ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। ধূমপান হৃদরোগের কারন। এসব লেখা আমরা বিড়ি সিগারেটের প্যাকেটে দেখতে পাই। তারপরও আমরা অনেকেই বিষপানকে সুখটান ভেবে একধরনের আত্মতৃপ্তি পাই। জেনেশুনে বিষ পান করা খুব সহজ ব্যাপার না! তবুও ধূমপায়ীরা খুব উৎসাহের সাথেই প্রতিনিয়ত বিষপান করেই যাচ্ছে। আসলে তাদের ইচ্ছাশক্তির বলেই তারা ধূমপান করছে ব্যাপারটা এমনও না। তাদেরকে খুব কৌশলে একটা অভ্যাসের দাস বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কারা বানাচ্ছে? কেন বানাচ্ছে? আমরা সবাই জানি ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সবাই জানার পরও টোব্যাকো বিজনেস কিভাবে টিকে আছে? এসব সিরিয়াস প্রশ্নের উত্তর যদি রিলাক্সড মুডে জানতে চান তবে সময় করে Thank You For Smoking মুভিটা দেখে ফেলতে পারেন।
Christopher Buckley এর উপন্যাস Thank You For Smoking অবলম্বনে এই মুভি বানানো হয়। সাধারনত ভালো উপন্যাস অবলম্বনে যেসব মুভি বানানো হয় সেসব মুভির স্টোরি এবং থিম বেশ গভির হয়। তবে এ মুভির পরিচালক এবং পাত্র পাত্রীদের পারফরমেন্স কেমন হয়েছে সেসব নিয়ে আলোচনা করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য না। যেহেতু মুভিটা দেখে ভালো লেগেছে তাই এই মুভির সাথে জড়িত সবার টিম ওয়ার্ক ভালো হয়েছে সেটা বলা যায়।
মুভির স্টোরি এবং থিমটাই আমার আলোচ্য বিষয়। বিগ টোব্যাকোর প্রধান স্পোকসম্যান নিক নেইলরকে(Nick Naylor) কেন্দ্র করেই মুভির কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে। নিক একজন বিখ্যাত লবিস্ট। সে একই সাথে টোব্যাকো লবি(tobacco lobby) একাডেমী অব টোব্যাকো স্টাডিজের(Academy of Tobacco studies) ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই একাডেমী ফুসফুসের ক্যান্সারের সাথে স্মোকিং এর সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে। তাদের গবেষণার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা প্রমান করা যে, ফুসফুসের ক্যান্সারের সাথে আসলে স্মোকিং এর কোন সম্পর্ক নেই। এই গবেষণার সব খরচ বহন করে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো। তাদের স্পোকসম্যান এবং লবিস্ট নিক নেইলরের কাজ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগের যৌক্তিক জবাব দেওয়া। তার প্রধান গুন হচ্ছে সে যুক্তি দিয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানিয়ে ফেলতে পারে। যেমন মুভির শুরুতেই দেখা যায় নিক একটা টকশোতে ধূমপানবিরোধী কয়েকটি সংঘটনের প্রধানদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়। সেখানে ১৫ বছর বয়সি একজন শিশু থাকে। ধূমপানের কারনে যার ক্যান্সার হয়। নিক সেখানে বলে যে, তারা কখনোই চায়না যে একজন ধূমপায়ী মারা যাক। কারন একজন ধূমপায়ীর মৃত্যু মানে তাদের একজন কাস্টোমার কমে যাওয়া। তাদের একজন কাস্টোমার কমে যাবে এটা তারা কোনভাবেই চায়না। বরং তারা চায় সে বেঁচে থাকুক এবং ধূমপান অব্যাহত রাখুক। সে উল্টা ধূমপান বিরোধী সংঘটন গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে যে, তারাই নাকি চায় যে মানুষ ধূমপান করে মারা যাক। তাহলে সেটা উদাহরণ হিসাবে দেখিয়ে তারা ধূমপান বিরোধী ফান্ড কালেক্ট করতে পারবে! বেশ কার্যকর যুক্তি! স্মোকাররা এমনিতেই ধূমপানে আসক্ত। তারা ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শুনলেও সেটা এড়িয়ে যেতে চান। বরং যদি এমন কিছু শুনে যে ধূমপান খুব একটা ক্ষতিকর না তবে সেটা খুব বিশ্বাস করেই লুফে নেয়। প্রবল আসক্তির কারনে তাদের অবচেতন মন এবং চেতন মনে চলতে থাকে নিজেকেই প্রতারিত করার খেলা। আর এই খেলাকেই বিভিন্ন ভাবে ইউটিলাইজ করে লবিস্টরা।
এভাবেই টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর সাথে ধূমপান বিরোধী এবং পরিবেশবাদী সংঘটনগুলোর সংঘর্ষ চলতেই থাকে। চলতে থাকে পলিসি এবং পাল্টা পলিসির খেলা। মুভির কাহিনী বলে দেবনা। তবে মুভির আরো কিছু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা যায়। যেমন সিনেমায় সিগারেটের ব্যাবহার করা। মুভির কোন একটা সিনে জনপ্রিয় নায়কের হাতে যদি সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া যায় তবে সেটা অনেককেই খুব সহজে প্রভাবিত করবে। মার্কেটিং এর এই সহজ কৌশলটা সব বড় কোম্পানিগুলোই কাজে লাগায়। টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর জন্য এটা খুব মোক্ষম একটা মার্কেটিং পলিসি। তাই নিককে দেখা যায় হলিউডের মুভিতে কিভাবে স্মোকিং এর দৃশ্য রাখা যায় সেটা নিয়ে লবিং করতে। যেমন ধরা যাক ফেলুদা যখন স্মোক করে কিংবা হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র হিমু কিংবা মিসির আলি যখন পরম তৃপ্তিতে সিগারেটে টান দেয় তখন আমাদের অবচেতন মনে তা খুব তীব্র ভাবেই প্রভাব ফেলে। আমাদের মনে হতে থাকে ধূমপান ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক কিছু। সত্যজিৎ রায় কিংবা হুমায়ুন আহমেদের মত এমন শক্তিশালী লেখকরা টোব্যাকো কোম্পানির লবিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসব লেখেন নাই। কিন্তু এসব লবিস্টরা সবসময় এসব শক্তিমান মানুষদের প্রতিভাকে নিজেদের মার্কেটিং পলিসি হিসাবে কাজে লাগায়। কেউ কেউ আবার এদের টাকা খেয়ে নিজেদের প্রতিভাও এদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
নিক, ফায়ারম্যান লবিস্ট ববি এবং অ্যালকোহল লবিস্ট পলি সপ্তাহে একদিন গল্প করার জন্য মিলিত হয়। তারা মজা করে নিজেদের বলে মার্চেন্টস অব ডেথ। তাদের কনভারসেশন শুনলে বুঝা যায় কি এক ভয়াবহ খেলায় তারা নিমজ্জিত। মজার ভঙ্গিতে বলা তাদের কথাগুলো শুনে আমার মনে হচ্ছিল আসলেই আমরা এসব ক্ষতিকর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছুই না!
Thank You For Smoking মুভির থিমটা গুরুগম্ভীর হলেও সংলাপগুলো বেশ মজার। পুরো মুভি জুড়েই আছে মজার সব স্যাটায়ার। একই সাথে মজা এবং ভাবনার খোরাক দুটোই পেয়েছি এই মুভি দেখে।
প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনা
খুব গভির ভাবে যদি আমাদের যাপিত জীবন সম্পর্কে ভেবে দেখি, তবে দেখব এমন অনেক কিছুই আমরা করি যা আসলে নিজেদের প্রতারিত করার মতই ব্যাপার। যেমন ধরা যাক ধূমপান। আমরা ধূমপান করে নিজেদের ক্ষতি করছি, পরিবেশের ক্ষতি করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর। আমাদের ক্ষতিকর অভ্যাস তাদের মুনাফার প্রধান উৎস। তারা নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্নভাবে আমাদের এই ক্ষতিকর অভ্যাস তৈরিতে প্রভাবিত করে আসছে। সুকৌশলে আমাদের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে ভ্রান্ত ধারনার।
এমন ক্ষতিকর অনেক কিছুর উদাহরনই দেওয়া যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের দুটো আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং জঙ্গিবাদ। এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও আমরা দেশী বিদেশী লবিস্টদের দ্বারা বিভ্রান্ত হচ্ছি। অনেকেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ভাষণে অনেক অযৌক্তিক কথা বলেছেন। এসব কথা আমরা আগেও শুনেছি। কিন্তু এসব উদাহরন প্রথমে ভারতীয় কোম্পানির নুন খাওয়া লবিস্টরা দিত। এখন এদেশের মন্ত্রী এবং সাংবাদিকরাও প্রকাশ্যে বলছে। তারা হয় নিজেরাও সেই ভারতীয় কোম্পানির নুন খেয়েছেন নাহয় তাদের লবিস্টদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। অনেকটা বিভ্রান্ত হয়ে ধূমপান করে নিজের ক্ষতি করার মত ব্যাপার। লবিস্টদের উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সেই একই কায়দায় তারা মুনাফা লাভ করতে চায়। পরিবেশ কিংবা মানুষ তাদের কনসার্ন না। মুনাফার জন্য মানুষ কিংবা পরিবেশের ক্ষতি তারা করেই চলবে।
ধর্মও খুব জমজমাট একটা ব্যবসা এখন। অনেকেই নিজেদের ছেলে মেয়েদের দেশের বাইরে নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। তারাই আবার এদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে লবিং করেন। আসলে তারা মানুষকে অশিক্ষিত করে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়। এরাই আবার বিভিন্ন ভাবে জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে তাদের যদি এতই ভাবনা থাকত তবে তারা নিজেরাই সব রকমের মূল্যবোধের বারোটা বাজানোর জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাইত। তবে তারপরও তাদের কথা শুনে তাদের দলের সমর্থকরা বাহবা দেয়। তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে সমর্থকরা প্রশ্ন করেনা। আবার অন্যদিকে আরেক দলের সমর্থকরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। তারা ধরেই নিয়েছে তাদের নেতানেত্রীরা যাই বলবে তাই ঠিক। সেটাই চোখ বুঝে মেনে নিতে হবে। কোন প্রশ্ন করা যাবেনা। এটাকেই বোধ হয় মগজ ধোলাই বলে। হীরক রাজা ব্যর্থ হলেও আমাদের দেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদরা সফল হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।
যাইহোক, মুভির কাহিনীর সাথে প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় এসব কথাও বলে ফেললাম। আসল কথা হচ্ছে আমরা এমন অনেক কিছুই করি যেখানে আমাদের যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য কারো দ্বারা। সেটা হতে পারে কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক দল দ্বারা। হতে পারে কোন ধর্মীয় মতবাদ বা ধর্ম প্রচারকের আদর্শ দ্বারা। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যেও বিচার বিশ্লেষণের একটা ক্ষমতা আছে। এই আধুনিক বিশ্বে সেটার যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে। যেমন কোন স্মার্ট ছেলে যদি এসে বলে স্মোকিং কুল, তবেই সেটা কুল হয়ে যায়না। তার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে আমরা খুব সহজেই জেনে ফেলতে পারি। তেমন ভাবেই কোন রাজনীতিবিদ কিছু বললেই সেটাই ঠিক হয়ে গেল এমন ভাবার কোন কারন নাই। ঠিক বেঠিক ভাবার আগে যৌক্তিক ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। ধর্মীয় মতবাদ যারা প্রচার করছে তাদের কথাও বিশ্বাস করে ফেলা ঠিকনা। যাচাই বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করেই অনেকে আজ জঙ্গিতে পরিনত হচ্ছে।
পরিশেষে
যেসব টোব্যাকো কোম্পানি আপনাদের জীবন নিয়ে খেলছে তাদের বিরুদ্ধে আর কিছু করতে না পারলেও একটা লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। সেটা হচ্ছে ধূমপান ত্যাগ করার লড়াই। আমি লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত সফল। আমি নিজেও ধোয়া তুলসি পাতা না। ক্ষতিকর অনেক কিছু দ্বারা আমিও প্রভাবিত। কিন্তু টোব্যাকো কোম্পানিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর লড়াইটা আমি বেশ উপভোগ করছি। চার মাসের মত হলো। রেস্ট অব দ্যা লাইফ এই লড়াই চলবে।
Thank You For Reading This Post.
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৩