১)
হরিহারা গ্রামের স্কুল মাস্টার জামেলুর সালেহীনের বাম দিকের পা টা ডান দিকের টার তুলনায় খানিকটা ছোট, একারণেই তাকে হাঁটতে হয় কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই নিয়ে অবশ্য তার খুব একটা মাথা ব্যাথা আছে বলে মনে হয় না, বরং ব্যাপারটা নিয়ে তাকে প্রকাশ্যেই রসালো কথা বার্তা বলতে শোনা যায়, মাঝে মাঝে তো তিনি এমনও বলেন যে তার পায়ের এই খুঁত আসলে খুঁত না, এর মাঝে লুকিয়ে আছে মহান আল্লাহ পাকের অতি জটিল কোন রহস্য-- তা অবশ্য আল্লাহই মালুম; তবে একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় যে আনুমানিক ৩৭ বছর বয়সী এই জামেলুরের চেয়ে বড় রসিক মানুষ হরিহারা গ্রামে আর একটাও নেই, উদাহরণ দিয়ে বলা যতে পারে, পাঞ্জাবি জামেলুরের খুবই প্রিয় পোশাক, সেটা অবশ্য যে কোন স্কুল মাস্টারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু জামেলুরের ক্ষেত্রে বিষয়টা কয়েক ডিগ্রি উপরে। তার পাঞ্জাবির কালেকশন মোটামুটি চোখে ধাঁধা ধরিয়ে দেয়ার মত। সপ্তাহের সাত দিন তিনি সাত রকমের পাঞ্জাবি পরেন। পাঞ্জাবির সাথে কখনই তিনি পায়জামা পরেন না, পাঞ্জাবির সাথে পায়জামা শরীরের মাঝে কেমন জানি একটা হুজুর হজুর ভাব নিয়ে আসে, এই অজুহাতে তিনি পাঞ্জাবির সাথে বরাবরই পরেন অতি উত্তম গজ কাপড়ের সেলাই করা প্যান্ট। এই সব প্যান্ট তিনি বহু টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে আনিয়ে নেন, যদিও এই ধরনের রসিক শখ খায়েস পুরনের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে বা যে পরিমাণ অর্থ তাকে নিয়মিত ব্যায় করতে হয়, তার উৎস সম্পর্কে গ্রামবাসির মাঝে চলে ক্রমাগতই কানা-ঘুষা। কারণ তার মতো একজন স্কুল মাস্টারের মাসিক বেতন আর যাই হোক না কেন এই ধরনের রসিক জীবন যাপনের জন্য কোন ভাবেই যথেষ্ট নয়, তারপরেও তিনি কি করে এই ধরনের জীবন যাপন করে যাচ্ছেন তা গ্রামবাসীর কাছে ছোটখাটো এক রহস্যই বলা যায়। জামেলুর সালেহীন অবশ্য এই সব রহস্য, কানা-ঘুঁষায় কর্ণপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি কখনোই, তিনি ব্যস্ত তার আপন জগৎ নিয়ে, যে জগতে অন্য কারোর প্রবেশের দ্বার তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন বহুকাল আগেই।
২)
দিনের শেষ ভাগ, পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে, সন্ধ্যা আসন্ন, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। সন্ধ্যা নেমে আসার এই সময়টা বড়ই আজব, প্রকৃতির মাঝে তৈরী হয় কেমন যেন একটা হাহাকার। একটা পরিপূর্ণ দিনের মৃত্যু ঘটে, তার হাহাকার? হবে হয়তো। হরিহারা গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদীটা চলে গেছে তার নাম শঙ্কবিহারী, বর্ষা মৌসুমে এই নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকে, তখন এখানে থাকে হরেক রকম মাছের আনাগোনা, বলাই বাহুল্য যে এর সাথে তাল মিলিয়ে চলে শত শত জেলেদের আগমন। হরিহারা গ্রামের আশেপাশের সকল গ্রাম থেকে জেলেরা এসে এখানে ভিড় জমায়, প্রবল উদ্যোমে তখন চলে মাছ ধরারা উৎসব, জেলেদের কাছে তা অবশ্য কোন ভাবেই উৎসবের পর্যায়ে পড়ে না, বছরের বাকী সময়টায় নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে এই সময়টাকে কাজে লাগানো ছাড়া তাদের কাছে আর অন্য কোন বিকল্প নেই, কাজেই এই নদীর বুকে জেলেরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষূধার্ত বাঘের মতো। শঙ্কবিহারী নদীর কিনারা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে দুইটা পথ, একটা চলে গেছে সোজা হরিহারা গ্রামের মূল অংশের দিকে, আরেকটা পথ কিছুটা বেঁকে গিয়ে চলে গেছে দুরের কাশবনের দিকে, জামেলুর সালেহীন হাঁটছেন এই পথটা ধরে। কাশবনের ঐ দিকটায় মানুষের তেমন একটা আনাগোনা নেই বললেই চলে, মাঝে সাঝেও কাউকে দেখা যায় না ঐ দিকটায় যেতে, কিন্তু জামেলুর সালেহীন ঠিক করেছেন আজ তিনি কাশবনের ঐ দিকটায় একটু ঘুরে আসবেন, হরিহারা গ্রামে এসেছেন ৬ মাস হতে চললো, অথচ এখনো কাশবনটাই ঘুরে দেখা হলো না, এই আফসোস তাকে গত কয়েকদিন ধরেই যন্ত্রনা দিয়ে আসছে, তাই আজ তিনি ঠিক ঠিক কাশবনের দিকে রওনা হয়েছেন। সূর্যের তেজটা কমে যাওয়াতে চারিদিকে এমনিতেই কেমন যেন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তার উপর নদীর পানি ছুঁয়ে ছঁয়ে আসা শরতের ঠান্ডা বাতাসটায় গাটা জুড়িয়ে যাচ্ছে জামেলুরের, একটু শীত শীতও লাগতে শুরু করেছে তার, প্রবল আনন্দ আর গাঢ় প্রশান্তি নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছেন অদ্ভুত শুভ্র কাশবনটার দিকে।
...............................................................................(চলবে হয়তো)