মায়ানমারের সাবেক রাজধানী 'ইয়াঙ্গুন' এর ডাবেইনে জন্মস্থান জুলফিকরের। পুরো নাম জুলফিকর আহমেদ শহিদ। জন্মগত সুত্রে একজন 'রোহিঙ্গা' মুসলিম শহিদ। চাচার কাছেই শোনা নামটা তাঁর মায়ের দেওয়া ছিলো। বাবা-মা কেমন ছিলো, তাদের চেহারার কেমন আকৃতি? সব কিছুই শহিদের কল্পনার অনেক বাইরে। ১১ মাস বয়স যখন তখন বাবা-মাকে হারাতে হয় শহিদের। অপরাধ ছিলো খাবার চুরি করার। শাস্তি ছিল নির্মম। স্বৈরাচারী কিছু সৈন্যরা বাবাকে পিটিয়ে মারলো যতক্ষণ জান ছিল শরীরে, আর মাকে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করে মারলো! এদেশের আকাশেও সূর্য ওঠে অন্যন্য দেশের মতই। এটা ভিন কোন গ্রহের অংশ নয়। এটা পৃথিবীরই একটা অংশ। তবে এদেশে মুসলমান হয়েই জন্ম নেওয়া টা যেন সব থেকে বড় অপরাধ। আর রহিঙ্গার ঘরে জন্ম নিলে তো কোন কথায় নাই সে হোক মুসলিম কিংবা হিন্দু তাঁর জীবন টা নরক। এ যেন, নরক থেকেই ভূমিষ্ঠ হওয়া কোন নবজাতক! এ এক বিভীষিকাময় জীবন। গন্তব্যহীন যাত্রাপথ।
পদে পদে মৃত্যুর আশংখা। তবুও হাতের মুঠোই জীবন টা কে নিয়ে ছুটে চলা এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। এখানে বিবাহের জন্য সরকারের অনুমুতি লাগে, পড়ালেখা তো অনেক দুরের কথা। রোহিঙ্গা পরিচয়ে এডমিশন মেলে না। ২ সন্তানের বেশি সন্তান জন্ম দিলে শাস্তি বরাদ্ধ! ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারে না।
কন্সট্রাকসনের কাজ করা লাগে, বাড়ি বাড়ি, রাস্তাঘাটে গরুর মত খাটা লাগে। হাল চাষ করার মতই সরকার এদের ব্যবহার করে যেকোনো নিম্নমানের কাজ গুলোতে। ভাসমান বাসস্থান আবার যেকোনো সময় হামলার আশংখা। সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ!
শহিদ তিন বছর যাবত এভাবেই সংসার করছে দুই সন্তান আর স্ত্রী জুলেখা কে নিয়ে। কাজ পাওয়া সহজ নয়, অত্যাচারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত তবুও ছোট ছোট কাজ করে এক দু বেলা খাবার জুটাচ্ছে স্ত্রী সন্তানের জন্য। রাখাইনদের মাঝে থেকে মুসলমানদের জীবন অতিবাহিত করা
যেন মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন।
এরই মাঝে সুচনা হলো এক কাল অধ্যায়ের।।
জুন মাস ২০১২-
৩/৪ জন রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারী ১ জন রাখাইন নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। যার ফলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো মায়ানমার আরও একবার। শুরু হয় রাখাইন-রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং রাখাইন মৌলবাদীরা রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে। দাউ দাউ করে জ্বলছে তখন রোহিঙ্গাদের ঘর বাড়ি। লাশের পর লাশ ছড়ানো ছিটানো চারিদিকে। শহিদ ছুটছে এখান থেকে সেখানে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে। কোথায় যাবে? নির্বিকার। ঝোপঝাড়ে পালিয়ে পালিয়ে দিনরাত পার করছে। প্রতিবেশী কেউ কেউ থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া বর্ডারে ছুটেছে। আবার কেউ বা বাংলাদেশ বর্ডারের দিকে। শহীদ কোন দিকে যাবে দিশেহারা। কূলকিনারা না পেয়ে শহিদ বাংলাদেশ বর্ডারের দিকে ছুটে গেলো। সেখানে দেখতে পেলো লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়! এত মানুষের ভিড় ভেঙ্গে চোরাই ভাবে বর্ডার ক্রস করা সহজ নয়।
যেতে পারলেও ওপারের জীবন টা কেমন হবে সেটাও অজানা। এত কিছু ভাবার সময় নাই শহিদের। সারা জীবনের গচ্ছিত বিশ হাজার টাকার মত সঙ্গে নিয়ে এসেছে শহীদ। শেষ সময়ে এটা যদি কোন কাজে লাগে! কিছু কিছু মানুষদের বিজিবি ঢুকিয়ে নিচ্ছে বিশেষ করে বাচ্চাদের। আবার অধিকাংশই ফিরিয়ে দিচ্ছে। অনেককেই খাবার বিলিয়ে সাহায্যও করছে তাঁরা।
২ দিন ২ রাত সেখানে ঠেলাঠেলির পর অবশেষে এক বিজিবির সামনাসামনি দাড়াতে পারলো শহিদ। খুব অনুরোধ করলো যাতে তাদের ঢুকতে দেয়। কিন্ত কোন লাভ হলো না। তাঁরা কিছুতেই পারবে না।
আরও একদিন পার হলো। সন্তান দুটো তিনদিন ধরে না খাওয়া। কি করবে শহিদ কিছুই ভেবে পায় না। অবশেষে এক দালালের দেখা মিললো। তবে জন প্রতি দশ হাজার করে চাই সে। শহিদের কাছে আছে বিশ হাজার টাকা। আর বিশ হাজার সে পাবে কোথায়? স্ত্রী জুলেখার দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত জুলেখা অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো ছেলে মেয়ে দুজনকেই ওপারে পাঠিয়ে দেবে। শহিদ দুই সন্তানের মাথায় হাত বোলায় আর দু চোখের অশ্রু ছেড়ে দেয়। একবার আকাশের দিকে তাকায় আরেকবার নিস্পাপ ছেলে দুটোর মুখের দিকে তাকায়। চিৎকার করে কাঁদে আর বলে "হে মালিক অন্তত এই দুই নিস্পাপ ছেলে দুটোকে দেখে রেখো। আকাশ টা রক্তিম হয়ে আছে। শেষ বিকেলের সূর্য টা ডুবু ডুবু প্রায়। ছেলে দুটো কে নিয়ে যাচ্ছে লোক টা। বাবা-মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখ আর বাচ্চা দুটির অবুঝ চোখের পানি, যেন আজ আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে!