ক্ষমতা মানুষের মধ্যে বহুমুখী আবেগের সৃষ্টি করে। যখন কোন মানুষ হঠাৎ করে আবিষ্কার করে যে তার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে যা অন্য কারো নেই তখন সে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এই বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য সে একটা পথ খুঁজে। রোড নট টেকেনের মত একটা পথ ছেড়ে দিয়ে কোন একটা সুনির্দিষ্ট পথে সে তখন হাঁটতে চায়। একজন ক্ষমতাবান মানুষ আরো অনেক কিছু দ্বারাই প্রভাবিত হয়। যেমন তার ক্ষমতার ধরন, কাদের উপর তার ক্ষমতার প্রভাব আছে, তার ক্ষমতার সাথে অন্যদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, এসব ব্যাপার একজন ক্ষমতাবান মানুষের মনোজগতে কাজ করতে থাকে। সে একই সাথে ইন্টার্নাল এবং এক্সটার্নাল কনফ্লিক্টের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হতে থাকে।
আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসকে এক দিক দিয়ে ক্ষমতা দখলের ইতিহাসও বলা যেতে পারে। রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব। এক দর্শনের সাথে আরেক দর্শনের দ্বন্দ্ব। এক ধর্মীয় মতবাদের সাথে আরেক ধর্মীয় মতবাদের দ্বন্দ্ব। এ সবকিছুকেই এক কথায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলা যেতে পারে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কেউ আমাদের কাছে হিরো হয়ে যায়, আবার কেউ ভিলেন। সেটা নির্ভর করে ইতিহাসের গল্পটা আমরা কোন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে পড়ছি। আর এসব ইতিহাস থেকেই আধুনিক ফিকশনের জন্ম।
মার্ভেল কমিক্স একটা কমন কনসেপ্ট দিয়ে মুভি জগতকে ভালোই আলোড়িত করতে পেরেছে। কনসেপ্টটা হলো দ্যা কনফ্লিক্ট বিটউইন সুপার হিরো এ্যান্ড সুপার ভিলেন। এই কনসেপ্টের উপর ভিত্তি করে যত মুভি সিরিজ হয়েছে তার মধ্যে এক্স ম্যান সিরিজের মুভিগুলো আমার বেশী প্রিয়। এই সিরিজের শেষ যে মুভিটা দেখলাম তা হচ্ছে X-Men: Apocalypse। আমি মুভি দেখার সময় এক মুভির মধ্যেই অনেক রকম গল্প খুঁজে বেরাই। ডিফারেন্ট পয়েন্ট অব ভিউ থেকে গল্পগুলোকে যাচাই বাছাইয়ের চেষ্টাও করি। সব ফিকশনের একটা বাস্তবিক ডাইমেনশন আছে। আবার বাস্তবও ফিকশন দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর একটা মুভির এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটাই আমার কাছে মুভি রিভিউ। এই মুভির সাথে রিলেটেড কিছু কথা প্রথমেই বলে নিয়েছি। এবার মুভি বিষয়ক আলোচনা শুরু করা যাক।
Apocalypse শব্দটার অর্থ হচ্ছে বিশেষ কোন গুপ্ত জ্ঞান প্রকাশ করে দেওয়া। সেই জ্ঞান কেমন সেটা বুঝতে হলে ওল্ড এ্যান্ড নিউ টেস্টামেন্টের রেফারেন্স দেওয়া যেতে পারে। এটা এমন একটা জ্ঞান যা দ্বারা ইভিলদের রাজত্ব ধ্বংস করে গডের ফলোয়ারদের রাজত্ব কায়েম করা হবে। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলতে হবে ভালোদের সাথে খারাপদের লড়াই। এখন ভালো কারা কিংবা খারাপ কারা? এই প্রশ্নেরও একটা বহুল প্রচলিত আধুনিক কনসেপ্ট এই মুভি থেকে পাওয়া যাবে।
এক্স ম্যান সিরিজের মুভিগুলোর দুটো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে মাইন্ড কনট্রলিং মিউট্যান্ট Charles Xavier এবং মেটাল কনট্রলিং মিউট্যান্ট Erik Lehnsherr / Magneto। তাদের মধ্যে আমরা একটা মতবাদিক বিতর্ক দেখতে পাই। বিতর্কটা হচ্ছে সাধারন মানুষদের সাথে সহাবস্থান করা ভারসাস ক্ষমতা দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রন করা। এই বিতর্কটাই আসলে এই মুভি সিরিজের মূল কনসেপ্ট। এই কনসেপ্টকে কেন্দ্র করেই বাকি সব সাব কনসেপ্ট গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ জনগনের ভালোর জন্য ক্ষমতা নাকি জনগণকে নিয়ন্ত্রন করে ক্ষমতা উপভোগ করা এই নিয়ে দ্বন্দ্ব। চিরায়ত মিথের মত এখানেও দেখানো হয়েছে যে যেসব মানুষ ক্ষমতা উপভোগ না করে বরং জনগনের ভালোর জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত তারা সুপার হিরো এবং যারা তা না করে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় তারা সুপার ভিলেন। কনসেপ্ট একই। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে কারা ভালো আর কারা খারাপ এই ধারনার কিন্তু একটা পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা X-Men: Apocalypse মুভিতে আমরা দেখতে পারব।
এন সাবাহ নুর যাকে প্রথম মিউট্যান্ট বলা হয়, সে প্রাচীন ইজিপ্ট শাসন করত। তাকে তার ফলোয়াররাই ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিল। তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে সে আবার জেগে ওঠে। সে বিশ্বাস করে তার অনুপস্থিতে মানুষজন সব বিপথে চলে গেছে। তারা ইভিল ফোর্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তাই এন সাবাহ নুর চায় সব কিছু ধ্বংস করে আবার নতুন ভাবে বিনির্মাণ করতে। সে হবে নতুন সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা। সে তার মতবাদ এবং ক্ষমতা দিয়ে অন্য মিউট্যান্টদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, আবার অনেকেই হয়না। এটা নিয়েই দুপক্ষ একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে যেতে থাকে। আর এসব নিয়েই মুভি আবর্তিত হতে থাকে।
এই মুভির মূল দ্বন্দ্বটা হচ্ছে এন সাবাহ নুরের ন্যারেটিভ এবং প্রোফেসর এক্সের ন্যারেটিভের মধ্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ন্যারেটিভগুলো বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের কিছু ফ্যাক্টকে মেটাফোরিক ওয়েতে রিপ্রেজেন্ট করে। একটা উদাহরন দিয়ে বিষয়টা আরো সহজ করে বলা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক আইসিসের স্পিরিচ্যুয়াল লিডার বাগদাদির উত্থান। সে এসে বলল যে মানবজাতি তার পথ হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং সব সিস্টেমকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সে একটা প্রচিলিত ধর্মের একটা পার্টিকুলার ব্যাখ্যাকে সঠিক ভেবে সেটার আলোকেই বর্তমানকে ইতিহাসের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ তার কাছে বর্তমানটা হচ্ছে ডিসটোপিয়ান সোসাইটি। আর সেই নির্দিষ্ট ধর্মের রাজত্বের সময়টা হচ্ছে ইউটোপিয়া। সে তার মতবাদ দিয়ে মুসলিমদের কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ কনভিন্সড হয়েছে। অনেকেই হয়নি। যারা হয়নি তারা বাগদাদির ন্যারেটিভকে সঠিক মনে করেনি। কিন্তু তাদের কাছেও বর্তমানটা ইউটোপিয়া না। বাট তারা অতীত দ্বারাও প্রভাবিত না। অতীতকে ঠিক অতীতের মত বর্তমানের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কনসেপ্টে তারা বিশ্বাস করেনা। তারা বর্তমানের আলোকেই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে চায়। এটাই হচ্ছে প্রোফেসর এক্সের ন্যারেটিভ যার সাথে সাবাহ নুরের অতীতের দর্শন ফিরিয়ে আনার কনফ্লিক্ট।
সাবাহ নুরকে Magneto সমর্থন করা শুরু করে। তার হয়ে সে কাজও করতে থাকে। এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার আছে লক্ষ্য করার। যারা নুরকে সমর্থন করেছে তারা কিন্তু শুধু তার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তাকে সমর্থন দেয়নি। আসলে বর্তমান সময়ে তারা সবাই বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ছিল। অর্থাৎ তাদের কনফ্লিক্ট ছিল চলমান সমাজ কাঠামোর সাথে। তারা নতুন একটা সমাজ কাঠামোর স্বপ্ন দেখে যেখানে তাদের সোশ্যাল ভ্যালু থাকবে। তারা তাদের ক্ষমতাগুলোকে উপভোগ করতে পারবে। এইখানে ঘৃনা, প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা এসব ফ্যাক্টরও কাজ করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এই নীতিতে বিশ্বাস করে শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে ফেলার ব্যাপারটাও চলে আসে। রাজনীতিতে এমন ব্যাপার আমরা প্রায়ই ঘটতে দেখি।
X-Men: Apocalypse মুভিতে ঠিক এই ব্যাপারগুলোই রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। এটাকে এনলাইটমেন্ট মুভমেন্ট দ্বারা যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছে তার সাথে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ যারা অতীতকে অতীতের মত প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের গল্পও বলা যেতে পারে। যে গল্পের ভিন্ন রকম ডাইমেনশন আমরা বাস্তবে এবং ফিকশনে দেখে চলছি এবং প্রভাবিতও হচ্ছি।
তবে এসব গল্পে খুব সুকৌশলে যা দেখানো হয় তা হচ্ছে বর্তমান সময়ে যা কিছু খারাপ তা রিফর্মেশনের মাধ্যমেই ঠিক করে নিতে হবে। বিপ্লব মানেই ডার্ক অ্যাকশন। এটা দেখানোর জন্য তারা এমন টাইপ বিপ্লব বেছে নেয় যা আসলেই ডার্ক। যেমন বাগদাদির আইসিস টাইপ কনসেপ্টকে তারা প্রতিপক্ষ বানায়। যেটাকে সাবাহ নুরের ন্যারেটিভের মাধ্যমে এই মুভিতে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রোগ্রেসিভ রিফর্মিস্ট ভারসাস ডার্ক বিপ্লবি। এভাবে রিপ্রেজেন্ট করলে আমরা রিফর্মিস্টদের পক্ষে। যেমন এ মুভিতে প্রোফেসর এক্স আমাদের কাছে সুপার হিরো। সাবাহ নুর আমাদের কাছে সুপার ভিলেন।
বাট প্রোগ্রেসিভ রিফর্মিস্ট ভারসাস প্রোগ্রেসিভ বিপ্লবীর গল্প মনে হয় মার্ভেল কমিক্স আমাদের শোনাতে চায়না। X-Men: Apocalypse মুভিটা তাই ভালো লাগলেও কনসেপ্ট গতানুগতিক মনে হয়েছে। আর মুভিতে কোন পক্ষ কিভাবে জয়ি হলো তা জানতে হলে মুভিটা দেখে ফেলুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০১