সময়ের গান
যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু মুগ্ধকে আজ ঘরে বসে থাকলে চলবেনা। অথবা বলা যেতে পারে মৃত্যু কিংবা জীবনের মধ্যে কিছু একটা বেছে নিতে হলে তাকে আজ এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।
মুগ্ধকে এককথায় কি বলা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন আজকাল মানুষকে শুধু মানুষ বললে অনেক কিছুই অপ্রকাশিত থেকে যায়।ধরা যাক যদি বলা হয় এই মানুষটি ডাক্তার কিংবা গবেষক কিংবা অন্যকিছু তবে কিছুটা হলেও তাকে ডিফাইন করা যায়। লোকটি ধনী কিংবা গরীব এমন বিশেষণ দিয়েও একজন মানুষ সম্পর্কে জেনে ফেলা যায়। তেমন ভাবে আমরা যদি মুগ্ধকে ডিফাইন করতে চাই তবে বলতে হবে সে একজন গবেষক। যদি আরেকটু গভীর ভাবে তাকে বুঝতে চাই তবে অবশ্যই জানতে হবে সে আসলে কি নিয়ে গবেষণা করে! সে অনুভূতি নিয়ে গবেষণা করে। সে মানুষের অনুভূতিগুলোকে বিশ্লেষণ করে একটা চিরাচরিত ধাঁধার উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে। কি সে ধাঁধা? তা আমরা গল্পের শেষে জেনে যাব! তবে ধাঁধার উত্তর পাওয়া যাবে কিনা, তা এখনো বলা যাচ্ছে না!
মুগ্ধকে আজ একজনের সাথে দেখা করতে হবে। যার সাথে দেখা করার জন্য মুগ্ধ অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কিছুতেই তার অনুমতি পাচ্ছিল না। অবশেষে মুগ্ধের ডাক এসেছে। আজ তার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। তবে তার সাথে দেখা করার আগে মুগ্ধকে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। মুগ্ধ চোখ বুজে শান্ত ভাবে তার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
আরাধনা
কয়েকজন মানুষ জানু পেতে বসে আছে। তারা জানে তাদের এভাবেই বসে থাকতে হবে। তাদেরকে তেমনটাই করতে বলা হয়েছে। এসব মানুষ জন্মের পর থেকেই দুটো জিনিস বুঝতে শিখেছে। এক হচ্ছে শক্তির প্রকাশ এবং অপরটি হচ্ছে শক্তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। তাই যারা দুর্বল তাদের উপর আঘাত হানতে হবে। যারা শক্তির উৎস তাদের আরাধনা করতে হবে। যা কিছু জানার বাইরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে তাই শক্তি। সেই শক্তিকে কিছু একটা উৎসর্গ করার আয়োজন চলছে।
একটি মানব শিশুকে আজ বলি দেওয়া হবে। কারন কেউ একজন তাতে তুষ্ট হবে। সেই কেউটা কে তা কেউ জানেনা। কিন্তু সবাই অনুমান করতে পারে। অনুভব করতে পারে। যখন তীব্র ঝড়ে সব ধ্বংস হয়ে যায় তখন তারা তাকে অনুভব করে। যখন কোন রোগে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তখনও তারা সেই কেউ একজনের কাছেই আকুল আবেদন জানায়। সেই অসীম শক্তির প্রতি নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করতে চায়। আর মানব শিশুর চাইতে প্রিয় মানবের কাছে আর কি হতে পারে।
কিন্তু শিশুর মা কিছুতেই তার সন্তানকে বলি দিতে দিবেনা। তার মধ্যে পরম শক্তির উৎস নিয়ে কোন ভয় কাজ করছেনা। তার মধ্যে নিজের সন্তানের প্রতি তীব্র ভালোবাসা কাজ করছে। যেকোনো উপায়ে সে তার শিশুকে বাঁচাতে চায়। এতে যদি সেই পরম সত্ত্বা রেগে গিয়ে দুনিয়া ধ্বংস করে দেয় তাতেও তার কিছু যায় আসেনা। কিন্তু গতবার যখন আরেকজনের সন্তানকে বলি দেওয়া হয়েছিল তখন তার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি।
একজন দার্শনিকের ভাবনা
ভালোবাসা এবং নিষ্ঠুরতা একে অপরের হাত ধরে চলে। মাঝেমাঝে ভালোবাসা থেকে নিষ্ঠুরতাকে আলাদা করা যায়না। যেমন একজন মা ভালোবেসে তার সন্তানকে সব কিছু অগ্রাহ্য করে বাঁচাতে চাচ্ছে। আবার কিছু মানুষ নিষ্ঠুর ভাবে তাকে হত্যা করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন চাচ্ছে? কারন তারা ভয় পাচ্ছে। তারা এক অজানা শক্তিকে ভয় পাচ্ছে। ভয়ের কারন তাদের উপর অভিশাপ আসতে পারে। তারা সেই ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে চাচ্ছে। কারন তারা নিজেদের জীবনকে খুব ভালোবাসে! তাদের নিষ্ঠুরতার উৎস তাদের ভালোবাসা।
জাদু এবং লীলা
সব মানুষ একরকম না। মানুষদের মধ্যে কেউ শক্তিশালী কেউ কম শক্তিশালী। স্বজাতি হলেও সবাই পরম সত্ত্বার প্রতিনিধিত্ব করেনা। যারা করে তাদেরকেই মেনে চলতে হবে। তাই আজ অনেক মানুষ সেই শক্তির প্রকাশ দেখতে এসেছে। একজন মানুষকে আজ জাদু দিয়ে সাপে পরিনত করা হবে। কিন্তু সাধারন মানুষ অন্য আরেকটি ব্যাপার নিয়েও বেশ চিন্তিত। নতুন এক লোক এসেছে তাদের মাঝে। সে এসব জাদু দেখানো ক্ষমতাধরদের ভয় পায়না। সে সম্পূর্ণ নতুন কথা বলছে। সে বলছে সব ক্ষমতা নিয়ে আসলে একজনই বসে আছেন। সব জাদু দেখানোর ক্ষমতা শুধু তারই। যেসব মানুষ জাদু দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছে তারা আসলে সেই পরম সত্ত্বার বিরোধিতাই করছে। এবং এ জন্য তাদের কঠিন পরিনাম ভোগ করতে হবে।
একজন ক্ষুধার্ত মানুষ সেখানে শুয়ে ছিল। সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল। জাদু দেখিয়ে কে কাকে নিয়ন্ত্রন করছে কিংবা পরম সত্ত্বা কে-এসব নিয়ে সে চিন্তিত ছিল না। তবে তার সামনে হঠাৎ করে কিছু খাওয়া চলে আসবে এই চিন্তাটা করতে বেশ ভালো লাগছে। এই জাদুর স্বপ্নটা সে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থেকেই দেখছে। কারন সবকিছু অগ্রাহ্য করে সে আসলে বাঁচতে চাচ্ছে। প্রবলভাবেই চাচ্ছে।
একজনের মনে জেগে ওঠা কিছু প্রশ্ন থেকে
এ কেমন জাদুর খেলা যা এক ক্ষুধার্থ মানুষকে খাবার দিতে পারেনা? মানুষ কি তবে শুধু অন্য মানুষকে ভয় দেখাতে কিংবা বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্যই জাদু দেখায়! আর যে পরম স্বত্বার এক এবং অদ্বিতীয় জাদুর কথা বলা হচ্ছে তা কি শুধুই ভয় দেখানোর খেলা? ভয় এবং ক্ষমতা একে অপরের পরিপূরক। কিছু মানুষের ভয় হচ্ছে কিছু মানুষের ক্ষমতার উৎস!
তোমাদের জন্য ভালোবাসা
মানুষকে ভালোবাসাই নাকি মুক্তির একমাত্র উপায়। এমন এক অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে এক অদ্ভুত মানুষ অনেকদিন থেকেই নগরবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সে বলেছে এমন এক পরম স্বত্বার কথা যে নাকি মানুষকে ভালোবাসতে বলেছে। কিন্তু তাকে এই ষড়যন্ত্রের জন্য আজ হত্যা করা হবে। তাই প্রচুর মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে তার হত্যা দৃশ্য দেখতে এসেছে। তাদের কারো মধ্যেই ভালোবাসা দেখা যাচ্ছেনা। বরং তাদের অতীত বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার এক তীব্র নিষ্ঠুরতাই তাদের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
সেখানে এক হাতকাটা লোক বসে আছে। অনেক আগে মিথ্যা চুরির অভিযোগে তার দুইহাত কেটে দেওয়া হয়। সে খুব নির্লিপ্তভাবেই এসব দৃশ্য দেখছে। তার জীবনে সব রকম নিষ্ঠুরতাই সে দেখে ফেলেছে। তাই ভালোবাসা, ঘৃণা নিষ্ঠুরতা এসবের কোন মানেই আজ তার কাছে নেই। তবে সে বেঁচে আছে। সে শুধু এতটুকুই জানে, এবং জানতে চায়!
একজন বাস্তববাদীর ভাবনা থেকে
ভালোবাসার জন্ম কোথা থেকে? একজন মানুষকে কারন ছাড়া ভালোবাসতে শেখানো হয়নি। কিছু কারনে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, আবার কিছু কারনে ঘৃণাও করে। কারন থাকলে অনুভুতিও থাকবে। কারন ভালোবাসার অস্তিত্ব থাকলে অবশ্যই ঘৃণার অস্তিত্বও থাকবে।
এক এবং অদ্বিতীয়
আজ একজনকে হত্যা করা হবে। তার দোষ তিনি নিজেকে ঈশ্বর বলেছেন। তিনি বলেছেন ঈশ্বর নাকি তার মধ্যে বাস করেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই তা বলতে পারেন না। কারন পরম স্বত্বা প্রতিনিধি দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন যে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। একমাত্র তার আরাধনাই করতে হবে। তাই যে মানুষ নিজের মধ্যে পরম স্বত্বাকে অনুসন্ধান করবে তাকে অবশ্যই নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে একমনে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করছে। সে কি বলছে তার অর্থ সে নিজেও জানেনা। কিন্তু সে জানে এসব উচ্চারন করলে কেউ তাকে কখনো হত্যা করবেনা!
একজন অনুসন্ধানকারীর ভাবনা থেকে
সত্য এবং মতবাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও এক না। মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য একটা সত্য লাগে। অর্থাৎ এমনকিছু যাকে মানুষ সত্য বলে ভাবতে বাধ্য হবে। কিন্তু মানুষ তখনই বাধ্য হয় যখন সে বিশ্বাস করে কিংবা ভয় পায়। তাই যারা বিশ্বাস করেনা, তাদেরকে ভয় দেখাতে হয়। যারা ভয় পায়না তাদের হত্যা করা হয়!
চক্র
হঠাৎ করে মুগ্ধের ভাবনায় ছেদ পড়ে। অনেক সময় চলে গেছে। তাকে এখন যেতে হবে। যার কাছে সব ধাঁধার উত্তর সেই রহস্যময় স্বত্বা তাকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। হয়তো মুগ্ধের অনুসন্ধান দেখে তিনিও আনন্দিত হয়েছেন। তাই আজ কিছু প্রশ্নের উত্তর তিনি মুগ্ধকে দিবেন।
কিন্তু মুগ্ধ বুঝতে পারে কারা যেন আসছে। যারা ধাঁধার উত্তর জানতে চায়না তারা অনেকদিন ধরেই মুগ্ধকে হত্যা করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই মুগ্ধ আড়ালে থেকেই তার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ সেই রহস্যময় সত্ত্বার কাছে যাওয়ার জন্য তাকে পথে নামতেই হয়েছে। কিন্তু ওরাও এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। মুগ্ধ তার সামনেই ওদের দেখতে পায়।সে বুঝে ফেলে তার সময় শেষ। তাকে এখন হত্যা করা হবে। তারা কেউ ধাঁধার উত্তর জানেনা। মুগ্ধকেও জানতে দিবেনা।
অদূরে কোথাও প্রবল বৃষ্টিতে দুটি শিশু একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। তাদের খুব ঠাণ্ডা লাগছে। তারা কাঁপছে। তাদের উষ্ণতা দরকার। আশ্রয় দরকার। কিন্তু তারা সেসব কিছু নিয়েই ভাবছেনা। তারা শুধু বৃষ্টি শেষ হবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২১