক্তি মেনে নিয়েছিলাম, নইলে আমার ছেলেটা হয়তো আজো মা ডাকত, খিদে পেলে চিৎকার করে বলত, মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও, নইলে তোমাকে দেখতে এত সুইট লাগছে, তোমাকেই খেয়ে ফেলব এখনি।“ তীব্র অপরাধবোধ ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল যেন। কাঁদতে লাগল দিবা। ওকে জড়িয়ে ধরলাম, কাদঁতে লাগলাম আমিও, কবিরের কথা মনে হতে লাগল। সেই শান্ত, সর্বদা গুন গুন করে গান গাইতে থাকা ছেলেটি কেমন আছে? সেও এমন অপরাধবোধে ভোগে নিশ্চয়ই। “দিবা, কবির কেমন আছে রে?”
কিছু পরে অস্ফুট স্বরে দিবা বলল, “ও একেবারে স্তদ্ধ হয়ে গেছে রে। কখনোই তো বেশি কথা বলত না। এখন একদমই কারো সাথে কথা বলে না। সব কাজ ছেড়ে দিয়েছে বলতে গেলে। আমিও কাজ ছেড়ে দিয়েছি।“
একটু বিরতির নিয়ে দিবা বলে চল্ল, “গেল বছর নিশাদের জন্মদিনের আগের দিন সারাদিনের জন্য কোথায় চলে গেল আমাকে না বলে। অনেক রাতে ফিরে এসে আমাকে বলে, দিবা তাড়াতাড়ি চল, নিশাদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমাকে প্রায় টেনে বের করে নিয়ে চল্ল। জানিস, ও সেই লালমাটিয়ার পুরানো ছাদের ঘরটা ভাড়া করে ফেলেছে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য, ওখানেই নিশাদ যে এসেছিল আমাদের বুকে। বাড়িওয়ালার ছেলেরা দিতে চায়নি, তাদের মনে মনে সেটা ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানানোর চিন্তা, কিন্তু বুড়ো বাবার তা ইচ্ছা নয়। কবির কিনে নিতে চেয়েছিল, সেটা নাকচ করে দিয়েছে ওরা। বাড়ি ওয়ালাও চান না ফ্ল্যাট বানাতে, তাই তিনি কবিরকে ভাড়া দিতে রাজী হয়েছেন, এতে ওর ছেলেরা ওর অবর্তমানেও ভাংতে পারবে না। আমরা গুলশানের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে এখন ওখানেই আছি। আমাদের মাঝে আর কোন দূরত্ব নেই রে। প্রতি রাতে আমরা ছাঁদে মাদুর বিছিয়ে বসে থাকি, দুজনের মাঝে নিশাদের জন্য একটু জায়গা রেখে। আকাশের দিকে উন্মুখ পলকহীন চেয়ে থাকি দুজনে—অসংখ্য তারার মাঝে আমাদের নিশাদকে খুঁজি, মনে মনে কত কথা যে বলে যাই ওর সাথে।“
--------------
আমার প্রিয়তম বন্ধুকে--নিশাদ যার ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন।