আজ বিকেলে মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগরের দিকে যাত্রা কালে রাস্তার বাম পাশে ব্রাক ব্যাংক এর নিচে একজন প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক নজরে আসলো আমার। রাস্তার যেখান দিয়ে মানুষ আপন ব্যস্ততায় চলাচল করে, ঠিক ঐখানে কেউ একজন তাকে শুইয়ে রেখে চলে গেছে। প্রতিবন্ধী লোকটির বয়স ৫০ এর উপরে হবে। তখন বিকাল ৫:৩৫ মিনিট এবং ঢাকা শহরের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি এর উপরে। যা রীতিমত অস্বাভাবিক বটে। লোকটি চিৎকার করে কান্না করে চলমান মানব-মানবীদের কাছে ভিক্ষা চাইছে। আমি খুব কাছ থেকে তার কান্নার আওয়াজ টা শুনতে চেয়েছিলাম। অনুধাবন করতে চেয়েছিলাম যে তা কতটা কষ্টের! পরিমাপ করতে চেয়েছিলাম তার কষ্টের গভীরতা।
কান্না ধরণ নিয়ে একটু চিন্তা করলাম। সাধারণত মানুষ তিন(৩)প্রকারের কান্না করে।
১/ স্বাভাবিক কান্নাঃ যা শুধু মাত্র কয়েক ফোঁটা পানি তার চোখের কোণে জ্বল জ্বল করে। যেখানে কন্দনরত ব্যক্তিটি চাইলেই তার এই কান্না রোধ করতে পারে। যে কারণে এটিকে আমরা লোক দেখানো কান্না বলতে পারি। কেননা এই কান্না চোখের ময়লা দূরীকরণে কাজ করে। সাধারণত, অতীতের কোন স্মৃতি মনে পড়ে গেলে বা নিকট বন্ধুর কাছ থেকে কষ্ট পেলে এই ধরনের কান্নার সৃষ্টি হয়।
২/ অস্বাভাবিক কান্নাঃ স্বাভাবিক কান্নার থেকে যতেষ্ট গভীর। এখানের কন্দনরত ব্যক্তিটির চোখে ক্রমাগত পানি ঝরতে থাকবে। তার চোখ-মুখে তার কান্নার গভীরতা প্রকাশ পায়। চামড়া সুন্দর এমন কেউ কাঁদলে তার চোখ-মুখ লাল আভা ধারন করে। কান্নার করতে করতে তার সর্দি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সাধারণত এই ধরণের কান্না সৃষ্টির ক্ষেতে মাঝারি ধরণের কোন অপরাধ বা নিরপরাধ বোধ কাজ করে। যেমন কোন মাঝারি চুরির অপবাদ কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে দিলে সে যেমন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কান্না করবে। এই ধরণের কান্নাকে মাঝারি বা অস্বাভাবিক কান্না বলতে পারি।
৩/ অন্তনিহীত কান্নাঃ এটি কান্নার প্রকারভেদের মধ্যে সব থেকে কষ্টদ্বায়ক কান্না। এখানে অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, এই কান্না চলমান অবস্থায় একটা সময় এসে ব্যক্তির চোখের পানি শুকিয়ে যায়। কিন্তু তার বুকফাটার আর্তনাদ চলতেই থাকে। যেমন, দুটি উদাহরণের মাধ্যমে তার সঠিক ধারণা আমরা পেতে পারি।
উদাহরণ নং-১= মা-বাবা জীবিত থাকাকালীন তাদের লালীত সন্তান, যে কিনা কিছুদিন হল ভালো করে হাটতে শিখেছে। একদিন মা এর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চা সন্তানটি পুকুরের পানিতে নেমে গেলো এবং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় বাচ্চাটি তার অন্তিম নিশ্বাস ঐ পুকুরের পানিতে ত্যাগ করতে হল। যখন মা খবর পেল যে এই মাত্র তার সামনে নেচে-গেয়ে যাওয়া তার আদরের সন্তানটি আর বেঁচে নেই। তখন এ মায়ের কান্নার ধরণে কেমন হবে ভেবে দেখুন। বুকফাটা আর্দনাদে সারা জাহান কেপে উঠে।
উদাহরণ নং-২= এই জাতীয় কান্না সাধারণত জীবনের চলমান কষ্টকে নিয়ে হয়ে থাকে। যেমন একজন প্রতিবন্ধী যার হাত-পা আমাদের মত নয়। দেখা যায় তার হাতের দৈঘ্য আমাদের হাতের আঙ্গুলী থেকে কজ্বির দৈঘ্যের সমান। সুতরাং তার পা কেমন হতে পারে আপনারা অনুধাবণ করতে পারছেন। কারণ, আমাদের চলমান জীবনে এমন চিত্র আমরা হার-হামেশায় দেখে থাকি।
আচ্ছা, এই অংশের আলোচনা এখানেই শেষ করা যাক।
যে কারনে কান্নার ধরণ নিয়ে এত গভেষণা, এই ব্যক্তিটি ও সন্তান হারা মা এর কান্নার ধরণ অন্য সব কান্নার থেকে অধিকতর গভীরতর । কান্না করার সময় দেখা যায় তাদের চোখের জ্বল তেমন গড়িয়ে পড়ছে না। তবে, উচ্চস্বরে কান্না করে যাচ্ছে। এবং তাদের কান্নার আওয়াজগুলি একদম পেটের গভীর থেকে গভীরতর বাতাস এর সাথে বের হয়ে আসছে। আমার ভাষায়, এটাই হল জগতের সবচেয়ে কষ্টদায়ক কান্নার বহিঃপ্রকাশ। সেই প্রতিবন্ধী যে সেই বিকাল বেলায় দুই টাকার জন্য রাস্তার পাশ্বে জীবনের জগন্য কষ্টদায়ক সময় পার করছে। যেই গরমে আমরা সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, সেই গরমেও তারা শুধু মাত্র বেঁছে থাকার তাগিদে দুই টাকার জন্য হাত পেতে থাকে। কিন্তু যখন আশাবাঞ্জক প্রতিদান পায় না। তখন, কি তার এই কষ্টদ্বায়ক জীবনের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয় না?
তখন একটু ভাবলে সত্যি অবাক লাগে যে, ১২ টাকায় একটা বেনসন কিনে আমরা যদি তার এক-চতুথাংশ ও ফেলে দেই, তার মানে হচ্ছে আমরা তিন টাকার খাটি অপচয় করলাম। কিন্তু দেখা যায় রাস্তার পার্শ্বে বা বাসে-ট্রেনে কোন ফকীর বা ছোট বাচ্চা শিশু টাকা ভিক্ষা চাইলো। আমরা পকেটে ২ টাকার ভাংতি নোট টা খুজে পাই না। বলি-“যাও পরে আসো, বা ভাংতি নেই”। একবার যদি আমরা এমন করে ভাবতে পারতাম যে “যদি সৃষ্টিকর্তা আমাকে আমার মায়ের গর্ভে এই হাল করে আমাকে জন্ম দিতেন, যদি আমার স্বচ্ছল পরিবার আমাকে এই ভাবে ওদের মতো একটি ফোটলার মতো করে উত্তরার রাজলক্ষীর ওভার ব্রীজ এর উপর রেখে চলে আসতেন। যেখানে, মাত্র পাচঁ মিনিটেই আমার এই প্রতিবন্ধী শরীর উপরের সূর্য়ের তাপে লাল হতো এবং ব্রীজের লোহার গরমে আমি কামারের হাতে থাকা লোহার টুকরায় পরিণত হতাম, তখন আমার কেমন লাগত!”
বিঃদ্রঃ আপাতত এখানেই শেষ করলাম। লেখাটি হয়ত সঠিক ফর্মূলায় সাজাতে পারিনি।
কারণ এত দীর্ঘ লেখা আমার এই প্রথম।