আবির আস্তে আস্তে চোখ খুলতে শুরু করেছে। সূর্যের আলোটা তাকে ঠিক মতো চোখ খুলতে দিচ্ছে না, কারন আলোটার একটা অংশ এসে শুয়ে থাকা আবিরের ডান গাল আর ডান চোখটার উপর ভর করেছে। তারপরেও আবির কষ্ট করে চোখ মেললো। তার চারপাশে মানুষের কোলাহল, যানবাহনের আওয়াজ আর ট্রেনের হুইসেলের শব্দ। হুড়মুড় করে উঠে বসলো আবির। এ কি! এতো নিতাইগঞ্জ স্টেশন, গতরাতে সে এখানে এসেছিলো, বেঞ্চিটাও তো সেটাই--স্টেশন থেকে নামার পর যেখানে সে কিছুক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বসেছিলো গতকাল রাতে।কিন্তু এখানেই তো তার গতকালকের রাত থেমে ছিলো না। সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে সেই বুড়িকে, বুড়ির সাথে তার বাড়িতে যাওয়া, বুড়ির মেয়ে, তার ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া---হ্যাঁ তাইতো সবই তো স্পষ্ট মনে করতে পারছে সে। ধক্ করে উঠলো আবিরের বুক। সে তাহলে নিতাইগঞ্জ স্টেশনে আবার এলো কি করে? না কি গতকাল রাতের ঘটনাগুলো দুর্বল মস্তিষ্কের বানানো খেলা; স্বপ্ন? না কোন ভাবেই না , হতেই পারেনা, আবির স্পষ্টই মনে করতে পারছে-- বুড়ির মেয়েটার ছবি তুলতে গিয়ে তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা, কথাটা মনে হতেই আবির তার ব্যাগটা খুঁজতে লাগলো, নাহ্ ব্যাগটা কোথাও নেই। ব্যাগটাও উধাও, সব গেলো, তার ছবি আঁকার জিনিসপত্র, ক্যামেরা--সব হারিয়ে গেলো তাহলে?কিভাবেই বা হারালো, বুড়ির বাড়িতেই কি ব্যাগটা এখনো আছে? কিন্তু বুড়ির বাড়ি থেকেই বা সে কিভাবে এখানে এলো? আবিরের পৃথিবী দুলতে শুরু করেছে, সে ধীরে ধীরে ভাবনা-শূণ্য হয়ে পড়ছে। আবির খুব করে মনে করতে চেষ্টা করলো বুড়ির বাড়িটা ঠিক কোন পথে। কিন্তু কোন প্রকারেই সে মনে করতে পারলো না, গতকাল রাতের আঁধারে সে কোন পথে বুড়ির সাথে তার বাড়িতে গেলো তা কিছুতেই ঠাওরে উঠতে পারলো না আবির। এমন কি সে বুড়িটাকে একটাবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি জায়গাটার নাম। রাগে দুঃখে আবিরের ইচ্চে করছে একটা একটা করে তার সবগুলো চুল ছিড়ে ফেলতে। সে দুই তিনজন লোককে ডেকে জিজ্ঞেসও করলো ষাট সত্তর বছরের কোন বয়স্ক মহিলাকে তারা এই অঞ্চলে দেখেছে কিনা--তারা কেউই কিছু বলতে পারলো না। আবির কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, সে শুধু জানে একটা বিরাট রহস্যের মাঝে আটকে পড়েছে সে। এভাবে চিন্তা করতে করতে আর অন্য কোন উপায় না দেখে শেষে ঢাকাগামী একটা ট্রেনে করে ঢাকায় চলে গেলো আবির।
যদি এইখানেই ঘটনাটার সমাপ্তি হতো, তাহলে কোন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু আবিরের দুর্ভাগ্য, ঘটনাটা শাখা প্রশাখা মেলে আরও বিস্তৃত হতে শুরু করলো। ঢাকায় যাওয়ার পর আবির-- তার বাবা মা বন্ধুবান্ধব কাউকেই কিছু বলে নি ঘটনাটার ব্যাপারে, সে নিজেও আসলে ঘটনাটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে চাইনি। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ঢাকায় পৌঁছানোর পর ৩য় রাত থেকে বুড়ির মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো আবির। প্রতি রাতেই সে একটাই স্বপ্ন দেখে--বুড়ির মেয়েটা তার কাছে বসে আছে, সে মেয়েটাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছে, আর ওমনিই মেয়েটা হাওয়া মিলিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত মানুষের স্বপ্নগুলো অত বেশী স্পষ্ট হয় না, কিন্তু আবিরের বেলায় ঘটনা পুরো উল্টা ঘটলো, আবিরের কাছে মনে হতে লাগলো যেন পুরো স্বপ্নটাই তার চোখের সামনে ঘটছে। প্রতি রাতেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর পরই আসল কষ্টটা শুরু হয় আবিরের। সে প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করে, তার কঠিন রকমের খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসে এবং প্রবল শব্দে সে গোঙ্গাতে শুরু করে তখন। মজার ব্যাপার আরও আছে--ভোর রাতের দিকেই সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়, তার খিঁচুনি সেরে যায়,শরীরে জ্বর থাকে না এবং অন্য আট দশটা স্বাভাবিক মানুষরে মতোই ভোর রাতের দিকে তার খুব গাঢ় ঘুম হয়। এই সব তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও আবির খুব সাবধানেই সবার কাছে চেপে যায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে একদিন। আবিরের বাবা ডায়াবেটিসের রোগী। প্রায় রাতেই তাকে মাঝে মাঝে বাথরুমে যেতে হয়। একদিন তিনি আবিরের রুম থেকে গোঙ্গানির আয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলেন। তিনি আবিরের রুমের দরজায় আরো কিছুক্ষণ কান পেতে থাকলেন আসলেই কি হচ্ছে ভেতরে তা বুঝবার জন্য। ব্যাপার ঘটলো পুরো উল্টা। আবিরের বাবা মনে করলেন তার ছেলে নেশা করা শুরু করেছে। তিনি দুনিয়া মাথায় উঠিয়ে ফেললেন সে রাতে, আবিরের মাকে ডাক দিলেন সাথে সাথে এবং আবিরের দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কি শুরু করলেন। এতো ধাক্কাধাক্কিতে আবির সেই ঘোরের মধ্যেও এসে দরজা খুলতে বাধ্য হলো। আবিরের মা , বাবা দুইজনই আবিরকে দেখে ভড়কে গেলেন। পরে অনেক জোরাজুরির পরে আবিরের মুখ থেকে তারা নিতাইগঞ্জে ঘটে যাওয়া সমস্ত কাহিনী শুনলেন। এরপর তারা আর এক মুহূর্ত দেরী করলেন না। পরদিন সকাল বেলায়ই তারা ছেলেকে নিয়ে সাইকোলিজস্ট মিজানুর রহমানের চেম্বারে হাজির হলেন। মিজানুর রহমান বয়স্ক লোক, একটু পাগলাটেও বটে। তিনি আবিরের কাছ থেকে প্রথমে তার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি জানতে চাইলেন, আবিরের কি ভালো লাগে, কি ভালো লাগে না, আবিরের সখ, পছন্দ, অভ্যাস সব কিছুই নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনা করলেন তিনি। এরপরে গেলেন মূল কথায়। তিনি চোখ বন্ধ করে আবিরের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনলেন।নিতাইগঞ্জ স্টেশনে বুড়ির সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে, তার প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখা-- সব ঘটনাই তিনি শুনলেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে। এই সব শোনার পর একজন সাইকলজিস্ট যা বলার কথা তিনিও তাই বললেন।
মিজানুর রহমান ঠোঁটে একটা ছোট্ট হাসি ফুটিয়ে আবিরকে বললেন, "দেখো আবির, সমস্ত ঘটনাই তোমার মস্তিষ্কের দুর্বল নার্ভগুলো তৈরী করেছে। সেই রাতে তুমি এমনিতেই অনেক টায়ার্ড ছিলে। তার উপর স্টেশনটার ভূতূড়ে পরিবেশটা তোমার মস্তিষ্কের উপর ভালো প্রভাবই ফেলেছিলো। তুমি পুরো পরিবেশটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে এক ধরনের হেলুসিনেশনের মধ্যে চলে গিয়েছিলো এবং হতে পারে সেই অবস্থায় তুমি হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছিলে এবং তারপরেই তুমি ওরকম একটা আধি-ভৌতিক স্বপ্নে দেখতে শুরু করো।"
আবির তখন প্রবল প্রতিবাদ করে বললো," কিন্তু আমি যে মেয়েটার ছবি তুললাম, ছবিতে মেয়েটার ছবি ছাড়া অন্য সবকিছু দৃশ্যমান হওয়া-- এই ব্যাপারগুলোর তাহলে কি হবে?তাছাড়া আপনি চাইলে আমি কিন্তু কাগজে মেয়েটার একটা পোট্টেটও করে দিতে পারি।
মিজানুর রহমান নিঃশব্দে একটা সাদা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন আবিরের দিকে। আবির অবিশ্বাস্য দক্ষতায় মেয়েটা ছবি এঁকে ফেললো তৎক্ষনাৎ। ছবিটা দেখে মিজানুরও ঘাবড়ে গেলেন কিছুটা। ছবিতে যে মেয়েটাকে আঁকা হয়েছে তাকে অস্বাভাবিক রূপবতীই মনে হচ্ছে, কিন্তু তিনি ঘাবড়ালেন অন্য কারণে, কাউকে না দেখে এভাবে তৎক্ষনাৎ একটা ছবি আঁকা খুবই দুরহ ব্যাপার, কিন্তু আবির সেই দূরহ কাজটিই কিভাবে এতো নিপুণভবে করে ফেললো, তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে বলতে শুরু করলেন, "আবির শোন, মানুষের স্বপ্নগুলো বিক্ষিপ্ত অনেকগুলো ছোটখাটো বিষায়াদি নিয়ে গড়ে ওঠে। দেখা যায় এক যুগ আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সাথে গত কাল ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সমন্বয়ে একটা স্বপ্ন তৈরী হয়, আমরা মাঝেই মাঝেই এই ধরনের রোগী পাই। তোমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তা হলো-- খুব রূপবতী ধরনের কোন একটা মেয়েকে তুমি কোথাও হয়তো আগে দেখেছো, তার স্মৃতিটা তোমার মস্তিষ্ক ধরে রেখেছিলো। সময় তো সে তা উগড়ে দিয়েছে। এই মেয়েটাই তোমার স্বপ্নের কেন্দ্রিয় চরিত্রে হাজির হয়েছে। আর তোমার প্রিয় সখ হচ্ছে ছবি তোলা, ছবি তোলার ব্যাপারটাও তোমার স্বপ্নে চলে এসেছে, যেহেতু ছবি তোলা নিয়ে তুমি খুবই ফ্যানাটিক, তাই এই ব্যাপারটা সব সময়ই তোমার মাথায় ঘুর ঘুর করে।কাজেই এটা স্বপ্নে আসা একদমই অস্বাভাবিক না। তোমার ব্যাগের ব্যাপরেও ব্যাখ্যাটা সহজ--তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, ভোর হওয়ার সাথে সাথেই স্টেশনে লোক সমাগম বাড়তে থাকে, সেখান থেকেই কেউ হয়তো তোমার ব্যাগটা চুরি করে নিয়ে গেছে-- এই হচ্ছে আমার দৃষ্টিতে তোমার ঘটনার সার সংক্ষেপ।"
আবিরকে কোন ভাবেই দেখে মনে হলো না যে, সে মিজানুর রহমানের ব্যাখ্যায় সন্তূষ্ট। সে জানে সবগুলো ঘটনাই সত্যি। তার খালি মনে হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলীর কথা। মিসির আলী বাস্তবের কেউ হলে খুবই ভালো হতো--প্যারাসাইকলজির বিষয়বস্তু প্রয়োগ করে নিশ্চয়ই তিনি কোন না কোন সমাধান বের করে ফেলতেন, এই ভেবে আবির নিজের মনে মনেই কিছুক্ষণ হাসলো।
এরপরে যেটা হয়েছে, মিজানুর রহমান আবিরের বাব মাকে বললেন আবিরকে শীঘ্রই একটা বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য। যাতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটার স্মৃতি সে ভুলতে পারে। আবিরের বাবা মাও তাই করলেন। ছেলেকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিলেন। বিয়ের পর আবিরের দিন ভালোই কাটতে লাগলো তার স্ত্রীর সাথে। আবিরের স্বপ্ন দেখার পরিমানটাও একদম কমে আসলো, কাল ভদ্রে যদিও সে স্বপ্নটা দেখতো তবুও সেই স্বপ্নের কথা আবির কিংবা তার মা কেউই আবিরের স্ত্রীকে বলে নি এবং আগের মতো ভয়াবহ অবস্থাতেও আবিরকে আর পড়তে হয়নি ইতিমধ্যে আবিরের বিয়ের বয়স দুই বছর হয়ে গেলো। এসময় তাদের কোল জুড়ে একটা মেয়ে সন্তানও আসলো। আবির মেয়েটার নাম রাখলো ফারিয়া। ফারিয়াকে নিয়ে আবিরের দিন ভালোই কাটতে লাগলো।একসময় বুড়ির সেই মেয়েটা আর স্বপ্নটার কথা সে পুরা ভুলেই গেলো।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটলো এর কিছুদিন পরই। ফারিয়ার বয়স ছয় মাস তখন। ফারিয়াকে আবিরের কাছে রেখে তার স্ত্রী গেলো মায়ের বাড়িতে। ফারিয়াকে নিয়ে আবির খেলছে। খেলতে খেলতেই ফারিয়ার মুখের দিকে ভালো করে তাকালো আবির, তাকিয়েই চমকে গেলো। ছয় মাসের দিকে সাধারণত একটা শিশুর মুখে তার নিজস্ব চেহারার ছাপ পড়তে শুরু করে, যদিও খুব খেয়াল করে না দেখলে তা বোঝা সম্ভব না।আবির খুব গভীর ভাবেই এক দৃষ্টিতে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। চমকে উঠলো আবির। সে কাঁপতে শুরু করলো, তার হার্টের বিট মনে হয় বিদ্যুতের বেগে ওঠানামা করতে আরম্ভ করলো। সে দৌড়ে চলে গেলো তার বুক শেল্ফটার কাছে। ২য় তাকে রাখা একটা ফাইল বের করলো সে। ফাইলটার মধ্য থেকে সে দ্রুত গতিতে সেই কাগজটা বের করলো, যেটাতে সে বুড়ির মেয়ের ছবিটা সাইকলজিস্ট মিজানুরের চেম্বারে বসে এঁকে ছিলো। ছবিটা বের করে সে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলো না, সে বুঝতে পারলো না আদৌ সে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে কিনা। সে তাড়াহুড়া করে ফারিয়াকে কোলে নিলো, আর তার হাতে সেই কাগজটা নিয়ে দৌড়ে চলে আসলো মার রুমে। আবিরের মা শুয়ে ছিলেন, ছেলেকে এমন অস্থির দেখে তিনি লাফ দিয়ে বসে গেলেন। আবির কিছুই বললো না, শুধু মায়ের কাছে গিয়ে তার চোখের সামনে কাগজটা ধরলো, আর ফারিয়াকে বসালো মায়ের খাটের উপর। আবিরের মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে একবার তাকান, আরেকবার তাকান তার নাতনি ফারিয়ার দিকে, একি! এ কি করে সম্ভব! তিনি নিজেই নিজের মনের অজান্তে বলে উঠলেন। আবির আর তার মা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ফারিয়ার দিকে--কাগজে আঁকা মেয়েটার সাথে ফারিয়ার চেহারার কি অদ্ভুত, অস্বাভাবিক মিল!
*****( গল্পটির শেষ এখানেই। গল্পটি শেষ হওয়ার পর প্রথম অবস্থায় আমি বিশ্লেষণধর্মী একটা প্যারা দিয়েছিলাম, কিন্তু পাঠকদের মতামতের ভিত্তিতে প্যরাটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে)।