নিঃসীম নীলিমায় বিলীন হয়ে গেলেন নীরা, সন্তু, কাকাবাবুর স্রষ্টা এবং সেইসময়, পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো, মনের মানুষ, অর্ধেক জীবনের রচয়িতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বৃহষ্পতিবার দুপুর দুটো নাগাদ কেওড়াতলা মহাশ্মশানের বৈদ্যুতিন চুল্লিতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তার নশ্বর দেহ। মুহূর্তে শোকের এক করুণ আর্তি আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল।
রবীন্দ্রসদন থেকে সাহিত্য আকাদেমি হয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত শেষযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিশিষ্ট লেখক ও সুনীলের অসংখ্য অনুগামী মানুষ। জনসমুদ্রে ভেসে কবির মরদেহ পৌঁছেছিল কেওড়াতলায়। শেষ কৃত্য অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ষেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মেয়র শোখনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। রবীন্দ্রসদনে সুনীলকে শেষ শ্রদ্ধা জানতে সকল স্তরের মানুষ এসেছিলেন। মরদেহের মাথার কাছে ছিলেন স্ত্রী স্বাতী ও পুত্র শৌভিক এবং পরিবারের ঘনিষ্টরা। সুনীলের মরদেহের পাশে সমসময় রাখা ছিল তারই তৈরি কৃত্তিবাস পত্রিকা। রাজ্যের দুই মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানান সকলে।
বিচারপতি থেকে শুরু করে ক্রীড়া জগতের বিশিষ্টরাও এসেছিলেন। দল-মত-পথ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাদের প্রিয় লেখককে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচর্য্য এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দপিু মণির পক্ষ থেকেও এদিন কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক দেওয়া হয় মরদেহে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, আতাউর খানসহ বেশ কয়েকজন লেখক ও পাঠক কলকাতায় এসে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এসেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই নেতা মঞ্জুকুমার মজুমদার, আরএসপি নেতা ক্ষিতি গোস্বামী, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেকে। শ্রদ্ধা জানান বাংলার বিশিষ্ট সকল মানুষ। এসেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, বাণী বসু, জয় গোস্বামী, শুভাপ্রসন্ন, বিভাস চক্রবর্তী, শাঁওলি মিত্র থেকে শুরু করে গ্রামবংলার অসংখ্য তরুন কবি ও লেখক।
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকেই রবীন্দ্রসদনের সামনে ছিল অগণিত মানুষের ভিড়। সকলেই তাদের প্রিয় লেখককে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন। এসেছিলেন নীরা, নিখিলেশ ও সন্তুর দলও। গত সোমবার রাত ২টো ৫ মিনিটে বাংলা সাহিত্য জগতের অভিভাবকের হঠাৎ করে নি:শব্দে চলে যাওয়ায় সকলে যেভাবে অসহায়তার সাগরে ভেসেছিলেন তা ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে কাটিয়ে উঠলেও বৃহষ্পতিবারের সকালে চারিদিকের বাতাস ভারি হয়েছিল শোকবিলাপে। বৃহষ্পতিবার সকাল ১০ টায় পিস হেভেনের শীতল কফিনে বরফশীতল কক্ষ থেকে সুনীলের দেহ বের করে আনা হয়। তখন সকলে গাইছিলেন সুনীলের প্রিয় রবীন্দ্রনাথের গানগুলি। এরপর তার নশ্বর দেহ নিয়ে এই প্রজন্মের কবি ও লেখকরা বেরিয়েছিলেন শেষযাত্রায়। সঙ্গে ছিলেন কবিপুত্র শৌভিক। প্রিয় লেখকের অনুগামী এবং তার ছত্রচ্ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা লেখক ও কবিরা কাধে কাধ মিলিয়ে সেই মরদেহকে তুলে দিয়েছিলেন শববাহী শকটে।
মরদেহে কাধ মিলিয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। তার পর শুরু হয় শোকযাত্রা। তবে সেই যাত্রা মাঝে মাঝেই থমকে গিয়েছিল তার অগণিত অনুগামীর ভিড়ে। প্রথমে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদীনের কর্মস্থল আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন বাংলার বিশিষ্ট লেখক ও তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। সেখানে এক আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেকেই তাদের অশ্রু ধরে রাখতে পারেন নি। অনেকের গলায় কি হারালাম সেই যন্ত্রণার বিচ্ছুরণ। সেখানে শ্রদ্ধা জানান এবিপি গ্রুপের প্রধান অভীক সরকার, সাহিত্যিক শংকর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ তার বহু সহকর্মী।
আনন্দবাজার অফিস থেকে সুনীলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্রসদনে। তার মরদেহ এক ঘন্টার কিছু বেশি সময় শায়িত রাখা ছিল রবীন্দ্রসদনে। রবীন্দ্রসদন থেকে বারোটার পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাহিত্য আকাদেমির কলকাতা আঞ্চলিক অফিসে। সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি ছিলেন তিনি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। সেখানে দিল্লি থেকে আগত সাহিত্য আকাদেমির আধিকারিকরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন মুণাল সেনও। এরপর তার দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কেওড়াতলা মহাশ্মশানে অন্ত্যেষ্টির জন্য।
প্রবলভাবে নাস্তিক সুনীল তার দেহ চিকিৎসা শিক্ষার কাজের জন্য দান করা ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবার দাহ করার পক্ষেই শেষপর্যন্ত মত দেন । তবে সুনীলের মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কোন শ্রাদ্ধবাসরের আয়োজন করা হবে না বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পরিবর্তে আয়োজন করা হবে স্মরণসভার।
সুত্র: মানব্জমিন