কবিতার সাথে আমার কখনোই খুব একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলনা। মাঝেমাঝে জগত বিখ্যাত কবিদের জনপ্রিয় কিছু কবিতা পড়তাম। খুব একটা আগ্রহ নিয়ে যে পড়তাম তাও না।আমার আগ্রহ ছিল গল্পে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যখন কিছু লিখতে বসতাম, সেটা কিভাবে যেন কবিতার মত কিছু একটা হয়ে যেত! হয়তো আমার অবচেতন মন সেটাই চাইত।তারপর অনেকদিন সে চর্চা থেকেও আমি বিচ্ছিন্ন ছিলাম।
যখন ব্লগে আসি তখন ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞান এসব নিয়ে খুব পড়ালেখা করতাম। সেসব নিয়েই লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু তখন এ দেশে একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করা হচ্ছিল। প্রশাসন নির্বিকার।অপর দিকে ছিল ৫৭ ধারার আতংক।সে সময়টা আমার জন্য ছিল কনফিউজিং এবং বিরক্তিকর। এমন একটা সময়ে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে একজন ব্লগারের লেখা পড়তে শুরু করি।ব্লগারের নাম শায়মা হক। তিনি যেসব বিষয় নিয়ে লিখেন সেসব বিষয়ে আমার কখনোই তেমন একটা আগ্রহ ছিলনা। তবে আমি বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করি শায়মা আপুর লেখা পড়তে ভালো লাগছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমি খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ। কিছুদনের মধ্যেই বুঝে গেলাম আপুর সেন্স অব হিউমার খুব ভালো। তিনি সবসময় গাম্ভীর্যের মুখোশ পড়ে থাকেননা। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তিনি যা কিছুই লিখেন না কেন সেটাই খুব প্রানবন্ত হয়ে যায়। হোক সেটা কোন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে পোস্ট, কবিতা অথবা মন্তব্য।
এভাবেই আমি একসময় শায়মা আপুর কবিতা পড়া শুরু করি। আমি মুগ্ধ হই। এবং তার চেয়েও বেশী বিস্মিত হই এটা ভেবে যে আমি কেন মুগ্ধ হচ্ছি? আজ সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার একটা চেষ্টা করব। উত্তরটা আসলে আমি নিজেকেই দেব। আর আপনাদের সাথে সেটা শেয়ার করব।
এই মুহূর্তে আমার হাতে আছে একটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটির নাম, “ইচ্ছেগুলো উড়িয়ে দিলাম প্রজাপতির পাখায়”। শায়মা আপুর এই বইটি এবার বইমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে আশিটি কবিতা আছে। আর এ কবিতাগুলোর পরতে পরতে আছে জানা অজানা অনেক রকম গল্প।হুমম.........প্রথমেই বলেছিলাম আমি গল্প পছন্দ করি। আর রহস্যও পছন্দ করি। শায়মা আপুর কবিতায় দুটোর দেখাই পেয়েছি। যাইহোক, প্রাথমিক আলাপ শেষ। এবার মূল আলোচনা(শায়মা আপুর ভাষ্যমতে আঁতলামি) শুরু করা যাক!
হাতছানিতে ডাক দিয়ে যায়......
“গভীর রাতে চমকানো দুঃস্বপ্ন দেখে,
হুড়মুড়িয়ে মায়ের ঘরে, জায়গা নিতে,
আজো কি তুই দৌড়ে পালাস?
পড়িস কি তুই আজো তেমন
ভূত তাড়ানো মন্ত্রগুলো চক্ষুমুদে, বিড়বিড়িয়ে?”
খুব সহজ কিছু লাইন। শব্দগুলোও খুব পরিচিত। লাইনগুলো একটানে পড়ে ফেলা যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে পড়ে আরাম পাওয়া যায়। ব্রেনে আলাদা কোন চাপ সৃষ্টি করেনা। কিন্তু পড়ার পর খুব সহজেই একটা ঘোরের মাঝে চলে যাওয়া যায়। উপরে উল্লেখিত কবিতার লাইনগুলো এ বইয়ের প্রথম কবিতা থেকে নেওয়া। লাইনগুলো পড়লেই যে কেউ খুব সহজে তার ছেলেবেলায় ফিরে যেতে পারবে। শুধু তাই না, ছেলেবেলার ফেলে আসা সময়টার জন্য তার মাঝে একধরনের হাহাকার জন্ম নেবে!
এ বইয়ের নস্টালজিয়া পর্বের সব কবিতাগুলোই এমন। এমনকি আমি যদি কবিতার মাঝ থেকেও কিছু লাইন পড়ি তবে সেসব লাইনগুলোও খুব অর্থবহ হয়ে ওঠে।
“হে মুগ্ধবালক!
কি করে বুঝাই তোকে এ যে মোহমায়া
বয়ঃসন্ধির ক্ষণকাল ছুয়ে এক ঐন্দ্রজালিক ঘোর!
জানি, কেটে যাবে মায়াজাল
ভুলে যাবে সবই একদিন বিস্মৃতির অতল কারাগারে
তবুও ব্যথিত সে কবি
আজ অনড় অচল, ভাষ্য অবিচল!”
কনিষ্ঠ প্রেমিক কবিতার কিছু লাইন। মূল কবিতার সাথে লাইনগুলো এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন করলেও কবিতার মূল নির্যাস পাওয়া যায়। এটা শায়মা আপুর কবিতার একটা অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। তাই কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা অদ্ভুত হারমনি থাকে। পড়ার সময় খুব একটা ভাবতে হয়না।কিন্তু কবিতার ভেতর যে গল্প আছে, সে গল্পটা খুব গভীর ভাবেই স্পর্শ করে!
“কত নতুন দিনের কাজে
কত নতুন স্মৃতির মাঝে,
নীরব প্রহর, মুখখানি তোর আমার চোখে ভাসে
তোকে ভুলতে গিয়েও এ মন আবার তোকেই ভালোবাসে।“
চার লাইনে কত সহজেই না অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। ঠিক একই কথা যদি আমি বলতে যেতাম এত সহজ এবং স্পষ্ট ভাবে কখনোই বলতে পারতাম না। শায়মা আপু এ কাজটা চমৎকার ভাবে করতে পারেন। তার অধিকাংশ কবিতায় খুব অল্প কথায় সহজ সরল ভাবে তিনি গল্প বলতে পারেন। এমনকি মাঝেমাঝে মনে হয় অনুভুতিগুলোও খুব দৃশ্যমান।
মন দিয়ে মন ছোঁয়াছুঁইয়ির খেলা
“সেসব দিনগুলোয়
যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিলো না আমাদের
শুধু ছিলো মন দিয়ে মন ছোঁয়াছুঁইয়ির খেলা
মনে মনে কথা বলা বা অকারণ অভিমানে
দূরে ছুঁড়ে ফেলা!”
আমরা এখন প্রেম পর্বে আছি। যদিও শায়মা আপুর সব কবিতাকেই আমার প্রেমের কবিতা মনে হয়। বিশেষ করে প্রেম পর্ব এবং অভিমান পর্বের কবিতাগুলোর মধ্যে পার্থক্য খুব সুক্ষ। কারন প্রেম কিংবা অভিমান দুটো জিনিসই কবিতাগুলোয় একে অপরের সাথে মিশে আছে। তবে বুঝাই যাচ্ছে এ পর্বের কবিতাগুলোর কিছু আলাদা বিশেষত্ব আছে।
প্রেম আসলে কী? আমার ধারনা এ প্রশ্নের কোন সার্বজনীন উত্তর নেই। তবে শায়মা আপুর কবিতা পড়ে এক কথায় বলে ফেলা যায়, প্রেম হচ্ছে মন দিয়ে মন ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা! এ পর্বের অধিকাংশ কবিতাতেই আমরা এমন খেলার দেখা পাব।
“মায়ার শেকল পরিয়ে যতন চুপটি করে
লুকিয়ে তারে রাখতে পারে......
নাম না জানা অচিনপাখি, সাধ্য আছে
আমার কি তার?
কোন বাঁধনে বাঁধবো তোরে?
তার কেঁটেছে আমার খাঁচার
বহুকালের পথের ধারে......”
ভালোবাসার মানুষটিকে যদি কাছে পাওয়া যেত বা তার সাথে কিছু সময় কাটানো যেত তবে কেমন হত সে সময়টা।এসব নিয়ে আমাদের সবার মাঝেই একধরনের স্বপ্ন কাজ করে। যে স্বপ্নের পথে কঠিন বাস্তব আমাদের যেতে দেয়না। হয়তো ভালোবাসার মানুষটা আমাদের পাশেই আছে।তবুও লক্ষ যোজন দূর! তবুও আমরা স্বপ্ন দেখে যাই! আমরা আমাদের কল্পনার ভেতর অন্য কোন জগত সৃষ্টি করে ফেলি। শায়মা আপুর প্রেমের কবিতাগুলোয় আমরা এমন জগতের দেখা পাব। সে জগতে আমরা খুব সহজেই ঢুকে যেতে পারব। কবির কাল্পনিক জগতের সে ঘোর আমাদেরকে খুব সহজেই স্পর্শ করে ফেলবে। কবিতা পড়ে ফেলার পর মনে হবে আমরা আসলে খুব অল্প সময়ের জন্য খুব পরিচিত একটা জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।
প্রেম পর্ব এবং অভিমান পর্বের কবিতাগুলোয় আমার জন্য চমক ছিল। প্রেমের সাথে কামনার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। খুব গভীরে গেলে একের থেকে অপরকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না। তবে শায়মা আপুর প্রেমের কবিতায় কামনার ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্ম ভাবে মূল কবিতার সাথে মিশে থাকে।কিন্তু আমি অবাক হয়েছি অন্য কারনে। কারন কিছু কবিতায় একজন প্রেমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা প্রকাশ করা হয়েছে! চমকটা এখানেই।শায়মা আপু এধরনের কবিতা নিয়ে ব্লগেই এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।
ব্লগে আপুর আরো কিছু এক্সপেরিমেন্টাল কাজ আছে যা তিনি এ বইয়ে প্রকাশ করে দিয়েছেন। তিনি ধাঁধাঁ সৃষ্টি করতে পছন্দ করেন। আবার নিজেই সেটার উত্তর দিয়ে দেন। কবিতা দিয়েই তিনি সেটা সৃষ্টি করেছিলেন। আবার কবিতা দিয়েই উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। আর কিছু বলতে চাচ্ছিনা। বাকিটা বুঝতে হলে বইটা পড়তে হবে। বরং শায়মা আপুর কবিতার ভাষায় বলা যাক,
“আমার বিস্ময়গুলি আমি প্রত্যহ বুনে চলি,
নক্সিকাঁথার জমিনে;
সোনামুখী সুই আর রঙ্গিন সুতোর ভাঁজে
লাল নিল, সবুজ নক্সাগুলি,
ফুঁড়ে ফুঁড়ে তুলি!”
খোকা ভাই
“পরম মমতায়, যতনে আর ভালোবাসায়
আমি সাজিয়ে রাখলাম তোমাকে
আমার প্রিয় পুতুলের বাক্সে।“
এ ব্লগের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র হচ্ছে খোকা ভাই। তবে তিনি কোন ব্লগার নন। খোকা ভাই হচ্ছেন কবিতার চরিত্র। খোকা ভাই সিরিজের সবগুলো কবিতা এ বইয়ে আছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার মনে হলো চমৎকার একটা গল্প পড়ে ফেলেছি। আবার কবিতা পড়ার স্বাদও পেয়েছি।কবি পরম মমতায় খোকা ভাই নামক একজনকে তার প্রিয় পুতুল বাক্সে রেখে দিয়েছেন। আমার কাছে খোকা ভাই সিরিজটাকেই সে বাক্স বলে মনে হলো।
পরিশেষে
ব্লগে শায়মা আপুর লেখা আমি অনেক পড়েছি। ব্লগে আপুর সাথে অনেক আড্ডাও দিয়েছি। শায়মা আপুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এ ব্লগে বেশ কিছু কবিতা লেখার অপচেষ্টা করেছি।সেগুলো কবিতা হোক বা না হোক আমি সেসব লিখে যে আনন্দ পেয়েছি তার কোন তুলনা হয়না। “ইচ্ছেগুলো উড়িয়ে দিলাম প্রজাপতির পাখায়” বইটিতে প্রকাশিত আশিটি কবিতা আমাকে এক অন্য জগতের গল্পের সন্ধান দিয়েছে। যে জগত আমার খুব কাছেই ছিল। কিন্তু কখনো দেখা হয়নি। শায়মা আপুর কবিতাগুলো পড়ে সে জগত থেকে আমি ভ্রমন করে এসেছি। সে জগতের, সে জগতের গল্পগুলোর স্পর্শ আমার মনে লেগে আছে, লেগে থাকবে!
কাছে, খুব কাছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়
শব্দ থেকে জন্ম নেওয়া অপলক সুখ!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৪