সারচু টু লেহ'র পর থেকে...
ট্যুরে গেলে যে দায়িত্বটা কেউ স্বেচ্ছায় নিতে চায়না সেটা হলো টাকা-পয়সা হিসেবের দায়ভার। আমাদের গ্রুপে প্রতিবারই এই গুরুদায়িত্ব আয়াজকে গছানো হয়। কারণ দুটো। প্রথমত- ছেলেটা দারুণ ধর্মপ্রাণ; হিসেবে কোন ভেজাল করলে হাশরের ময়দানে অনেক নেকি ছিনিয়ে নিতে পারবো! দ্বিতীয়ত- হিসেবে ওর ভুল হয়না। অনেক সময় ওর নোটপ্যাডে টাকার হিসেব দুই দশমিক ঘর পর্যন্ত চলে যায়!
বিনামূল্যে আরেকটা সেবা আয়াজ সবসময়ই দেয়। কোন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার আগে জায়গাটা নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করে যায় ( যারা ওকে চিনেন তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ আর নতুন কি!)। আর সেই পড়ালেখার ফলস্বরূপ ট্যুরের নানা সময়-অসময়ে আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যায় নানা “ফান-ফ্যাক্ট” এর ঝড়। ওর ঝুলিতে লেহ শহর নিয়েও অনেক অনেক গল্প ছিল। বাকি সব গল্প মাথা থেকে উবে গেলেও একটা তথ্য মাথায় গেঁথে গিয়েছিল- লেহ তে তিব্বতীয়ান বুদ্ধিস্ট ছাড়াও অনেক মুসলিম এর বাস। যেখানে মুসলিম সেখানে ননভেজ- এটা বুঝার জন্য চাচা চৌধুরী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দুটো রাত এবং পুরো একটা দিন লেহ তে বিশ্রাম নিবো... অতএব, বাকি রাস্তা জাবর কাটার মতো আমিষ উদরজাত না করে লেহ ছাড়ছি না!
কিন্তু কে বোঝে মওলার আলেকবাজি! কে জানতো(!), সেই একটা দিনেই লেহ তে “Dry Day” থাকবে……
২৫.০৭.১৪ (রাত)
লেহ তে পা রেখেই প্রথম দুঃসংবাদ- যে হোটেলে থাকার কথা ছিল সেখানে জায়গা নেই। বেশ গলি-ঘুঁপচি পেরিয়ে জায়গা হলো ‘ওপ-পো’ নামক গেস্ট হাউজে। থাকার ব্যাবস্থা বেশ ভালো। বড়সড় রুম, শৌচাগার দারুণ। বিরক্তির কারণ বলতে শুধু একটাই- গেস্ট হাউজের মালিক ঋষি কাপুর (আসল নাম জানিনা। লোকটার দেহাবয়বের কারণে আয়াজ এই নাম দিয়েছে।)। লোকটার বিশাল বপুর প্রতিটা কোষ বিরক্তিকর। গাত্রবর্ণ দেখে আমরা তামিল কিনা জিজ্ঞেস করলেন। এরপর লাগলেন বাংলাদেশ নিয়ে। লেহ তে আমাদের দু-রাত অবস্থানকালে তাকে কমপক্ষে দশবার বুঝাতে হয়েছে যে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটা দেশ আছে, যেটা তাদের প্রতিবেশি।
এদিকে অল্টিচিউড সিকনেসে রাবা আর আশফাকের মুমূর্ষু অবস্থা (ওদের দুরবস্থা দেখে নিজেকে হি-ম্যান ভেবে কিছুটা পরিতৃপ্তি যে পাইনি তা না!)। শীঘ্রই দানাপানি না পেলে খান সাহেবের কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। যে বাঙালী হোটেলে থাকার কথা ছিল ওরাই রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করে দিল। অমিত বাগচী নামে কোলকাতার এক ভদ্রলোক হোটেলের দেখাশুনা করেন। লোকটা কোলকাতার সিরিয়ালের অ্যাকসেন্টে লেহ’র সৌন্দর্য বর্ণনা করে চললেন, “দাদা, এক জায়গায় এমন তিন রঙের পাহাড় আর কোথায় পাবেন বলুন!”। ক্লান্ত শরীরে অনেক কষ্টে হাসি চাপলাম। সে যাইহোক, হোটেলটার প্রতি সব আক্রোশ চলে গেল যখন রাতের খাবারে মুরগীর আয়োজন দেখলাম। আহ, নন-ভেজ! কয়েকটা আপেল গাছের নীচে পাতা চেয়ার-টেবিলে বসে উদরপূর্তি হলো।
আমাদের গেস্ট হাউজে কোন টেলিভিশন নেই। তাই বেশ আগে আগেই ঘুমাতে গেলাম।
২৬.০৭.১৪
‘ড্রাই-ডে’ হচ্ছে গৃহপালিত পশু-পাখিদের ঈদের দিন। সেদিন ওদের ঘাঁটানো নিষিদ্ধ। অতএব পুরো লেহ শহরে আজ নন-ভেজ নেই। সকালের নাস্তা সারলাম লেহ বাজারের ভেতরের এক ধাবায়। মেন্যু- আলু পরোটা আর ডাল। আলমের অবস্থা সংকটপূর্ণ। বাকি সবাই যখন পেট ভরানোর দায়ে হলেও কিছু না কিছু চিবায়, বেচারা তখন তার ভেজ-থালির দিকে তাকিয়েই থাকে। নাস্তা শেষে ঘুরতে বের হলাম। আগের দিনের ষোল ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে রাহুল ভাই বেশ ক্লান্ত। তাই নতুন একজন ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেইসঙ্গে পেয়ে গেলাম ঝাঁ চকচকে একটা ট্রাভেলার্স কার। নতুন ড্রাইভার ক্লাসিক সব হিন্দি গানের কালেকশন খুলে বসলো। আমরা রওনা হলাম সিন্ধু ঘাটের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি লেহ’র রাস্তায় উঠলো। মাথার উপর চড়েছে গনগনে সূর্য। সবুজ-শূন্য পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট-ছোট বাড়িঘর। লিটল-তিব্বত নামের সার্থকতা রাখতেই যেন জায়গায় জায়গায় তিব্বতী সংস্কৃতির ছাপ। রাস্তার ধারে বড় বড় প্রেয়ার হুইল। লেহ’র মূল প্রবেশদ্বারে রয়েছে দারুণ কারুকার্য। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা লাদাখের সবচেয়ে বড় শহরের বাইরে চলে আসলাম।
প্রথমবার দিনের আলোয় লেহ কে দেখলাম। চারিদিকে কেবল ধুসর আর ধুসর, সবুজ একেবারে বিরল। প্রথম-দর্শনেই মনে হল ‘দেশে বিদেশে’ বইতে সৈয়দ মুজতবা আলীর বর্ণনার কাবুলে এসে পড়েছি! গুরুর বর্ণনাই ধার করি,
“ছলছল করে কাবুল নদী বাঁক নিয়ে এক পাশ চলে গিয়েছেন- ডানদিকে এক ফালি সবুজ আঁচল লুটিয়ে পড়েছে। পলিমাটি জমে গিয়ে যেটুকু মেঠো রসের সৃষ্টি হয়েছে তারি উপরে ভুখা দেশ ফসল ফলিয়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম; মনে হল ভিজে সবুজ নেকড়া দিয়ে কাবুল নদী আমার চোখের জ্বালা ঘুচিয়ে দিলেন। মনে হল ঐ সবুজটুকুর কল্যাণে সে-যাত্রা আমার চোখ দুটি বেঁচে গেল।”- দেশে বিদেশে
স্রেফ কাবুল নদীর জায়গায় সিন্ধু নদ বসিয়ে নিন-তাহলেই লেহ’র একটা ছবি পেয়ে যাবেন। সিন্ধুতীরের একটুখানি সবুজ বাদ দিলে বাকি জায়গাটা দৃষ্টিপীড়ার কারণ।
লেহ পৃথিবীর উচ্চতম শীতল মরুভূমিগুলোর মধ্যে একটা। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা সাড়ে এগারো হাজার ফিট। আকাশপথে যারা এখানে আসেন উচ্চতার সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের কয়েকদিন সময় লেগে যায়। আমাদের অবস্থা সে তুলনায় বেশ ভালোই। আগের দিন সাড়ে সতের হাজার ফিট উচ্চতার পাস অতিক্রম করে এসেছি বলে এই উচ্চতা খুব একটা গায়েই লাগছিলো না।
সিন্ধু ঘাট শে’ গ্রামের কাছাকাছি একটা ঘাট। পানির গভীরতা খুব বেশী না হলেও স্রোত বেশ শক্তিশালী। র্যাফটিং এর জন্য আদর্শ জায়গা। জায়গাটা বিখ্যাত লাদাখের বাসন্তী উৎসব ‘সিন্ধু দর্শন’ এর ভেন্যু হিসেবে। এছাড়া তেমন দর্শনীয় কিছু নেই। সূর্যের তেজটা বেড়েই চলেছে। সিন্ধুর হিমশীতল পানিতে পা ডুবাতেই হলো......
সিন্ধু- ঘাট
পরবর্তী গন্তব্য “Druk White Lotus School”। স্কুলটা অধিক পরিচিত থ্রি-ইডিয়টসের স্কুল হিসেবে।থ্রি-ইডিয়টস মুভির শেষভাগে বাচ্চাদের যে স্কুলটি দেখানো হয় এটিই সেই স্কুল। মুভিটার কল্যাণে জায়গাটা এখন জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। ঢোকার পথেই এক টুকরা কাগজে লেখা দেখলাম, ‘আজ ছুটি। স্কুলের সবাই পিকনিকে গিয়েছে।’। একদিক দিয়ে ভালোই হল। পুরা ক্যাম্পাসটা ফাঁকা পেয়ে গেলাম।
স্কুলের ভেতরটা
তিব্বতী সংস্কৃতির সাথে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান- এটাই ছিল স্কুলটি নির্মানের লক্ষ্য। সে পথে স্কুলটি বেশ ভালোভাবেই আগাচ্ছে। নির্মানকাজ পুরোটা এখনো শেষ হয়নি। স্কুলে ঢোকার পথে প্রথমেই চোখে পড়ে র্যাঞ্চোর ক্যাফে (থ্রি-ইডিয়টসের নায়কের নামানুসারে)। আড্ডা দেয়ার জন্য দারুণ একটা জায়গা!
অনেকগুলো ছোট ছোট দালান নিয়ে স্কুল। একটা ক্লাসের ভেতরে উঁকি দিয়েই বুঝলাম বাচ্চারা এখানে অনেক সুখে আছে। পাথুরে দালানের ভেতরটা রঙে ভরপুর। ফাঁকিবাজ ছাত্রদের জন্যও আছে সময় কাটানোর দারুণ সুযোগ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে নয়নাভিরাম পাহাড়ের সারি। সত্যি বলতে, কিছুটা ঈর্ষাই অনুভব করলাম স্কুলের বাচ্চাগুলোর প্রতি।
ক্লাসের ভেতরটা
ক্লাসের বাইরে
থ্রি-ইডিয়টসের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কিছু আপত্তিকর ফটোসেশন হলো......
চতুর রামালিঙ্গামের মূত্র-বিসর্জনের দৃশ্যটা মনে আছেতো?
স্কুলের একদম কাছেই বিখ্যাত শে প্যালেস। প্যালেস না বলে প্যালেসের ধ্বংসাবশেষ বলাই ভালো। আগে একসময় হয়তো প্রাসাদসুলভ জৌলুস ছিল- শে যখন লাদাখের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। এখন তার কিছুই বাকি নেই। গ্রীষ্মের সময়টা এখানেই কাটাতেন লাদাখের রাজা নামগালরা। নামগালের আদেশেই বানানো হয় এই প্রাসাদ। সেটাও প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগের কাহিনী। পরে জম্মুর দোগ্রাদের আক্রমণে প্রাসাদ ছেড়ে সিন্ধুর ওপারে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয় নামগালরা। তাদের নতুন আশ্রয় হয় স্তোক প্যালেস। সেই সাথে লাদাখ অঞ্চলের রাজধানীও 'শে' থেকে 'লেহ' তে স্থানান্তরিত হয়।
শে প্যালেস
পাথুরে প্রাসাদটার উপরে উঠে গেলে সিন্ধু উপত্যকা পুরোটা নজরে আসে। নয়নাভিরাম দৃশ্য। অবশ্য সূর্যের অত্যাচারে বেশীক্ষণ হাঁটাচলা করা দায়।
শে প্যালেসের উপর থেকে সিন্ধু উপত্যকা
প্যালেসের ভেতরে আছে গৌতম বুদ্ধের সুবিশাল এক তাম্রমূর্তি। মূর্তির উপরিভাগ সোনায় মোড়া। উচ্চতায় সাড়ে সাত মিটার। মনেস্ট্রির প্রবেশপথে প্যালেসের ইতিহাস লেখা আছে একটা বোর্ডে। সেখানে দাবি করা হয়েছে পুরো লাদাখে এরকম বুদ্ধমূর্তি আর একটাও নেই।
তামার বুদ্ধমূর্তি
দুপুরের খাবার খেতে লেহ বাজারের সেই ধাবায় ফিরে আসলাম। ভেজ খাবারের বিস্তারিত লেখার উৎসাহ পাচ্ছি না। কোনমতে গিলে ছুটলাম সাইবার ক্যাফের সন্ধানে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক আমরা মানালী ছাড়ার পরেই হারিয়েছি। লাদাখে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং কাজ করেনা। প্রায় তিনদিন বাসায় আপডেট যায়নি, আজকে যোগাযোগ করাটা জরুরী।
পেলাম একটা সাইবার ক্যাফে। ভাইবোনদের ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলাম। ওপার থেকে বড়বোনের প্রথম প্রশ্ন, “তুই কি আরও কালো হইছিস?”। সঙ্গে সঙ্গে সকল হোমসিকনেস চলে গেল; থ্যাঙ্কস টু মাই রেসিস্ট ফ্যামিলি। ফুরফুরে মেজাজে লেহ বাজারটা ঘুরতে বেরোলাম।
একসময়ের ব্যবসা-কেন্দ্র লেহ এখন পুরোদস্তুর পর্যটন এলাকা। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে বাদামী চামড়ার চেয়ে সাদা চামড়ার পর্যটক অনেক বেশী! জুলাই মাসের গরমে তাদের পোশাক-আশাকেও বাড়াবাড়ি নেই। বিস্তারিত কাহিনী পাঠকের কল্পনাশক্তির উপর ছেড়ে দিচ্ছি...... তবে হ্যাঁ, লেহ’র রাস্তায় হাঁটার সময় আমাদের চোখ সর্বদাই বেশ সতর্ক ছিল।
লেহ বাজারের বেশিরভাগ দোকানই স্যুভেনির শপ বা শীতবস্ত্রের দোকান। মাত্র দিন দশেক আগে দালাই লামা লেহ ঘুরে গেছেন বলে এখনো উনার ব্যানার পোস্টার আছে। হাঁটতে হাঁটতে দারুণ এক নোটিশবোর্ডের দেখা পেলাম। যারা ছোট দল নিয়ে লেহ তে এসেছে তারা আরো ভ্রমণসঙ্গী চেয়ে নোটিশ দিয়েছে। একেকটা কি লোভনীয় ট্রেক! দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে লাদাখের অনেক জায়গায় আমরা আমন্ত্রিত না। পাকিস্থানী, চায়নিজ দের পাশাপাশী বাংলাদেশীদের জন্যেও অনেক জায়গায় যাওয়া নিষেধ। প্যাংগং লেক, সো-মোরিরির মত অসাধারণ সব জায়গায় ইনার পারমিট ছাড়া যাওয়ার নিয়ম নেই। সেই ইনার পারমিট পেতে আবার মাস দুয়েক আগে আবেদন করতে হয়।
বাজারের উপর দিকে দেখা পেলাম ঐতিহাসিক লেহ জামা মসজিদের। মসজিদের বয়স সাড়ে তিনশো বছরের মত। মসজিদটা লেহ'র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষী। একই জায়গায় পাশাপাশী দাঁড়িয়ে আছে তিব্বতী বুদ্ধিস্টদের 'লে প্যালেস' আর সুন্নী মুসলিমদের 'জামা মসজিদ'; অসাধারণ একটা ব্যপার! লাদাখের শাসক নামগল আর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মধ্যে সমঝোতায় তৈরী হয় এই মসজিদ। লাদাখী রাজবংশের সাথে মুঘলদের বিশেষ চুক্তি হয়। নির্দিষ্ট শুল্কের বিনিময়ে লাদাখ পায় মঙ্গোল দস্যুদের হাত থেকে মুঘলদের নিরাপত্তা। এই সমঝোতার নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে মসজিদটি। মসজিদের ডিজাইনেও তাই তিব্বতী এবং মুঘল আর্কিটেকচারের মিশ্রণ। চমৎকার নকশা ভেতরটায়; বিমগুলো কাঠের তৈরী। আসরের নামাজটা জামাতে পড়ার সুযোগ হলো।
লেহ জুমা মসজিদ
মসজিদের বিপরীতে অনেকগুলো স্যুভেনির শপ। জিনিসপত্রের দাম চড়া। কিছু কেনার ইচ্ছা ছিলোনা, তবু সুন্দরী দোকানীকে দেখে ঢুকে পড়লাম একটা দোকানে। সুন্দরীর কথায় ইয়ক এর শিং খোদাই করে বানানো একটা চাবির রিং কিনলাম। প্রথমে একটু দ্বিধায় ভুগলেও পরে মেনে নিলাম- সুন্দরী যেহেতু বলেছে এটা ইয়ক এর শিং, তবে অবশ্যই এটা ইয়ক এর শিং। সাথে দুটো পুরোনো পোস্টকার্ড কিনলাম।
দোকানে থেকে বের হয়ে পাশের স্যুভেনির শপে আদিত্যকে দেখলাম। আদিত্য পাবনা ক্যাডেট কলেজের মান ডুবিয়ে রীতিমত এক অপ্সরীর সাথে স্যুভেনির নিয়ে গল্প জুড়েছে। বাড়িয়ে বলছি না, মেয়েটা পুরো লাদাখে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী! লেহ'র বৈরী পরিবেশও তার গায়ে বিন্ধুমাত্র আঁচড় দিতে পারেনি। অতএব, আমাকেও সেই দোকানে ঢুকতে হলো। ঢুকেই বুঝতে পারলাম দোকানীর সৌন্দর্যের সাথে স্যুভেনিরের দাম সমানুপাতিক হারে বাড়ে। আদিত্য দামাদামীতে আমার সাহায্য চাইলো। আমি কিছুক্ষণ বঙ্গবাজার টাইপ দামাদামীর পর আদিত্যকে রেখে বেরিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে দুই মহিলার ব্যাপক চিৎকার- চ্যাঁচ্যামেচি শুনে ফিরে তাকালাম। দেখলাম লাদাখী ভাষার শব্দভান্ডার উজাড় করে দিয়ে আদিত্যকে গালীগালাজ করছে অপ্সরী ও তার মা। এতক্ষণ দামাদামী করে কিছু না কেনায় ক্ষেপেছে দুজন। আর ওকে এভাবে ফেলে চলে আসায় আমাকে গালিগালাজ করছে আদিত্য। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, অনেক বছর পর আদিত্য যখন ওর দত্তক নেয়া বাচ্চা-কাচ্চাদের 'দুই বন্ধু ও ভাল্লুক' এর গল্পটা শোনাবে, সেই গল্পে গাছে চড়ে বসা বন্ধুটার নাম হতে যাচ্ছে রাশেদ। ড্যুড, আমি দুঃখিত।
লেহ প্যালেসের নীচে নাদুস-নুদুস অহিংস কুকুরের দল
মসজিদের পাশের গলি দিয়ে লেহ প্যালেসের রাস্তা। সাবেক দালাই লামাদের প্রধান বাসস্থান পোটালা প্যালেসের অনুকরণে বানানো হয় লেহ প্যালেস। নয়তলা সমান উঁচু এই স্থাপনা লেহ'র যেকোনো অংশ থেকে দেখা যায়। বানানোর সময় এটিই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিল্ডিং ( এটা ইন্ডিয়ান আর্কিওলজিকাল সার্ভের দাবি। গাঁজাখুরি কিনা জানি না)। প্রাসাদের উপর থেকে পুরো লেহ শহরের প্যানোরামা পাওয়া যায়। শহরের একপাশে অনেক সবুজ আর অন্যপাশ খাঁ খাঁ মরুভূমি। বহুদূরে দেখা যায় বরফ ছাওয়া স্তোক কাংড়ির বিশ হাজার ফিট উঁচু চূঁড়া ।
লেহ প্যালেসের উপর থেকে লেহ শহরের দু-পাশ
ফুলের নাম জানিনা
বহুদূরে স্তোক কাংড়ির বিশ হাজার ফিট উঁচু চূঁড়া। পাশেই গোলেপ কাংড়ি এবং সাসের কাংড়ি
রাতের খাবারের সময় এলে সবাই মুষড়ে পড়লাম আবার। 'ভেজ' শব্দটা শুনলেই আঁতকে উঠি। শেষে আর টিকতে না পেরে রাহুল ভাইকে ধরলাম নতুন কিছুর ব্যাবস্থা করতে। রাহুল ভাই "নতুন" কিছুরই ব্যবস্থা করলেন...
শহরের বাইরের এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলেন রাহুল ভাই। খাবারের চেহারা দেখে মনে হল ফ্রেঞ্চ গিয়েনার কয়েদিরাও নিশ্চয়ই এ চেয়ে ভালো খাবার পেত! নাইলনের দড়ির চেয়েও শক্ত চাওমিনের কথা নাহয় বাদই দিলাম... এঁটো পানির ন্যায় স্যুপে প্রথম চুমুক দিয়েই ইচ্ছে হল দুহাত তুলে আত্মসমর্পন করে ফেলতে।
মুজতবা আলীর প্রতি ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছি। মনে পড়ছে গুরুর জন্য ভৃত্য আগা আবদুর রহমানের বানানো খাবারের তালিকা-
“পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্কাথে সেরখানেক দুম্বার মাংস- তার মাঝে মাঝে কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে, এক কোণে একটি আলু অপাংক্তেয় হওয়ার দুঃখে ডুবে মরার চেষ্টা করছে। আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক ফুল বোম্বাই সাইজের শামী-কাবাব। বারকোশ পরিমাণ থালায় এক ঝুড়ি কোফতা- পোলাও আর তার উপরে বসে আছে একটি আস্ত মুর্গি-রোস্ট।” - দেশে বিদেশে
যাইহোক, জনসাধারণের জন্য ছোট্ট একটা উপদেশ দিয়ে রাখি। ইন্ডিয়ায় কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে চাইলে দোকানে ভুলেও "ড্রিঙ্কস" চাইবেন না। দোকানীকে "ঠান্ডা" দিতে বলবেন। নতুবা সুরার পাত্র ধরিয়ে দিবে হাতে। আমরা ড্রাই-ডে তে অতি অল্পের জন্য বিশাল কেলেঙ্কারীর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম।
ক্ষুধার্ত পেট লেহ'র আকাশ দেখে ভরালাম। কখনো লেহ গেলে রাতের আকাশটা ভালো করে দেখার সুযোগ ছাড়বেন না ভুলেও।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্যদের রুমে ঢুঁ মারতে গেলাম। রুমে ঢুকতেই নোয়েল-রাবা গেয়ে উঠলো “ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। মনে পড়লো ঈদের মাত্র দুই বা তিন দিন বাকি। জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। পুরো ট্যুরে এই প্রথমবার বাড়ির জন্য খারাপ লাগা শুরু হলো। দেশের বাইরে ঈদ করছি- ব্যপারটা এই প্রথম বড়সড় ধাক্কা দিলো...
“সমস্ত দিন দেখেছি অজানা ফুল, অজানা গাছ, আধাচেনা মানুষ, আর অচেনার চেয়েও পীড়াদায়ক অপ্রিয়দর্শন শুষ্ক কঠিন পর্বত। হঠাৎ চেনা সপ্তর্ষি দেখে সমস্ত দেহমন জুড়ে দেশের চেনা ঘর-বাড়ির জন্য কি এক আকুল আগ্রহের আঁকুবাঁকু ছড়িয়ে পড়ল।
স্বপ্নে দেখলুম, মা এষার নামাজ পড়ে উত্তরের দাওয়ায় বসে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে আছেন।” -দেশে বিদেশে
মূল লেখা এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:৪৪