ঢাকার আকাশে আজ অনেক মেঘ। সমস্ত আকাশ জুড়েই মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।মেঘগুলো যে শুধুই এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে--তা কিন্তু নয়, ওরা ঘুরছে ছোট ছোট দলবদ্ধ হয়ে; থোকায় থোকায়। মেঘগুলোর এই ঘোরাফেরার মাঝে একটা ছন্দবদ্ধ ব্যাপারও দেখা যাচ্ছে-- আকাশের একটা জায়গা থেকে মেঘেদের একটা দল সরে যাওয়ার সাথে সাথেই সেই জায়গা এসে দখল করছে অন্য আরেকটা মেঘ-দল, এভাবেই থেকে থেকে কিছুক্ষণ পরপরই মেঘ-দলগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে আপন তালে। অবশ্য মেঘেদের এই ছন্দবদ্ধ ঘোরাফেরায় ঢাকাবাসীর খুব একটা মনযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। চিরন্তন ব্যস্ত-নগরী ঢাকা তার যান্ত্রিকতার সমস্ত উত্তাপ উগড়ে দিয়েই প্রতিদিনকার মতো যাত্রা শুরু করেছে। যান্ত্রিক মানুষগুলোও সেই উত্তাপে তেঁতেঁ উঠে অবিমৃষ্যকারীর মতো ছুটতে শুরু করেছে যে যার মতো।
নীতু অবশ্য আজ এই ছুটে চলাদের দলে নেই, আজকে তাকে ডিপার্টমেন্টে যেতে হবেনা, অন্য কোন প্রথাগত জরূরী কাজও আজ তার নেই। সে কিছুক্ষন আগে ঘুম থেকে উঠেছে, খুব আয়েশী ভঙ্গিতে হাত-মুখ ধুয়ে গভীর আনন্দ নিয়ে নিজের জন্য ধোঁয়া-ওঠা এক মগ কফি বানিয়েছে সে, নীতু আবার ধোঁয়া ছাড়া কফি খেতে পারেনা, তার কাছে ধোঁয়া--বিহীন কফিকে কেমন যেন প্রাণহীন প্রাণহীন মনে হয়। ধোঁয়া-ওঠা সেই কফির মগটা নিয়ে নীতু এখন বসে আছে তার বিশাল বারান্দাটার এক কোণে। সে তাকিয়ে আছে ধানমন্ডি লেকের পানির দিকে। ধানমন্ডি লেকটা নীতুদের বাসার ঠিক পাশেই। তার বারান্দাটা ধানমন্ডি লেক-ফেসিং। সে মাঝে মধ্যেই অবসর সময়ে বারান্দাটায় এসে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাঝে মাঝে এই লেকটার পানির মতো হতে ইচ্ছে করে। ব্যস্ত শহরের হাজার রকম ব্যস্তার মাঝেও লেকের পানিগুলো কেমন নিরালায় টলহীন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, কতো মানুষ কতো দিকে ছুটে যাচ্ছে, অথচ লেকের পানিগুলোর কোন দিকে ছুটে যাওয়ার কোন তাড়া নেই; যেন বৃদ্ধ, মৌন এক ঋষী পার্থিব সকল কর্মকান্ডের ঊর্ধ্বে গিয়ে মহা-জাগতিক কোন বিষয় নিয়ে ধ্যানে মগ্ন আছে। নীতু লেকের পানি দেখে দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আর ভাবে--মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, অথচ নিজের রূপ বদলানোর মতো বিশাল ক্ষমতাটা তাকে দেয়া হয়নি। যদি দেয়া হতো, তাহলে যে কোনদিনই নীতু মানুষের রূপটা বদল করে লেকের পানি হয়ে যেতো।
এখন বাজে সকাল দশটা। নীতুর জন্য আজকে একটা বিশেষ দিন। নীতুর যে আজ কোন ব্যস্ততা নেই, তার পিছনে অবশ্য এই "বিশেষ" ব্যাপারটাও কম বেশী দায়ী। এই বিশেষ দিনটাতে সে সর্বাত্মক চেষ্টা করে অন্য কোন কাজ না রাখার জন্য। কারণ আজ শফিকের জন্মদিন। কিছুক্ষণ পরেই সে শফিকের সাথে দেখা করার জন্য বের হবে। শফিকের সাথে নীতুর সম্পর্কের শুরু হয়েছিলো আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগে শফিকের এমনই এক জন্মদিনে। ওদের প্রথম দেখাও হয় সেই দিনই। সেই দেখা হওয়াটাও ছিলো যথেষ্টই আকস্মিক এবং গল্পের মতো। নীতু বেলী রোডের একটা শাড়ীর দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ি দেখছিলো, এমন সময়ই মোটামুটি গড়নের একটা ছেলে হুট করে কোথা থেকে এসে তার পাশে দাড়ালো, নীতু তখন পর্যন্তও খেয়াল করেনি ছেলেটাকে। নীতু খেয়াল করলো তখনই, যখন ছেলেটা অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, "excuse me একটু শুনবেন?"
মাথা তুলে তাকালো নীতু। সে দেখলো "না লম্বা না খাটো" ধরনের একটা মোটামুটি স্বাস্থ্যবান ছেলে অনন্ত মায়া ভর্তি এক মুখ এবং গভীর কৌতূহলী এক জোড়া চোখ নিয়ে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নীতু মুখ গম্ভীর করে বললো, "জি বলুন।"
ছেলেটা বললো, "দেখুন আমার নাম শফিক, আমাকে একটু হেল্প করবেন প্লিজ।"
ভুরু কুঁচকে নীতু বললো, "বলুন, কি হেল্প করতে হবে।"
শফিক বলতে শুরু করলো-- "আজকে আমার জন্মদিন, তো আমি ঠিক করেছি যে এই জন্মদিনে আমি আমার মাকে একটা শাড়ি gift করবো, কারণ মা আমাকে এতো কষ্ট করে জন্ম দিয়েছেন তাকেই তো সবার আগে একটা gift দেয়া উচিৎ, তাই না? আপনি কি বলেন?"
শফিকের এমন হঠাৎ প্রশ্নে কিছুটা হতচকিয়ে গেলো নীতু, কিন্তু পরক্ষণেই
নিজেকে সামলে নিয়ে নীতু জবাব দিলো, "হ্যাঁ তা তো ঠিকই, কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এই কাজে আমাকে আপনার কি দরকার, এই দোকানে তো অনেক শাড়িই আছে, একটা পছন্দ করে আপনার মায়ের জন্য নিয়ে যান, ব্যাস হয়ে গেল।"
শফিক তখন ঘাড় নাড়িয়ে বললো, "না ব্যাস হয়ে যায়নি। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আমি কোনদিন এসব শাড়িটাড়ি কিনি নি। তাই পছন্দও করতে পারছি না, মায়ের জন্য কোনটা নিবো। তাছাড়া এভাবে একলা একলা আমি একটা ছেলেমানুষ এতো গুলো নারীর ভিড়ে এই শাড়ীর দোকানে হাঁটছি--এই ব্যাপারটাও আমার জন্য যথেষ্টই অস্বস্তিকর। তাই আমি বলছিলাম কি আপনি যদি আমাকে মায়ের শাড়িটা পছন্দ করার ব্যাপারে একটু হেল্প করতেন, তাতে আমার মায়ের শাড়িটাও কেনা হয়ে যেতো আর এই দোকানেরও সবাই ভাবতো, আমি হয়তো আপনার সাথেই শপিং করতে এসেছি।"
শফিকের এমন সব কথা শুনে নীতু বিশ ত্রিশ সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলো শফিকের দিকে, তারপর ঠোঁটের কোণে আলতো একটা হাসি ঝুলিয়ে বললো, "তা এই দোকানের অন্য সবাইকে ফেলে আপনি আমাকে দিয়েই কেন শাড়িটা কেনাতে চান?"
শফিক বললো, "আসলে আমি অনেক খেয়াল করে দেখেছি--এই দোকানে অন্য যেসব মহিলারা আছেন, তারা সবাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হবেন, তাই তাদের কাছে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না, অনেক ভবে চিন্তে তাই অবশেষ আপনাকেই আমার সমবয়েসীর মতো মনে হয়েছে, সমবয়েসী না হলেও আমরা তো অন্তত কাছাকাছি বয়সের হবোই। দেখুন, আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছি, আপনি আমাকে ফেরাবেন না, প্লিজ।"
এরপর নীতুর আর কিছুই বলার ছিলো না। অবশেষে শফিক আর নীতু শফিকের মায়ের জন্য পছন্দ করে একটা শাড়ি কিনেছিলো। তারপর বেলী-রোডের একটা খাওয়ার দোকানে বসে পরস্পরের ব্যাপারে আরও অনেক কিছুই জেনেছিলো ওরা। সেই থেকেই তাদের সম্পর্কের শুরু।
নীতু এখন গভীর মনযোগ দিয়ে রেডী হচ্ছে শফিকের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য। সে একটা হালকা বেগুনী রংয়ের শাড়ি পরেছে।শফিকের আবার শাড়ি খুবই পছন্দ, তাই শফিকের প্রতি জন্মদিনেই নীতু শাড়ি পরে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে সে বেগুনী রঙয়ের একটা টিপ পরেছে, ঠোঁটে বেগুনী রংয়ের লিপ-স্টিকও লাগিয়েছে। চোখে গাঢ় করে কাজলও লাগিয়েছে সে, শফিক একদিন তাকে বলেছিলো--কাজল দিলে নাকি নীতুকে স্বর্গের অপ্সরীর মতো লাগে। নীতু তখন হেসে বলেছিলো, তুমি দেখেছো নাকি স্বর্গের অপ্সরীদের? শফিক বলেছিলো--না, দেখিনি; তাতে কি; তোমাকে দেখেই তাদের রূপের ব্যাপারে একটা ধারণা নিয়ে নিচ্ছি, এর চেয়ে বেশী রূপ তাদের আছে বলে তো আমার মনে হয় না।সেদিন থেকে নীতু যত্ন নিয়ে চোখে কাজল দেয়।
এখন বাজে সকাল সাড়ে এগারটা। নীতু বাসা থেকে বের হয়েছে। বেলী- রোড যাবে সে। সেখানেই শফিকের সাথে তার দেখা হওয়ার কথা। শফিকের প্রতি জন্মদিনেই নীতু শফিকের সাথে দেখা করতে যায় বেলীরোডের সেই খাওয়ার দোকানটাতে, যেখানে ঠিক পাঁছ বছর আগে সেই আকস্মিক সাক্ষাতের পর তারা পরস্পরকে জেনে ছিলো।
নীতু যখন বাসা থেকে বের হয়, তখনও বৃষ্টি ছিলো না, এখন একটু ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এই বৃষ্টির মাঝেও সে বেলীরোডের একটা ফুলের দোকানে নেমেছে। সেখান থাকে গুনে গুনে শফিকের জন্য ঠিক ২৯টা গোলাপ ফুল কিনেছে। এই ধরনের বেয়ারা সংখ্যার গোলাপ কিনার কারণ হচ্ছে--আজ শফিকের ২৯ তম জন্মদিন। তাই শফিকের জন্য ২৯টা গোলাপ ফুল।এভাবে শফিকের প্রতি জন্মদিনেই নীতু শফিকের জন্য একটা করে গোলাপ বেশী কেনে আগের জন্মদিনের চেয়ে। গোলাপ কিনার পর সে একটা কেকের দোকানে ঢুকে দেড় পাউন্ডের একটা কেক কিনেছে। এই কাজটাও সে প্রতিবারেই করে। ওর চোখের সামনে শফিক কেক কাটছে, এটা দেখতেই নীতুর যত আনন্দ।
নীতু এখন বসে আছে বেলীরোডের সেই খাওয়ার দোকানটাতে। শফিকের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন বাজে দুপুর ২টা। সে এখানে এসেছে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে। কিন্তু শফিকের কোন দেখা নেই। অবশ্য শফিক যে এখনও আসছে না, তাতে নীতুকে খুব একটা রাগান্বিত বা চিন্তিতও মনে হচ্ছে না। সে দোকানের একটা কোণায় বসে নিথর চোখে দোকানের প্রবেশ পথের পুরু গ্লাসটার মধ্য দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর শফিকের আসার প্রহর গুনছে।
বেলা বাড়ছে, ঢাকার আকাশে মেঘ সরে গিয়ে সূর্যের এক চিলতে হাসি দেখা যাচ্ছে, নীতু এখনও আগের জায়গাতেই বসে আছে। শফিক এখনও আসে নি। শফিকের অবশ্য আসার কথাও নয়। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে শফিকের এমনই এক জন্মদিনে তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিলো। শফিক দেখা করার জন্য ঘর থেক বেরও হয়েছিলো। কিন্তু আসার পথে এক ভয়াবহ সড়ক-দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শফিকের আর নীতুর সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। কারণ শফিক সেই দিনই নীতুকে না বলে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে গিয়েছিলো। সেই থেক নীতু আজও শফিকের প্রতি জন্মদিনে এমন আয়োজন করে ফুল , কেক নিয়ে সেই খাওয়ার দোকানটায় এসে বসে থাকে। নীতু বিশ্বাস করতে ভালোবাসে-- শফিকের এক জন্মদিনে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো, এমনই এক জন্মদিনে শফিক তাকে না বলে হারিয়ে গিয়েছিলো, হয়তো এমনই আরেক জন্মদিনে শফিক আবার ফিরে আসবে তার খোঁজে ঠিক এই খাওয়ার দোকানটায়, যেখানে সে এখন ফুল আর কেক নিয়ে শফিকের জন্য অপেক্ষা করছে। সে অবচেতন মনে বিশ্বাস করে, যে কোন মুহূর্তেই হয়তো শফিক এসে খুব সহজ ভঙ্গিতে তাকে বলবে-- "আর বোলো না, রাস্তায় এতো জ্যাম, ঘামে একদম ভিজে যাচ্ছি, আগে একটু ঠান্ডা হয়ে নিই, তারপরই না হয় আমাকে বকা দিও দেরী করে আসার জন্য।"
নীতু তাই অপেক্ষা করে।
আমরা জানি শফিক আর কখনোই ফিরবে না। হয়তো নীতুর ভেতের নীতুটাও জানে শফিক আর ফিরবে না। তবু নীতু অপেক্ষা করে। নীতু না হয় অপেক্ষাই করুক শফিকের জন্য। অপেক্ষার চেয়ে সুন্দর আর কীইবা আছে।পরস্পরের কাছে আসার মধ্য দিয়ে ভালোবাসার জয়গান যতটুকু না ধ্বনিত হয়, তার চেয়ে হাজার গুণে বেশী ধ্বনিত হয় পরস্পেরের কাছে আসার আগের মুহূর্তগুলোতে, অপেক্ষার মুহূর্তগুলোতে। অপেক্ষার মাঝেই তো বড় অলক্ষ্যেই, বড় নিভৃতেই ধীরে ধীরে ফুটে উঠে ভালোবাসার রাশি রাশি অথৈ নীল, নীল-পদ্ম।