অতীতে যা কিছু ঘটে তাই ইতিহাস। অতীতে ফিরে গিয়ে ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলা যায়না! যদি করা যেত তবে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। আপাতত সেটা ফিকশনের জগতে আবদ্ধ থাকুক। আমরা বরং এখন ১৯৭৫ সালে ফিরে যাই। সে সময়ে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের এক জোড়া চোখ লাগবে যা দিয়ে আমরা ঘটনাগুলোকে ঘটতে দেখব। বিশ্লেষণ করতে পারব। এই পোস্টে আমি লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এম. এ. হামিদ রচিত তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ের আলোকে সেই সময়গুলোতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সে সময় সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার কি করেছিলেন তাই এই পোস্টে আলোচনা করব। কেন করেছিলেন তার অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। যা এক পোস্টে বলা যাবেনা। তাই সংক্ষেপে প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।
১.
যে নেতার ডাকে এদেশের সব শ্রেণীর মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল, যে নেতার হাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দিতে মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিলনা, সে নেতাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করার পর কেন জনগন নিশ্চুপ ছিল! বিভ্রান্ত ছিল! কেন তারা সহজ ভাবে সে অভ্যুত্থান মেনে নিল! চার বছরে এমন কি হয়েছিল যে জনগন তাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল? ১৫ অগাস্টের অভ্যুত্থানকে বিশ্লেষণ করতে হলে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড় করতে হবে।
লেখক স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের চিত্রপট খুব অল্প কথায় চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন-বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাঙালি। সবাই এবার বিজয়ের অংশীদার। ভারতীয় বাহিনী বলে বিজয় আমাদের।মুক্তিবাহিনী বলে আমাদের। মুজিববাহিনী বলে আমাদের। সেনাবাহিনী বলে আমাদের। দেশের আনাচে কানাচে ছিটিয়ে পড়া নাম-না-জানা গেরিলারা বলে আমাদের। সেতু পাড়ার গেদু মিয়া কদম আলীরা ভাবে আমাদের। কারন তারা নাকি বাড়িতে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিল আশ্রয়।
সবাই বলে আমি বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এবার আমার প্রাপ্য আমাকে দাও। আমি কেন অবহেলিত। অন্যরা কেন আমার অগ্রভাগে?
শুরু হয়ে গেল চাওয়া পাওয়ার ইঁদুর দৌড়। চাই, চাই, চাই। গাড়ি চাই, বাড়ি চাই, টাকা চাই, চাকুরি চাই।চাকুরিওালাদের প্রমোশন চাই। নবগঠিত সেনাবাহিনীতেও একই আওয়াজ-প্রমোশন চাই।অনেক ত্যাগ হয়েছে, এবার চাই প্রমোশন। আর অপেক্ষা নয়।
অর্থাৎ সবাই তার স্বার্থ নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে। কেউ আর আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত না। কিন্তু একটা যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশে বঙ্গবন্ধু সবাইকে কিভাবে সন্তুষ্ট করবে? টাকা নেই, পর্যাপ্ত রিসোর্স নেই, কাঠামো নেই।দক্ষ প্রশাসন নেই। তার উপর চলছিল দেশী বিদেশী নানা রকম ষড়যন্ত্র। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেন। তিনি একদল চাটুকার এবং মাফিয়া দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকেন। দলের ত্যাগী এবং বিচক্ষন নেতাদের সাথে তার দুরুত্ত তৈরি হতে থাকে। রক্ষি বাহিনী এবং ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারনে সেনাবাহিনীর অফিসাররা ক্ষেপে যায়।সেনাবাহিনীর মধ্যে অফিসারদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল হতে থাকে। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জাসদ। তার অনেকটা মনোযোগ ছিল জাসদকে দমন করার দিকে। ফলে অন্যান্য শত্রুদের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। অথবা তাকে ঘিরে থাকা ক্ষমতালোভী নেতারাই তাকে সুকৌশলে অন্ধকারে রেখেছিলেন।
2.
লেখক হামিদ তখন ঢাকার ষ্টেশন কমান্ডার ছিলেন। তিনি জিয়াউর রহমানের কোর্সমেট এবং ভালো বন্ধু ছিলেন। সেনাবাহিনীর ভেতরের ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার লেখা থেকেই সে সময়ের সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সম্পর্কে একটা ধারনা পাওয়া যায়।তার মতে – সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে ঐ সময় জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ শেখ সাহেবের অনুগতদের মধ্যে ছিলেন। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে শেখ সাহেবের অধিক নিকটবর্তী মনে করা হতো।তিনি ঘন ঘন শেখ সাহেবের কাছে যেতে পারতেন।কিন্তু জিয়াকে লাইনে অপেক্ষা করতে হতো। এতে ধারনা করা হয় , শফিউল্লাহর পর খালেদকেই সেনাপ্রধান বানানো হবে। এ ধারনা মোটেই অমুলক ছিল না। জিয়া ব্যাপারটা ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন।
যে কোন কারনেই হোক, শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ ব্যাক্তিবর্গরা জিয়াকে উচ্চাকাংখি বলে মনে করতেন। জেনারেল ওসমানীও জিয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এমনকি ঐ সময় জিয়াকে পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে আর্মি থেকে সরিয়ে দেওার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়। এসব জেনে জিয়া কর্নেল( পরবর্তী বিগ্রেডিয়ার) খুরশীদের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে বুঝাবার চেষ্টা করেন। কর্নেল খুরশীদ আগরতলা কেইসে শেখ সাহেবের সহযোগী ছিলেন। তাই তিনি তার খুব কাছের লোক ছিলেন। কিন্তু তিনি জিয়ার প্রতি শেখ সাহেবের মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন করাতে সক্ষম হলেও তা পর্যাপ্ত ছিলনা। তোফায়েল আহমেদের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন জিয়া, শেখ সাহেবের সহানুভূতি অর্জনের জন্য।
এটা খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় যে, সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার বলয় নিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ এবং জিয়াউর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের খবর জুনিয়র অফিসাররা খুব ভালো ভাবেই জানত। আর এসব দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ১৫ অগাস্টের অভ্যুত্থান, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান, এবং ৭ নভেম্বরের সেপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
কে ছিল মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ
মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ছিলেন ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের সেকন্ড ইন কমান্ড। তার ভায়রা ভাই মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ছিলেন সহযোগী টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। তারা দুজন মিলেই ১৫ অগাস্টের অভ্যুত্থানের প্ল্যান করেন। ফারুক অভ্যুত্থানের কারন হিসাবে জানায় সে ভারতের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। পাকিস্থানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের কবলে দেশ পরুক এটা সে চায়নি। আসলেই কি এটাই একমাত্র কারন ছিল?
ফারুক মুক্তিযোদ্ধা ছিল কিনা এটা নিয়েই একসময় বিতর্ক দেখা দেয়। লেখকের ভাষায়,-
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ফারুক আবুধাবী থেকে পাকবাহিনী পরিত্যাগ করে পালিয়ে ২১ নভেম্বর লন্ডন হয়ে নয়া দিল্লীতে উপস্থিত হয়। বিতর্ক অবসানের জন্য দুই সদস্যবিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করা হয়। বিগ্রেডিয়ার মইনুল হোসেন ও আমি ছিলাম সদস্য।আমরা ফারুকের এয়ার টিকিট ইত্যাদি চেক করে প্রায় ৮ ঘণ্টার ঘাটতি পাই। আমাদের রিপোর্ট পর্যালোচনা নিয়ে বৈঠক বসে। জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া, খালেদ, মঞ্জুর, মইনুল হোসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। মিটিং-এ বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ফারুকের পক্ষ সমর্থন করে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য রাখলে কয়েক ঘণ্টার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গ্রহন করা হয়। তবে তাকে দুই বছর সিনিয়রিটি দেওয়া হয়নি।
বুঝাই যাচ্ছে ফারুক কেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! আসলে তার মধ্যে দেশপ্রেমের কোন ব্যাপারই ছিলনা।পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা এবং অন্যান্য রেফারেন্স থেকে এটা খুব সহজেই বলা যায় যে সে ছিল ক্ষমতালোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসার।এবং পাকি প্রেম তার মধ্যে প্রবল ভাবেই ছিল। শেখ মুজিব ক্ষমতায় থাকলে সে খুব বেশী দুর যেতে পারবেনা। এটা সে বুঝেছিল। তবে সেনাবাহিনীতে ফারুকের শক্তির উৎস ছিল খালেদ মোশাররফ। সম্পর্কে ফারুক খালেদের ভাগিনা হয়। তা ছাড়া সে জিয়ার কাছ থেকেও গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছিল।সব মিলে অভ্যুত্থানের জন্য সেনাবাহিনীর আবহাওয়া তার অনুকূলেই ছিল।
অভ্যুত্থানের অপর খলনায়ক রশিদ ছিলেন ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ।তাকে বলা যায় মেজর ফারুকের বিপরীত চরিত্র। অভ্যুত্থানের পরে ঠাণ্ডা মাথায় বিভিন্ন যায়গায় যোগাযোগের কাজটা সেই করে।
অন্যান্য অফিসাররা এই দুই ইউনিটের বাইরের ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ডালিম, নূর, শাহরিয়ার, পাশা, হুদা এবং রাশেদ। তাদের সবার মধ্যে একটা কমন ব্যাপার ছিল। তারা সবাই বিভিন্ন কারনে বহিষ্কৃত, অপসারিত ছিল এবং তাদের ক্ষোভটা ছিল ব্যক্তিগত। অর্থাৎ এই অভ্যুত্থানের পেছনে দেশপ্রেমের কোন ব্যাপারই ছিলনা। তারা তাদের পারসোনাল স্বার্থের জন্য একটা রিস্ক নিয়েছিল। এবং তাদের মাথার উপর ছায়ার মত ছিলেন সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা।
সে কালো রাতে যা হয়েছিল
রাত দশটায় ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে এসে এয়ারপোর্টের কাছে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের সাথে মিলিত হয়।
প্রধান টার্গেট ৩২ নম্বর শেখ সাহেবের বাড়ি। আক্রমনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফারুকের বিশ্বস্ত অফিসার মেজর মহিউদ্দিনকে। বাসাকে দুটো বৃত্তে ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইনার সারকেল গ্রুপ সরাসরি বাসা আক্রমন করবে। আউটার সারকেল গ্রুপ রক্ষীবাহিনী এবং বাইরের যে কোন আক্রমন প্রতিহত করবে। আউটার সারকেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নুর এবং মেজর হুদাকে। শেখ সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমনের দায়িত্ব নেয় ডালিম। এবং শেখ মনির বাসা আক্রমনের দায়িত্ব নেয় রিসালদার মোসলেম উদ্দিন। রেডিও ষ্টেশন, ও নিউমার্কেট এড়িয়ার দায়িত্ব নেন মেজর শাহরিয়ার।
ফারুক ২৮ টি ট্যাংক এবং ৩৫০ জন সৈন্য নিয়ে রক্ষীবাহিনীর সাথে লড়ার প্ল্যান করে। যদিও তার কাছে কামানের গোলা ছিলনা! রক্ষীবাহিনী পাল্টা আক্রমন করলে ফারুক খুব বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারতনা। কিন্তু হায়! ইতিহাস সেদিন অন্য রকম ভাবে লেখা হয়েছিল!
মেজর রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশনের পর সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। লবিং করা। এবং রাজনৈতিক ভাবে সমঝোতা করা। আসলে ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারীরা সব আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল!
সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। যদিও বঙ্গবন্ধু কিভাবে নিহত হয়েছিলেন তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। মেজর হুদা, মহিউদ্দিন, এবং নুরের বর্ণনায় ভিন্নতা আছে। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই আমি সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা কিছু ব্যক্তির বিতর্কিত ভূমিকার দিকে আলোকপাত করতে চাই।
তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ
তিনি সোয়া পাঁচটার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রমনের খবর পান। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সাথে তার শেষ কথা হয় ৫-৫০ মিনিটে। ভোর ছয়টার দিকে রাষ্ট্রপতি আক্রান্ত হয়ে নিহত হলেন। এর মধ্যে শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতির সাহায্যে একটা সৈন্যও মুভ করতে পারেননি।
আক্রমনের খবর পেয়ে শফিউল্লাহ ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঢাকার বিগ্রেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলকে ফোন করেন। ফোন করে তিনি শাফায়াত জামিলকে সৈন্য মুভ করতে বলেন। শাফায়েত সৈন্য মুভ করেনি দেখে তিনি ছয়টায় আবার ফোন দেন! তখন শাফায়েতের রিসিভার উঠানো ছিল। তারপর তিনি খালেদ মোশাররফকে ফোন দিয়ে ডেকে এনে শাফায়েত জামিলের কাছে পাঠান! তিনি পুরোটা সময় বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে কাটান। অথচ শাফায়েত জামিলের হেড কোয়ার্টার তার থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে ছিল।
এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে শফিউল্লাহ একজন অদক্ষ সেনাপতি ছিলেন। সেনাবাহিনীর উপর তার কোন নিয়ন্ত্রনই ছিলনা। মেজর ডালিম এসে জিয়াউর রহামান এবং খালেদ মোশাররফের সামনে থেকেই তাকে উঠিয়ে বঙ্গভবন নিয়ে যায়! পরবর্তীতে তাকে না জানিয়েই জিয়াউর রহমান চিফ অব স্টাফ হয়ে যান! ক্রাইসিসের সময় শফিউল্লাহ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। যার চরম মূল্য এ রাষ্ট্রকে দিতে হয়েছে।
শাফায়েত জামিল
সে সময়ে সবচেয়ে রহস্যময় আচরন করেছিল বিগ্রেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল। তার অধীনে চার হাজার সৈন্য ছিল। তার যুক্তি হচ্ছে সে সেনাপ্রধান থেকে কোন ক্লিয়ার কমান্ড পান নাই।কিন্তু তার যুক্তিতে গোঁজামিল আছে।
একজন স্বাধীন বিগ্রেড কমান্ডার হিসাবে তিনি চাইলেই সৈন্য মুভ করাতে পারতেন। তাছাড়া মেজর রশিদ শাফায়েতের অধীনস্থ একটা ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। সে যখন শাফায়েতকে এসে বলল, sir we have killed sheikh, তখন শাফায়েত জামিল কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তার এড়িয়ায় খুনিরা বীর দর্পে ঘুরে বেরাল। তিনি কোন পদক্ষেপই নিলেন না।
ভোর সাড়ে ৪ টায় তার বিগ্রেড এরিয়ার ভেতর দিয়ে ফারুক ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হয়। অথচ শাফায়েত জামিল কিছুই টের পায়নি এমনটা হতেই পারেনা।
পরবর্তীতে রশিদকে যখন এক সাক্ষাতকারে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, শাফায়েতের শক্তিশালী ৪৬ বিগ্রেড নিয়ে তারা কেন চিন্তিত ছিলনা তখন রশিদ মুচকি হেসে বলেছিল-সেতো আমাদেরই লোক। তার তরফ থেকে আমরা কোন আক্রমন আশংকা করিনি। শাফায়েত এবং তার অধিনস্ত অফিসার সবাইতো ব্যাপারটা জানত।
১৫ অগাস্ট সকালেও শাফায়েত জামিল সেনা প্রধানের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলেন না। সেনাপ্রধান তার ইউনিটে আসলেও তিনি দূরে দাড়িয়ে ছিলেন।
তৎকালীন DGFI বিগ্রেডিয়ার রউফের বিতর্কিত ভূমিকা
শেখ মুজিব রউফকে DGFI পোস্ট থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও বলদি করেছিলেন। রউফ এতে রেগে ছিলেন। নবনিযুক্ত DGFI ছিলেন কর্নেল জামিল। তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে রউফ গড়িমশি করছিলেন। ১৫ অগাস্ট দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা ছিল। কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু রউফ কি করেছিল?
আক্রমনের খবর সবার প্রথম জানতে পারে বিগ্রেডিয়ার রউফ। রাত তিনটার মধ্যেই তিনি সৈন্য মুভ করার খবর পান। তিনি সে ব্যাপারে কাউকে সতর্ক করেন্ নাই। তিনি যা করেছেন তা হচ্ছে পরিবার নিয়ে বাসার পেছনে একটি গাছের নিচে লুকিয়ে ছিলেন!
জিয়াউর রহমান
এক ১৫ অগাস্টের অভ্যুত্থান থেকে জিয়ার কার্যক্রমকে বিশ্লেষণ করা যাবেনা। সেটা বিশ্লেষণ করতে হলে নভেম্বরের অভ্যুত্থান গুলোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। সে বিষয়ে আমি পরবর্তী পোস্টে আলোচনা করব। এই অভ্যুত্থানের ফলে আসলে লং টার্মে জিয়ারই লাভ হয়েছে। জিয়াউর রহমান একজন সুযোগ সন্ধানী এবং ধূর্ত অফিসার ছিলেন। তবে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে অগাস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন না। যদিও খুনিদের সাথে এ ব্যাপারে তার আগেই কথা হয়েছে। জিয়া বলেছিল একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে তিনি এমনটা করতে পারবেন না। তবে জুনিয়র অফিসারদের তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন। এসব অভ্যুত্থানে পরোক্ষ মদদ দিয়ে তিনি সলে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলেন। নভেম্বরে সে সঠিক সময়কে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদে তিনি বসতে পেরেছিলেন।
সেনা অভ্যুত্থানের পর যখন শাফায়েত জিয়াকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে তখন জিয়ার স্পষ্ট জবাব ছিল, President is dead, so what? Vice-President is there. You should uphold the constituation, Get your troops ready. মুজিব হত্যার সংবাদ শুনে জিয়া এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল!
ডালিম যখন শফিউল্লাহকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাচ্ছিল, জিয়া তখন সহাস্যে বলেছিলেন, come on Dalim, in my car. ডালিমের উত্তর ছিল, No sir, I don’t get in general’s car.
খালেদ মোশাররফ
খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ ছিলেন। শফিউল্লাহর পর তিনি সেনা প্রধান হবেন এটা সবাই জানত। কিন্তু শফিউল্লাহকে আরো তিন বছর সেনা প্রধান রাখার কথা ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ খালেদকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হত। তবে এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই কতটুকু জানতেন তা স্পষ্ট করে বলা যাবেনা। তবে তার পর তিনি ক্ষমতা দখলের খেলায় খুব ভালো ভাবেই সক্রিয় ছিলেন। সেসব গল্প পরবর্তী পোস্টে করার ইচ্ছে রইলো।
এই পোস্টে আমি যাদের কথা বললাম তারাই ছিল অগাস্ট এবং নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল নায়ক কিংবা খল নায়ক। তবে পরে আরো কিছু চরিত্র এসে এ খেলায় যোগ দিয়েছিল! তাদের মধ্যে তাহের ছিল অন্যতম!
সব তথ্য লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ. হামিদের তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বই থেকে নেওয়া। তিনি খুব কাছ থেকে সে সময়ের চরিত্রগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
এই পোস্টে উল্লেখিত কোন তথ্য যদি কারো কাছে মিথ্যা বা ইতিহাস বিকৃতি বলে মনে হয় তবে সঠিক রেফারেন্স দিয়ে আমাকে আলোকিত করবেন এই আশা করছি।
বি.দ্রঃ একাত্তরের ভূমিকার জন্য শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান এবং শাফায়েত জামিলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রেখেই এই পোস্ট লিখেছি। একাত্তরে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে কোন সন্দেহ আমার নেই।
তথ্যসুত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা( লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ. হামিদ পিএসপি
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৭