পটভূমি ২০০১-২০০৩ সাল। মৌলবাদীদের রসনার রকম-সকম সবচেয়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলাম চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। কলেজটা মৌলবাদী সংগঠন শিবিরের অভয়ারণ্যই বলা চলে। এ যেন হীরক রাজার আরেক দেশ। শিবিরের নিয়ম কানুনের বাইরে একচূলও নড়া যাবেনা। ছাত্র-ছাত্রীরা ওদের কাছে যেন এক প্রকার কাঠের পুতুল।
যাই হোক, আমরা যখন ভর্তি হলাম তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। গ্রাম থেকে এস এস সি পাশ করে এসেছি। চট্টগ্রামের সামগ্রিক রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকাটাই স্বাভাবিক। হঠাত একদিন কলেজের একমাত্র হোস্টেলটিতে আর্মড পুলিশ দেখতে পাই। এদিক সেদিক খোচাখোচি করে জানতে পারি, সরকার অনেক আগেই হোস্টেলটি সিলগালা করে দিয়েছে। কারণটাও অনেকটা যৌক্তিক। চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত এইট মার্ডারের আসামীরা এখানেই থাকত। বহিরাগত সন্ত্রাসী। এছাড়া চট্টগ্রামের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার নাসিরের নিরাপদ আবাসস্থল ছিল এই হোস্টেল। যে কিনা শিক্ষাবিদ গোপালকৃষ্ঞ মুহুরি হত্যা মামলাসহ গোটা বিশ-তিরিশেক হত্যা মামলার আসামী। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে চাদাবাজিসহ একাধিক ধর্ষনের অভিযোগও রয়েছে।
নাসির এই হোস্টেলে বসেই চালিয়ে যেত তার অস্ত্র ব্যবসা। সহযোগী কলেজেরই শিবির ক্যাডাররা। যারা দিনের বেলা কচি কচি শিক্ষার্থীদের বয়ান করেন। জিহাদের শানে নজুল শোনান। ইসলামী বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। কোরআনের আয়াত কিংবা বোখারী-মুসলিম-তিরমিজী শরীফ থেকে কয়েকটা হাদীস এনে নবীন শিক্ষার্থীদের ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। তারাই আবার রাতের বেলা খুনী ধর্ষক নাসিরের তোষামোদিতে ব্যস্ত। তার অস্ত্র ব্যবসার সহযোগী! হায়রে জিহাদ! হায়রে ইসলামী আন্দোলন! কোরআন হাদীসের কোন জায়গায় এরকম লেখা আছে। আজ থেকে দশ বছর আগে মাথায় এ ধরণের প্রশ্ন ঘুরপাক খেত। উত্তর খুজে পেতাম না। এখন এসে বুঝতে পারি। ওটাও ছিল ওদের ভন্ডামির একটা রেসিপি।
এর মাস দুয়েক পরে হোস্টেল থেকে পুলিশ চলে যায়। সেদিন শিবির ক্যাম্পাসে আনন্দ মিছিল বের করে। সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। যেন এইমাত্র রাম লঙ্কা জয় করে ফিরল। কোনো রকম বরাদ্দ ছাড়াই নেতারা হুটহাট করে হোস্টেলে উঠে পড়ে। যেন মামা বাড়ির সম্পত্তি। একটি কলেজ প্রশাসন শিবিরের কাছে কিরকম অসহায় তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর।
এর সপ্তাহখানেক পর কলেজ থেকে একটি নোটিশ জারি হয়। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীর জন্য হোস্টেল বরাদ্দ দেওয়া হবে। ব্যাস। প্রশাসনের কাজ নোটিশ পর্যন্তই। বাকীটা শিবিরের হাতে। নিজেদের পছন্দের নবীন শিবির কর্মীদের সযতনে তুলে নেয় হোস্টেলে। আমরা যারা শিবিরের ধারে কাছে ভিড়িনি তারা হোস্টেলের জন্য আবেদন করার সাহসটুকুও হারিয়েছিলাম। স্বজনপ্রীতি কতপ্রকার ও কি কি তা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে প্রথমেই দেখার সৌভাগ্য হয় শিবিরের কাছ থেকে।
স্বজনপ্রীতির উদাহরণ শুধু এটাই নয়। আরও একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। ঘটনাটা যদিও আরও কিছুদিন পরের। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে এখানে না টেনে পারছি না। কলেজের হোস্টেলে যখন থাকতে পারলাম না তখন আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা রুম ভাড়া নিই চকবাজারে। ওই ফ্ল্যাটে অবশ্য আরো দু’টি রুম ছিল। সেখানে কারা থাকত। কি তাদের পরিচয়। তাদের কর্মকান্ড নিয়ে আগামী পর্বে বিবরণ দেব। যাই হোক, বলছিলাম স্বজনপ্রীতি নিয়ে। আমাদের ওই ফ্ল্যাটের বাড়িওয়ালা জামায়াতের বড় নেতা। চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর। তিনি বেসরকারী একটা কলেজের অধ্যাপকও বটে। তখন জোট সরকার মাত্র ক্ষমতায় এসেছে। জামায়াত-শিবিরের পা আর মাটিতে পড়েনা। এমন একদিনের ঘটনা। আমার এক রুমমেটের বাবা এসেছেন গ্রাম থেকে। স্বভাবতই তিনি চাইলেন, ছেলেগুলো এখানে অভিভাবকহীন অবস্থায় থাকে। তাই বাড়িওয়ালার সাথে একটু দেখা করে যাই। আমিও তাদের সাথে গেলাম বাড়িওয়ালার বাসায়। হঠাত দেখি এলাকার এক শিবির ক্যাডার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আমির সাহেবের কাছে। জানালো, অন্য এক শিবির ক্যাডারকে পুলিশ ধরেছে। কারণ সে চকবাজারে এক রিকশাওয়ালার মাথা ফাটিয়েছে। আমির সাহের একমূহুর্ত সময় না নিয়েই ফোন করেন চকবাজার পুলিশ ক্যাম্পে। ছাড়িয়ে দেন সাধের পুত্রধনকে। আমি অবাক হই। রুমমেটের বাবা আমার দিকে তাকিয়ে রয়। নিচে এসে আমাকে বলেন, এরা মানুষকে ধর্মবাণী শোনায়! রিকশাওয়ালাটার কথা একটুও ভাবলেন না আমির সাহেব। আজ যদি কোনো শিবির ক্যাডার আমার ছেলেটার মাথা ফাটায় তখনো কি একই ভূমিকা রাখবেন তিনি? না বাবা, তোমোদের স্থানীয় অভিভাবকের দরকার নেই। নিজেদের ভাবনাটা নিজেরাই ভেবে পথ চলিও।
আমির সাহেবের রেসিপি দেখে চাচা হতাশ হয়েছিলেন। এরপর তিনি যতবার আমাদের বাসায় এসেছেন, একটিবারের জন্যও আমির সাহেবের সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
(চলবে)
মৌলবাদী রসনা: ভন্ডামীর চূড়ান্ত স্বাদ (প্রথম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:৪০