প্রথম অংশ
দ্বিতীয় অংশ
(৪)
আজ সোমবার। গত পরশু রাতে সিলেট এসে পৌঁছানোর পর থেকে মাঝের সময়টা মোটামুটি ভালোই কেটেছে অবন্তীর। গত কাল সারাদিনই সে ঘুরে বেড়িয়েছে। কোম্পানীর কোয়ার্টারটা থেকে শাহজালাল এর মাজারটা তেমন একটা দূরে না, তাই সকালে বেরিয়েই অবন্তী প্রথমে সেখানে গিয়েছে, মাজারেরে পুরো জায়গাটা বেশ ক্ষাণিকক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে দেখেছে, শেষের দিকে এসে মাজারটা জিয়ারতও করেছে সে। যে কোন মাজার থেকেই বের হয়ে আসার সময় সাধারণত যা হয় --মাজারের মূল ফটকের সামনে এক দল ফকির ঘিরে ধরে সাহায্যের জন্য, অবন্তীকেও সেই ঝামেলায় পড়তে হয়েছে, তবে সে আনন্দ চিত্তেই সবগুলো ফকিরকেই কিছু না কিছু দিয়ে মাজার থেকে বেরিয়ে আসে। মাজার থেকে বেরিয়ে এস সে যায় "কিম ব্রিজ" দেখতে, সুরমা নদিটা সিলেট শহরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে, তার উপর দিয়ে যাতায়াতের জন্যই বহুকাল আগে এই ব্রিজটা নির্মান করা হয়েছিলো। সিলেট শহরে সুরমা নদীর যে অংশটা ঢুকেছে সেই অংশটায় নদীর পাড়টাও দেখতে যথেষ্টই মনোহর, পাড়টাকে এখানকারর পর্যটনের কর্তৃপক্ষ মানুষজনের ভ্রমনের উপযোগী করে তুলেছে খুবই নিপুণভাবে, সেই পাড়টায় দাঁড়িয়ে সুরমা নদীটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো অবন্তী, তার খুব নদী হতে ইচ্ছা করছিলো, নদীর কোন আনন্দ নেই, কোন বেদনা নেই, কোন চিন্তা ভাবনা নেই, নদীর শুধু একটাই কাজ--কেবলই বয়ে যাওয়া অনন্তকাল ধরে।ব্রিজটা দেখা শেষ করে অবন্তী যায় স্থানীয় একটা মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামে এসে অবন্তীর মন খারাপ হয়ে যায়, তেমন কিছুই নেই সেখানে দেখার মতো, তাই মিউজিয়ামে আর সময় নষ্ট না করে সে আবার কোয়ার্টারে ফিরে আসে। তারপর দুপুরেরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে সে যায় কোম্পানীর ৩ নম্বর সেক্টরের চা বাগান গুলো দেখতে। যে চারটা চা বাগান সুপারভাইজ করার দায়িত্ব অবন্তীকে দেয়া হয়েছে, সেগুলো সে খুব মনযোগ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে, মাঝে মাঝে চা বাগানের কয়েকজন কর্মীর সাথে কথাও বলেছে সে, এর মধ্যে কয়েকজন উৎসুক কর্মী তার পরিচয় জানতে চাইলে সে শুধু মুচকি হেসেছে, কিছুই বলেনি। অবন্তী জীবনে কোনদিন চা বাগান থেকে চা পাতা তোলার দৃশ্য দেখেনি। জীবনে প্রথম বারের মতো এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে সে তাই যার পর নাই বিস্মিত এবং একই সাথে মুগ্ধও। সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে কত দ্রুতই না এরা চা পাতাগুলোকে তুলে নিয়ে নিজেদের পিঠে আটকানো ঝুড়িতে জমিয়ে রাখে--পুরা ব্যাপারটাই একটা অদৃশ্য ছন্দের তালে তালে ঘটে, এই ছন্দটাও অবন্তীকে নাড়া দিয়েছে খুব। নিচ থেকে দাঁড়িয়ে চা বাগানের টিলাগুলোকে দেখে অবন্তীর কেবলই মনে হয়েছে--সারিবদ্ধভবে বেড়ে ওঠা অনন্ত সবুজ অসংখ্য চা গাছে মোড়ানো এক একটা টিলা যেন এক একটা ছোটখাটো সবুজ পিরামিড।চাবাগানগুলো দেখা শেষ করে অবন্তী যখন কোয়ার্টারে ফিরে আসে তখন দিনের আলোটা প্রায় নিভু নিভু করছিলো। কোয়ার্টারে ফিরে আসার পরের সময়টুকু খুব একটা ভালো কাটেনি অবন্তীর। ভয়াবহ একাকীত্ব চেপে ধরেছিলো তাকে, কিছুই করার ছিলো না, তার রুমে এখনো টিভি আনা হয়নি, টিভি আসতে আরো দু'এক দিন লাগবে, অন্যদিকে মোবাইলে যে কারো সাথে কথা বলবে সে-- সেই উপায়ও ছিলো না, কারণ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার পরপরই সে তার বাংলা লিংকের সিমটা বন্ধ করে রেখেছে, আরেকটা নতুন সিম হয়তো কিনবে সে, কিন্তু তা দিয়ে তো আর ঢাকার কারো সাথে কথা বলা যাবে না--ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো অবন্তীর, মায়ের সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার, কিন্তু নিয়তি আজ তাকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড়া করিয়েছে যে-- শুধু প্রাণপ্রিয় মা-ই নয়, চেনা পরিচিত কারো সাথেই হয়তো একটা অনির্দিষ্টকালের জন্য তার আর কোন যোগাযোগ হবে না। নিজের মাঝে এক অসীম শূন্যতা নিয়েই তাই গত রাতটা প্রবল অস্থিরতা আর মানসিক যন্ত্রণায় কাটাতে হয়েছিলো অবন্তীকে।
(৫)
এখন দুপুর সোয়া দুইটার মতো বাজে। অবন্তী এই মুহুর্তে কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে আছে, কারণ আর পৌনে এক ঘন্টা পরেই তাকে চা বাগানের ম্যানেজার তাশফিন হাসানের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। অবন্তী একটা শাড়ি পড়েছে--সাদা জমিনের উপর রং বেরংয়ের ব্রাশ প্রিন্ট। মাথার চুল টান টান করে বেঁধেছে সে, ঠোঁটে হালকা গোলাপী রংয়ের লিপস্টিক। নারী হিসাবে সৌন্দর্য্যের যে বাড়তি ক্ষমতাটা বিধাতা তাকে দিয়েছে যে কোন জায়গায়ই তার রুচি সম্মত প্রয়োগে কোন ক্ষতি দেখে না অবন্তী, প্রথম দিনেই যদি ম্যানেজারের মনে একটা গুড ইম্প্রেশনে তৈরী করা যায়, তাতে তো কোন দোষ নেই, তাই যতটুকু সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলো সে। সাজগোজ করতে করতে সময়ের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো অবন্তী। তা মনে হতেই ঘড়ি দেখলো সে, আড়াইটা বেজে গিয়েছে, আর দেরী করা যাবে না, এখনই রওনা না দিয়ে দিলে তিনটার সময় ম্যানেজারের অফিসে পৌঁছানো যাবে না--নিজের মনে ভাবতে ভাবতেই হ্যান্ডব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো অবন্তী, আয়নায় নিজেকে আরেকটাবার দেখে নিয়েই ম্যানেজারের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো সে।
অবন্তী এখন বসে আছে ম্যানেজার তাশফিন হাসানের চেম্বারে। অবন্তীর কাছে সে একটু সময় চেয়ে নিয়েছেন, কার সাথে যেন কথা বলছে তাশফিন। অবন্তী অবশ্য আড়ালে ঠিকই তাশফিন হাসনকে দেখে নিচ্ছে। তাশফিনকে দেখে প্রথম অবস্থাতেই কিছুটা চমকে গেছে অবন্তী, সে ভেবেছিলো ম্যানেজারের হয়তো মধ্য বয়সের কেউ হবেন, কিন্তু ঘটনা তা ঘটেনি, অবন্তী স্পষ্টই বুঝতে পারছে তাশফিনের বয়স খুব একটা বেশী নয়, খুব বেশী হলে ৩০ এর মতো হবে, এর বেশী তো নয়ই; শরীরটাও বেশ পেটানো, শক্ত সামর্থ্যবান যুবক বলতে যা বোঝানো হয় আরকি, ক্লিন শেইভ করা গালটাতে ফেলে দেয়া দাড়ির ছাপ খুবই স্পষ্ট, চেহারাটা কিছুটা লম্বাটে, সাথে ঘাঢ় পর্যন্ত নেমে আসা চুলগুলো মিলিয়ে তাশফিন হাসানের যে পুরো অবয়বটা তৈরী হয়েছে তাতে নির্দ্বিধায়ই তাকে একজন সুপুরুষ হিসাবে ধরে নেয়া যায়--কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো অবন্তী, তাশফিন হাসানের কথায় তাই কিছুটা চমকে উঠলো সে।
তাশফিন মুখ গম্ভীর করে বললো, "কি ব্যাপার চমকে উঠলেন যে! কোন সমস্যা?"
অবন্তী কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললো, "না না স্যার, তেমন কিছু না।"
কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তাশফিন বললো, "যাক তাহলে তো ভালোই, আপনি তো গত পরশু এসেছেন, তাই না?"
অবন্তী বললো, "জ্বি। একটু আগেই চলে এসেছি।"
তাশফিন বললো, "ঠিকই করেছেন, একটা জায়গায় নতুন এলেন, সেখানে অনেকদিন কাজ করবেন, জায়গাটার আবহাওয়ার সাথেও তো খাপ খাইয়ে নেয়ার একটা ব্যাপার আছে, তাই না?
অবন্তী সাথে সাথেই বললো, "জ্বি, তাতো বটেই, গতকাল শহরের কিছু কিছু জায়গায় ঘুরেও দেখেছি, ভালো লেগেছে।"
তাশফিন হেসে বললো, "কোন জিনিসটা খারাপ লেগেছে?"
এই ধরনের প্রশ্নের জন্য তৈরী ছিলো না অবন্তী, তাই কিছুটা সময় নিয়ে সে বললো, "এখানে ধুলোটা একটু বেশী।"
তাশফিন মাথা নাড়িয়ে বললো, "একদম ঠিক বলেছেন, সিলেটের সবই ভালো, খালি ধুলোটা একটু বেশী, সে যাই হোক, আশা করি, আপনার কাজের ছোটখাটো একটা ধারনা আপনি ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছেন।"
অবন্তী বললো, "জ্বি, আমাকে গতকালই তা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।"
তাশফিন বললো, "ফাইন, তাহলে কাল থেকে শুরু করুন, প্রতিদিন বিকালের দিকে আপনাকে আমার কাছে সেই দিনের একটা ওভারঅল রিপোর্ট দিতে হবে, সেই সব রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আমি আর আপনি মিলে প্রতি উইকে একটা উইকলি রিভিউ করবো, যেটা কোম্পানীর হেড অফিসে যাবে সপ্তাহের শেষে।কাজেই একটু সিনসিয়ারলি করবেন সব কিছু, ঠিক আছে?"
অবন্তী ঘাড় কাত করে বললো, "অবশ্যই স্যার, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।"
তাশফিন বললো, "অনেক ধন্যবাদ, ওয়েলকাম টু দা জব, আজ তাহলে আসুন"
"থ্যাংক ইউ স্যার" বলে উঠে যাচ্ছিলো অবন্তী, তাশফিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, " কি কান্ড দেখুন তো! এতক্ষণ আপনার সাথে কথা বললাম, অথচ আপনার নামটাই জিজ্ঞাসা করা হলো না, নামটা ঝটপট বলে ফেলুন।"
অবন্তী হেসে বললো, "স্যার আমার ভালো নাম সাদিয়া মুস্তাফিজ, ডাক নাম অবন্তী, আপনি আমাকে সাদিয়া অথবা অবন্তী যে কোন নামেই ডাকতে পারেন।"
অবন্তীর নাম শুনে ভুরু কুঁচকে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তাশফিন হাসান।
...............................................................(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৩৮