শিকার
১
কদম আলীর মাথা ঘুরাচ্ছে। ঘাড়ে হাত বুলাচ্ছে সে। তবে তাতে ঘাড়ে ব্যথা কমছে না। বরং আরো বেড়ে যাচ্ছে। বমি আসছে কদম আলীর। কদম আলী প্রচণ্ড রাগ নিয়ে জ্বলন্ত সূর্যটাকে গালি দেয়। সূর্য তাতে নির্লিপ্তই থাকে। মানুষের মামা বাড়ির আবদার শোনার সময় নেই সূর্যের। সে তার মত করেই শহরের বুকে আগুন ঢালতে থাকে। সে উত্তাপে পুড়তে থাকে কংক্রিটের শহর। পুড়তে থাকে কদম আলীর শরীর। রক্তচাপ বাড়তে থাকে। সেটারও একটা সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করলেই মারা যাবে সে। যদিও কদম এতসব বুঝে না। সে বুঝে তার খারাপ লাগছে। সে বুঝে যেভাবেই হোক তাকে বেঁচে থাকতে হবে। যদি বেঁচে থাকে তবে রাতে নিজের খুপরিতে ফিরতে পারবে। ভাত খেয়ে যদি শক্তি থাকে তবে বউয়ের শরীরে ডুব দেবে সে। যদিও আগের মত আর ভালো লাগে না তার। তবুও এ মধ্যবয়সেও কয়েক মিনিটের সে সময়টাকেই তার খুব জীবন্ত মনে হয়। ভাবতেই মনে জোড় পায় কদম। তীব্র রোদকে উপেক্ষা করে সে বিড়ি ধরায়।
বিড়ি যখন অর্ধেক পুড়ে নিঃশেষ হওয়ার অপেক্ষায়, তখন কদম একটা ক্ষেপ পেয়ে যায়। গন্তব্য টিএসসি। বিড়ি ফেলে দেবে কিনা এটা নিয়ে তার দ্বিধা হয়। মেয়ে যাত্রী হলেই কদমের মধ্যে এ দ্বিধা কাজ করে। তবে কদমের মাথায় আজ বিদ্রোহের ভূত চেপেছে। সে বিড়ি না ফেলেই রিক্সার প্যাডেলে চাপ দেয়। আজিমপুর কবরস্তান থেকে টিএসসি যেতে বেশী সময় লাগবেনা। কিন্তু এ পথটাকেই আজ তার কাছে খুব দীর্ঘ মনে হয়। এটাই তার জীবনের লড়াই। এই একটার পর একটা ক্ষেপ। সব মিলে সফল হলে সে তার এক রুমের খুপরিতে ফিরে যেতে পারে। মনে খুব আনন্দ বা দুঃখ এসে ভর করলে মন্টুদের গাঁজার আসরে মাঝে মাঝে দম নিতে যায়। নাহয় মরার মত ঘুমায়। কদম আলীর সারাদিনের যে লড়াই তার পুরুস্কার হচ্ছে ভাত, নারী, গাঁজা এবং ঘুম। সে রিক্সা নিয়ে যখন পলাশীর মোড় ক্রস করছে তখন বুঝতে পারে তার রিক্সায় বসে থাকা মেয়েটা কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা জানার কোন আগ্রহ হয়না কদমের। প্রতিদিন অনেক মানুষ তার রিক্সায় ওঠে। সে সময়টায় ওদের যাপিত জীবনের কিছু গল্পের আভাস পায় কদম। ওদের কথায়, চোখে মুখে লেগে থাকা উচ্ছাস কিংবা ক্লান্তিতে লেগে থাকে সে গল্প। সে গল্পগুলোর কোন শব্দ নেই। ভাষা নেই। ব্যাকরণ নেই।
তবে মাঝেমাঝে তার রিক্সায় বসে থাকা মানুষগুলো এক অদ্ভুত উপায়ে কদমকে স্পর্শ করে। তখন তাদের রাগ, ভালোবাসা, ভয়, শিহরন এসব কিছু সময়ের জন্য কদমকে আঘাত করে। আক্রান্ত করে। যেমন একবার একলোক ফোনে তার ছেলেকে নিয়ে কথা বলছিল। ছেলেটা বখাটে হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে মানুষটার কণ্ঠে যে হতাশা, আতংক এবং ভয় ছিল তা কদম অনুভব করতে পেরেছিল। তার নিজের ছেলের কথা মনে হচ্ছিল। চুরির অপরাধে ছেলেটাকে মেরেই ফেলত। কদম সেবার নেতাদের হাত পা ধরে ছেলেটাকে বাঁচিয়েছিল।
মাঝেমাঝে তার রিক্সায় বসে থাকা প্রেমিক প্রেমিকারা কদমকে অন্য রকম এক সুখ দেয়। যখন কোন ছেলে মেয়ের শরীরে হাত দেয়, কদম সেটা বুঝতে পারে। তখন তার মনে হয় এই হাতটা আসলে তার নিজেরই হাত। এটা এমন এক সুখ যা সখিনার মাঝেও সে খুঁজে পায়না। এমন নানা ধরনের সুখ এবং অসুখ নিয়েই কদম আলী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিক্সা চালিয়ে যায়।
কদম আলীর তীব্র একটা ইচ্ছা আছে। এই ইচ্ছাটা সে খুব সযতনে নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। একদিন সে তার সেই গোপন ইচ্ছেটা পূরণ করবে। এমন ভাবনা কদমকে খুব শিহরিত করে!
২
কদম তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে তার রিক্সার সিটের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে একটি মেয়ে বসে থাকার কথা। যে মেয়েটিকে সে আজিমপুর থেকে নিয়ে এসেছে। সে মেয়েটির কান্নার আওয়াজ শুনেছে। অথচ এখন কেউ নেই। চারপাশে তাকিয়ে সে কোথাও মেয়েটিকে দেখতে পেলনা। কদম গামছা দিয়ে ঘাম মুছে। তার খুব বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। খুব ভয় পেয়েছে সে। সে বুঝে গেছে, এসব ভালো লক্ষন না। সে সম্ভবত পাগল হয়ে যাচ্ছে। তবে তার রিক্সায় বসে থাকা মেয়েটাকে এখন সে চিনতে পেরেছে। অনেকদিন পর তাকে দেখল কদম। মেয়েটা আবার ফিরে এসেছে। যার নাম কদম কখনোই জানতে চায়নি, অথবা মেয়েটি তাকে জানতে দেয়নি।
ব্ল্যাক ম্যাজিক
১
নীলক্ষেত মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা অনেক কঠিন কাজ। মোবারকের অনেক রাগ লাগছে। সে জানে রেগে গেলেই সে কিছু ভুল করে ফেলবে। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসাবে দরকার হলে রিক্সাচালকের গায়ে হাত তোলার নিয়ম আছে এ দেশে। সেটা কোন অপরাধ না। কিন্তু যতবার মোবারক কাউকে শারীরিক ভাবে আঘাত করেছে ততবার তার মধ্যে অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। আজো তার কয়েকজনকে খুব পিটাতে ইচ্ছা করছে। সিগনালের তোয়াক্কা না করেই এরা রিক্সা চালাচ্ছে।
তবে আজ মোবারক যে করেই হোক সবাইকে মাফ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছেলের জন্মদিনে কেউ তাকে অভিশাপ দিক এটা সে চায়না। চোখের পলকেই ছেলেটা বড় হয়ে গেল। ছেলের কথা ভাবতেই মোবারকের রাগ এবং বিরক্ত ভাবটা অনেকটাই কমে যায়। একজন রিক্সাচালককে থামিয়ে দিয়ে সে প্রশ্রয়ের হাসি দেয়।
২
কদম আলী একদৃষ্টিতে ট্রাফিক সার্জেন্ট মোবারকের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মধ্যে এক অন্যরকম শিহরন খেলা করছে। তার রিক্সায় একজন মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি এখন পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট টানছে। কিন্তু কদম জানে মেয়েটিকে অন্য কেউ দেখছেনা। মেয়েটা সবার কাছে অদৃশ্য।শুধু কদম তাকে দেখতে পায়। তার সাথে কদম কথাও বলতে পারে। মেয়েটা মাঝেমাঝেই কদমের রিক্সায় করে ঘুরে বেরায়। কদমের সাথে কথা বলে। কদমের সবকিছু মেয়েটা জানে। তার ভেতরের গোপন ইচ্ছাগুলো যা কখোনও কারো পক্ষে জানা সম্ভব না তাও জানে মেয়েটা। যেমন এখন কদমের একটা কাজ করতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছেটা সে অনেক দিন থেকেই নিজের ভেতরে খুব সযতনে লালন পালন করেছে। কিন্তু সে জানত সেটা পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভবনা। মেয়েটা তাকে বুঝিয়েছে সেটা করে ফেলাটা আসলে খুব কঠিন কোন কাজনা। এবং এই কাজ করার পর কদম যে শান্তি পাবে সে বোধের জন্ম এ ভুবনে না, অন্যকোথাও।
অনেক বছর আগের এক দুপুরের কথা মনে পড়ে যায় কদমের। কুমিল্লার কান্দিরপারে সখিনা এবং তার শিশুপুত্রকে সিটে বসিয়ে সে রিক্সা চালাচ্ছিল। ভুল করে সে সিগন্যাল না মেনে রিক্সা চালিয়ে ফেলেছিল। তখন একজন ট্রাফিক পুলিশ তার দিকে তেড়ে আসে। চুলির মুঠি ধরে সে লাঠি দিয়ে কদমকে পিটাতে শুরু করে। কদমের বউ এবং শিশুপুত্রের কান্নার আওয়াজ এখনো তার কানে বাজে। সেদিন কদম শারীরিক ভাবে খুব কমই আহত হয়েছিল। কিন্তু অপমান এবং লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। নিজের বউ এবং পুত্রের সামনে তাকে অপমানিত হতে হয়েছে। সে নিজের কাছেই নিজে খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই কদম একটা ভাবনা ভেবে খুব আরাম পায়। কিন্তু বাস্তবে সেটা করার মত সাহস কদমের ছিলনা। এই মেয়েটা তাকে সে সাহস দিয়েছে। এখন কদমের আর কোন ভয় নেই। দ্বিধা নেই। সে মোবারকের দিকে যেতে থাকে। মোবারক কি তাকে চিনতে পারবে? মনে হয়না। তবে না চিনাই ভালো। সে কিছুই বুঝতে পারবেনা। সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে যাবে। মোবারক খুব বিস্মিত হবে। এতে করে খেলাটা আরো জমবে।
কদম খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে মোবারকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ তার বউ আর ছেলেটাকে নিয়ে আসতে পারলে খুব ভালো হত। তারা আজ অন্য রকম এক কদমকে দেখতে পেত। কদম খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তার গামছার ভেতর থেকে চকচক করা ছুরিটা বের করে। তারপর একের পর এক মোবারকের বুকে এবং পেটে ছুরি চালাতে থাকে। যখন চারপাশের মানুষ কদমকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে শেষবারের মত তার রিক্সায় বসা মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে! মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে। চারপাশের মানুষ মেয়েটাকে সাহায্য করার জন্য ছুটে এসেছে। তবে কি সবাই তাকে দেখছে? কেন সে কদমকে মিথ্যা বলেছিল? কে এই মেয়ে?
কনফেশন
আমি একজন সিরিয়াল কিলার। যদিও কখনো কোন মানুষকে নিজ হাতে খুন করিনি। আমি যা করি তা হচ্ছে, আমার ক্ষমতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। এবং সবসময় কনফেস করি। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ সেটা বিশ্বাস করেনা। সবাই ভাবে আমি মানসিক রোগী। নিজের তৈরি ফ্যান্টাসিতে বাস করি। আর যারা সন্দেহ করে, তারাও প্রকাশ্যে কিছু বলেনা। কারন আমার বাবা অনেক ক্ষমতাবান একজন মানুষ। যাইহোক, আপনি এ দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। আপনার সাথে আমার জমবে। কথাগুলো আফ্রোদিতি খুব সহজ ভাবেই বলল। তার মধ্যে কোন জড়তা নেই। অস্পষ্টতা নেই। সে হাসিমুখে ডক্টর বেলায়েত হোসেনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাসিটাও খুব আন্তরিক।
তুমি বলেছ তোমার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। যে ক্ষমতা নিয়ে তুমি এক্সপেরিমেন্ট কর। আরো বলেছ তুমি একজন সিরিয়াল কিলার এবং নিজ হাতে কোন মানুষ হত্যা করনি। তার মানে ধরে নিচ্ছি তুমি অন্য কাউকে দিয়ে হত্যা করাও। এবং সেটা করাতে পারাটাই তোমার ক্ষমতা। যা তুমি অনেকবার কনফেস করেছ। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন বিশ্বাস করব? যদি করি তাহলে আমার কি করা উচিৎ? দুটো অপশন আছে। তোমাকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি। অথবা তোমাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করতে পারি। তবে তোমার মুখের কথায় আমি বিশ্বাস করবনা। তোমাকে প্রমান করতে হবে। বেলায়েত হোসেনের কথাগুলো আফ্রোদিতির ভালো লেগেছে। তার কাছে মানুষটাকে বেশ আনপ্রেডিক্টেবল মনে হচ্ছে।
আমি সেটা প্রমান করব। তবে আপনি যখন সেটা বুঝতে পারবেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কারন আমি এরপরের এক্সপেরিমেন্টটা আপনাকে নিয়ে করব। অর্থাৎ আপনাকে দিয়ে একজনকে খুন করাব। অবশ্যই এমন একজনকে যাকে আপনি মন থেকেই খুন করতে চান। আফ্রোদিতি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বেলায়েত হোসেনকে কথাগুলো বলল।
আফ্রোদিতির কথা শুনে বেলায়েত হোসেনের মনে হচ্ছে তার সামনে একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে যে এখনো রুপকথার জগতেই বাস করে। মেয়েটার প্রতি বেলায়েত হোসেনের মায়া হচ্ছে।
অনুসন্ধান
আফ্রোদিতির ছবি দেখে কদম চমকে ওঠে। সে ধরেই নিয়েছিল মেয়েটি কোন খারাপ আত্মা! সে কদমের উপর ভর করেছিল। কিন্তু বেলায়েত হোসেন নামক এক ডাক্তার, জেলে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে কদমকে বলেছে সে আফ্রোদিতিকে চিনে। সে আফ্রোদিতির ছবিও কদমকে দেখিয়েছে। ডাক্তার মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু কদম স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারেনা। কারন মেয়েটা রিক্সায় উঠে তার সাথে কথা বলতে শুরু করত। কখনও একদম চুপ থাকত। কিন্তু যতক্ষণ সে রিক্সায় বসে থাকত, কদম একটা ঘোরের মধ্যে থাকত। তার ভাবনা চিন্তা কিছুই তার নিয়ন্ত্রনে থাকতনা। সে নিজ থেকে কিছু বলতও না। মেয়েটাই মাঝেমাঝে তাকে প্রশ্ন করত। যেমন একদিন সে হঠাৎ করে প্রশ্ন করেছিল, তোমার যাকে খুন করতে ইচ্ছে করে তাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছ? কদম চমকে উঠেছিল। সে একজনকে খুন করতে চায়, এই মেয়ে সেটা কিভাবে জানে! কদমের তখন মনে হচ্ছিল এই মেয়ে তার ভেতরের সব ইছাগুলো কোন এক অলৌকিক উপায়ে জেনে যাচ্ছে। তার লুকানোর কিছু নেই। সে মেয়েটাকে তার গোপন ইচ্ছার কথা বলে। তারপর থেকেই কদমের ইচ্ছাটা তীব্র হতে থাকে। মেয়েটার প্রতিটা কথা সে ইচ্ছার আগুনে ঘি ঢালতে শুরু করে!
পাজল
বেলায়েত হোসেন তার চেম্বারে বসে আছেন। তিনি স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হয়েছে। কিন্তু মাঝেমাঝে তার খুব স্মোক করতে ইচ্ছে করে। যেমন এখন করছে। কারন তিনি আফ্রোদিতিকে নিয়ে ভাবছেন। এই মেয়েটা কোন এক বিশেষ উপায়ে তার শিকারকে সম্মোহিত করে ফেলতে পারে। যেমন কদম তার শিকার ছিল। কিন্তু এভাবে সম্মোহিত করার ব্যাপারটা অনেকটাই প্যারা সাইকোলজির সাথে সম্পর্কিত। আর এখানেই বেলায়েত হোসেনের ভয় হচ্ছে। বেলায়েত হোসেনের যুক্তিবাদী মন কিংবা একাডেমিক চর্চা, কোনটাই এই প্যারা সাইকোলজির ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছেনা। তাছাড়া কদমের সাথে কথা বলার পর তিনি বুঝেছেন যে, আফ্রোদিতি আসলেই সিরিয়াল কিলার। তবে সে খুনটা নিজ হাতে করেনা। অন্য কাউকে সম্মোহিত করে ফেলে সে। তবে এখানে একটা কমন প্যাটার্ন আছে। যেমন কদম তাকেই খুন করেছে যাকে সে খুন করতে চেয়েছে। এখান থেকে একটা হাইপোথিসিস দাড়া করায় বেলায়েত হোসেন। আফ্রোদিতি কোন এক বিশেষ উপায়ে মানুষের ভেতরের তীব্র ইচ্ছেগুলোকে নিয়ে খেলতে পারে।
মেয়েটা বিপদজনক। তার নেক্সট টার্গেট বেলায়েত হোসেন। সে জানেনা বেলায়েত হোসেনের ভেতরের ইচ্ছাগুলো কি। তবে মেয়েটা আশা করছে বেলায়েত হোসেন নিজেই সেটা তাকে বলে দেবে। তারপরই সে তার সম্মোহিত করার খেলাটা শুরু করবে। অর্থাৎ আফ্রোদিতি আসলে জানেনা তিনি কাকে খুন করতে চান। এটা থেকেই বুঝে ফেলা যায় তার কোন অলৌকিক ক্ষমতা নেই। আফ্রোদিতি যেটা করে সেটা হচ্ছে একটা রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করে। তারপর তার শিকারকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। শিকার তখন তার গোপন ইচ্ছেটা তাকে বলে দেয়। তখন আফ্রোদিতি সে ইচ্ছাটা বাস্তবায়িত করার জন্য শিকারকে প্রভাবিত করতে থাকে। বেলায়েত হোসেনের মুখে হাসির আভাস দেখা যায়। এখন আর আফ্রোদিতির ব্যাপারটা তার কাছে প্যারা সাইকোলজি মনে হচ্ছেনা। এখন তিনি জানেন তাকে কি করতে হবে!
ট্রিটমেন্ট
তুমি মাঝেমাঝে ধূমপান কর। কদমের কাছে আমি শুনেছি। ইচ্ছে করলে এখন আরাম করে সিগারেটে কয়েকটা টান দিতে পার! যদিও আমি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমার কাছে সবসময় এক প্যাকেট সিগারেট থাকে। বেলায়েত হোসেনকে একই সাথে শান্ত এবং উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। আফ্রোদিতি এই লোকটাকে বুঝার চেষ্টা করছে। পারছেনা। তার রাগ লাগছে।
আমি তোমার সমস্যাটার একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছি। তোমার অতীত সম্পর্কে আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। আসলে আমার দুটো ব্যাপার বুঝার দরকার ছিল। তুমি কিভাবে মানুষকে সম্মোহিত কর এবং কেন কর? কেন কর সেটার একটা ব্যাখ্যা এখন আমার কাছে আছে।
তোমার যখন ১২ বছর বয়স তখন তোমার মা রহস্যজনক ভাবে মারা যায়। অনেকেরই ধারনা ছিল সেটা হত্যাকাণ্ড। তোমার বাবাই আসলে তোমার মাকে হত্যা করেছে। কিছুদিন মিডিয়াতে সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করেছে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই সবাই চুপ হয়ে গেছে। তোমার বাবা এদেশের প্রভাবশালী একজন ব্যবসায়ি। মন্ত্রি এমপিরা তার কথায় উঠে বসে। তার পক্ষে সেসব ধামাচাপা দেওয়াটা কোন কঠিন ব্যাপার ছিলনা।
কিন্তু তোমার অবচেতন মনে সে ঘটনা তীব্র প্রভাব ফেলে। তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও। অর্থাৎ তোমার বাবাকে হত্যা করতে চাও। এই ইচ্ছেটা তোমার ভেতর তীব্র হতে থাকে। কিন্তু তুমি তা পারনা। তাই তুমি যেটা কর সেটা হচ্ছে, অন্য মানুষের মনের গহিন থেকে হত্যার ইচ্ছেটাকে টেনে বের করে নিয়ে আস। ইচ্ছেটাকে বাস্তবে পরিনত করার জন্য তুমি তোমার শিকারকে প্রভাবিত কর। যেমন কদম আলীকে করেছ। কদম যখন ট্রাফিক পুলিশ মোবারককে হত্যা করেছিল, তুমি তখন সেখানে ছিলে। তোমার মনে হচ্ছিল আসলে তুমি তোমার বাবাকে হত্যা করেছ। এটাই তোমার অবসেশন। তুমি অন্যকে দিয়ে আসলে বারবার নিজের ইচ্ছেটাকেই পূরণ করতে চাও। এবং তুমি সেটা করতে পার। কারন মানুষকে প্রভাবিত বা সম্মোহিত করার একটা বিরল ক্ষমতা তোমার মাঝে আছে। এমন ক্ষমতা রাজনীতিবিদ, ধর্মপ্রচারক কিংবা অনেক লেখকের মাঝেই আছে। তারা তাদের কথা দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তুমিও পার। তবে তুমি যে শান্তির জন্য এমনটা কর তা সাময়িক। যেমন কদম যখন মোবারককে হত্যা করে তখন তোমার মাঝে ক্ষণিকের আনন্দ হয়। কিন্তু তারপর আবার তোমার মধ্যে যন্ত্রণা হতে থাকে।
তবে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় আছে। তোমার ভেতরের যে ইচ্ছাটা তুমি এতদিন ধরে লালন পালন করে আসছ তার মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে। সেটাকে বাস্তবায়িত করতে হবে! এছাড়া তোমার মুক্তির অন্য কোন পথ আমার জানা নেই।
আফ্রোদিতি কাঁদছে। তাকে খুব অসহায় লাগছে। বেলায়েত হোসেনের খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তা করলেন না। বরং তার দেয়ালে ঝুলানো মোনালিসার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মোনালিসার হাসির মাঝেও রহস্য আছে!
পরিশেষে
আফ্রোদিতিকে নিয়ে বেলায়েত হোসেন একটা জুয়া খেলেছেন। সে খেলায় তিনি জিতেছেন নাকি হেরেছেন তা তিনি জানেননা। তবে আফ্রোদিতি তার বাবাকে হত্যা করেছে এবং নিজেই পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সেটা নিয়ে এখন মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে।
আফ্রোদিতি তার জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছে।
স্যার,
"আমি খুব করে চাচ্ছিলাম, আমাকে কেউ কনভিন্স করুক। সম্মোহিত করুক। আমি যেমনটা আমার শিকারদেরকে করেছি। আমি আসলে এবার নিজেই শিকার হতে চাচ্ছিলাম। আমি জানতাম একমাত্র আপনার পক্ষেই আমাকে সম্মোহিত করা সম্ভব। তার কারন হচ্ছে আপনি নিজেও আমার বাবাকে হত্যা করার গোপন ইচ্ছেটা অনেকদিন থেকে আপনার ভেতর লালন করে আসছেন! আমার মায়ের সাথে আপনার সম্পর্কের কথাটা আমি জানি। আর আপনাদের এই সম্পর্কের কারনেই আমার বাবা আমার মাকে হত্যা করে!
আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ! আপনাকে দেওয়ার মত আমার তেমন কিছু নেই। তবে আপনাকে হত্যা করতে চায় এমন একজনের সাথে আমি বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার সাথে আপনার দেখা হবে। যে মুহূর্তে তার সাথে আপনার দেখা হবে, ধরে নেবেন আপনার উপহার আপনি পেয়ে গেছেন!"
বেলায়েত হোসেন অনেক বছর পর নিয়ম ভঙ্গ করে একটা সিগারেট ধরালেন!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৪