মৌলবাদী নাস্তিক বা ধর্ম-বিদ্বেষী (মূলত ইসলাম বিদ্বেষী) তথাকথিত মুক্তমনাদের ‘বিজ্ঞান’ ও ‘যুক্তিবাদ’ নিয়ে বেশ মাতামাতি পরিলক্ষিত হয়। তাদের এত বিজ্ঞান-প্রীতির কারণে সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্মাতে পারে যে বেশীরভাগ বিজ্ঞানীরা হয়তবা তাদের ঘরানার নাস্তিক। সমাজে এ ধারণা বদ্ধমূল হোক – যা উগ্রবাদী নাস্তিকদের কাম্য। এই দাবীর ভিত্তি হচ্ছে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যারা বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করে তারা সবাই নাস্তিক – কখনো তারা আস্তিক হতে পারে না। প্রসঙ্গত, ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বর্তমান বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের অন্যতম বিষয়। তাই ধর্ম-বিদ্বেষী (মূলত ইসলাম বিদ্বেষী) মুক্তমনাদের মতে যারা এ তত্ত্ব নিয়ে কাজ করবে বা বিশ্বাস করবে তারা সবাই এমনি এমনি নাস্তিক হয়ে যাবে! তাদের সংকীর্ণ ভাবধারার একটি নমুনা:
বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীতে সমস্ত জীবজগতের আবির্ভাব হয়েছে একটি সরল এককোষী জীব থেকে – যা “সাধারণ পূর্বপুরুষ” নামে পরিচিত। আর এই এককোষী ব্যাক্টেরিয়ার মতো জীবের আবির্ভাব নাকি হয়েছিল কেমিক্যাল বিবর্তন প্রক্রিয়ায়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের (যেখানে যারা যোগ্য তারা পরিবেশে উদ্দেশ্যহীনভাবে টিকে থাকে; অন্যদিকে দুর্বল বা অনুপোযুক্তদের বিলুপ্তি হয়) মাধ্যমে কালের প্রক্রিয়ায় (মিলিয়ন বছর টাইম স্কেলে) উদ্দেশ্যহীন ও দৈবক্রমে অজৈব পদার্থ থেকে জীবের মৌলিক উপাদান- ডিএনএ ও প্রোটিন তৈরী হয়। তারপর এগুলো মিলিয়ন-মিলিয়ন বছর ধরে ট্রায়াল-এন্ড-এরর (Trial and error) প্রক্রিয়ায় কোনক্রমে হঠাৎ করে জোড়া-তালি লেগে হয়ে যায় এককোষী ব্যাক্টেরিয়ার মতো জীব বা আমাদের আদি-পিতা! সেই এককোষী জীব থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্দেশ্যহীনভাবে ও দৈবক্রমে অপরিকল্পিত মিউটেশনের (জীনগত পরিবর্তন) মাধ্যমে ধাপে ধাপে তৈরী হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতি। ডারউইনের সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজকের মতো ছিল না। সে সময় জীবকোষকে অত্যন্ত সরল মনে করা হতো – ডিএনএ আবিষ্কার তো দূরের কথা। তাই বিজ্ঞানী হিসেবে তার তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে ডারউইন বলে গেছেন যে তার তত্ত্ব প্রমাণের জন্য জীব সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক ধাপ বা ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজ দেখাতে হবে। প্রায় ১৬০ বছর ধরে এই স্বপ্নের ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজের ফসিল সন্ধানে পৃথিবীর যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কল্পিত “ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজ” বা “মিসিং লিঙ্ক” এর টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। যুক্তিবাদের খ্যাতিরে বলা যায় এদের সংখ্যা পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রজাতির সংখ্যা থেকে অনেক অনেক গুণ বেশী থাকার কথা। আর তাই বর্তমানে বিবর্তনবাদীরা ফসিল আলোচনা থেকে বিরত থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর ব্যাখ্যা হিসেবে দেখায় নিও-ডারউইনিজমকে – বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক সিকোয়েন্সের মিলের সামঞ্জস্যতাকে (genetic relatedness or homology)।
বিজ্ঞান হচ্ছে সদা পরিবর্তনশীল একটি বিষয় – প্রবাহমান নদীর মতো – বিশেষ করে যে সকল বিষয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা লব্ধ উপাত্ত দিয়ে সঠিক বা সার্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না। এটাই বিজ্ঞানের আসল সৌন্দর্য। এটা কোন ভাবধারার অন্তর্গত সম্প্রদায়ের (নাস্তিক) সম্পত্তি নয়। বিজ্ঞানের বিকাশে মুসলিম, খ্রীষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, চাইনিজ, আস্তিক, নাস্তিক এবং সমস্ত মানব সভ্যাতার অবদান আছে। যেখানে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের-ই সদা বিবর্তন হচ্ছে, সেখানে এই পরিবর্তনশীল মতবাদকে ভিত্তি ধরে বিবর্তন-উগ্রবাদী (নাস্তিকেরা) বিজ্ঞানের খোলসে অপরিবর্তনশীল ধর্মকে ভুল প্রমাণে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর এটা করা হয় জনপ্রিয় পাবলিক মিডিয়ার কল্যাণে। বিজ্ঞান ও ধর্মের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাই দুটোকে কখনো একই মাপ-কাঠিতে বিবেচনা করা যায় না – যা কিনা হবে মানুষ ও গাছ-পালাকে একই মানদন্ডে তুলনা করার সামিল।
অতিসাধারণ অর্থে ‘বিবর্তন’ বলতে বুঝায় সময়ের সাথে সাথে কোন কিছুর পরিবর্তন। এ অর্থে এন্টিবায়োটিক সহনশীলতা (Antibiotic resistance) অথবা ভাইরাসের (যেমন ফ্লু বা এইচআইভি) মিউটেশনকে বিবর্তন (evolution) বলা যায়। কিন্তু এ-ধরণের বিবর্তন দিয়ে ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদকে ফ্যাক্ট বা ধ্রুব-সত্য হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু বিবর্তনবাদীরা এ-ধরণের উদাহরণ দিয়েই জনসাধারণকে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক ধরণা দিয়ে থাকে! মজার বিষয় হচ্ছে ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদকে ‘সূর্য উঠা বা অস্ত যাওয়ার মতো সত্য’ প্রমাণে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হচ্ছে। বিবর্তনবাদকে স্রেফ বিজ্ঞান হিসেবে ধরলে সেখানে প্রশ্ন করার অবকাশ আছে। প্রসঙ্গত, “জড় পদার্থ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি” – এ বিশ্বাস প্রায় ২০০০ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানী-মহলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ডারউইনের “প্রজাতির উৎপত্তি” প্রকাশের পাঁচ বছর পরে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর একটি অতি সাধারণ পরীক্ষার (যা বকনল পরীক্ষা নামে পরিচিত) মাধ্যমে হাজার বছরের বিশ্বাসকে চূর্ণ করে দেন। কিন্ত বিবর্তনবাদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করলে বিবর্তন মৌলবাদীরা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। রাগ প্রশমনে সাধারণত তারা প্রশ্নকারীর অজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তোলার অপচেষ্টা করেন। তাদের কিছু কমন শব্দগুচ্ছ হচ্ছে- You are such an ignorant, You don’t know anything about biology, Are all those thousands of famous scientists wrong? বিবর্তনবাদ যদি বিজ্ঞান-ই হয়ে থাকে তবে তো এত আবেগ-প্রবণ হওয়ার কারণ নেই। তার মানে বিবর্তনবাদ কি নাস্তিকতা নামক ধর্মের ভিত্তি?
বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বস্তুবাদী (নাস্তিক)/বিবর্তনবাদী ভাবধারা প্রচার ও প্রসারের মূলে রয়েছে মধ্যযুগীয় চার্চ-বাস্তুবাদী আইডিওলজিক্যাল সংঘর্ষ। চার্চের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার অগ্রযাত্রা ব্যহত হচ্ছিল। গ্যালিলিওকে তাঁর বৈজ্ঞানিক মতবাদের জন্য শাস্তি দেয়া হয়েছিল। নাস্তিকেরা বিজ্ঞানের নামে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্যালিলিওর ইস্যুটিকে ব্যবহার করছে নাস্তিকতার ভাবধারা প্রচারে। চার্চ যখন-ই নড়াচড়া শুরু করে, বস্তুবাদীরা গ্যালিলিও – সমতল পৃথিবী – ভূ-কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব – ছয় হাজার বছরের পৃথিবী – ইত্যাদি দিয়ে তাদেরকে দাবিয়ে রাখে। যার ফলে সমাজে চার্চের প্রভাব শূন্যের কোঠায়। এজন্য চার্চ বা ক্রিস্টিয়ান ধর্ম তাদের কাছে গৌণ। বস্তুত, ধর্মগুলোর মধ্যে একমাত্র ইসলাম তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। মজার তথ্য- যে গ্যালিলিওকে নিয়ে নাস্তিকেরা এত ব্যবসা করছে, সেই গ্যালিলিও কিনা গডে বিশ্বাসী রোমান ক্যাথলিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন! বিবাহ বহির্ভূতভাবে জন্ম নেওয়া তার দুই কন্যাকে বিয়ে দিতে পারবেন না বিধায় তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন। পরবর্তীতে মেয়েরা চার্চের পাদ্রী হয়েছিলেন।
বিবর্তনবাদী/মুক্তমনাদের বর্তমানে অন্যতম টার্গেট হচ্ছে ইসলাম। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে গ্যালিলিও বা খ্রীষ্টান ধর্মের ইস্যুকে এখন তারা মুসলিমদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আবার অন্যদিকে সাধারণ মুসলিমদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিবর্তন-নামীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আবরণে ব্যবসা করার খ্যাতিরে কয়েকজন মুসলিম নামধারী আরব বিজ্ঞানীকে বিবর্তনবাদের কর্ণধারও বানিয়ে দেয়; কেননা তারা নাকি ডারউইনের অনেক আগে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন!
ইদানিং রাখ-ঢাক না রেখেই নাস্তিক মৌলবাদী/উগ্রবাদীরা তাদের বিবর্তনবাদ নামক ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন অক্সফোর্ডের বায়োলজির প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স। সম্প্রতি তিনি নাস্তিকতার বাস ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন – যার একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব।
বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রশ্ন করে এমন অনেক বড় মাপের বিজ্ঞানী রয়েছেন। এই লিঙ্কে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় নয়’শ বিজ্ঞানীর লিস্ট দেখতে পাবেন যারা ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এদের মধ্যে অনেকে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির প্রফেসর ও প্রফেসর এমেরিটাস আছেন। বিবর্তন-মৌলবাদীরা এজন্য তাদেরকে চার্চের মিশনারিজ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশেষ বিনোদন লাভ করেন! এটা একটি অতিপ্রাচীন ও সহজ অস্ত্র। বিবর্তনবাদ-মৌলবাদীদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বিবর্তনবাদে অবিশ্বাসী বা সংশয়বাদীরা হচ্ছে গডে বিশ্বাসী আস্তিক! বিজ্ঞানকে তারা নিজেরদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করেন। এজন্য এরা অনেক সময় এতই আবেগী হয় যে বিবর্তনবাদে প্রশ্নকারী বিজ্ঞানীদেরকে ক্রিমিনাল হিসেবেও গণ্য করে! কিন্তু তারা ভুলে যান যে বর্তমান সময়ের বিবর্তিত-বিবর্তনবাদ তত্ত্বের (নিও-ডারউইনিজম) ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যারোলাস লিনিয়াসের (Carolus Linnaeus) জীবজগতের শ্রেনীবিন্যাসের উপর। এই শ্রেনীবিন্যাস করা হয়েছে জীবের বাহ্যিক মিলের ভিত্তিতে। আর তিনি এই যথেষ্ট শ্রমসাধ্য কাজ করেছিলেন গডের মহিমা তুলে ধরার জন্য!
সারকথা হচ্ছে- বিজ্ঞান ও ধর্ম-বিশ্বাস দুটো ভিন্ন বিষয় যার প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। কিন্তু নাস্তিকেরা তাদের ভাবধারা সমাজে আরোপ করতে বিজ্ঞানের মুখোশ ব্যবহার করছেন।
তাদের কথামত বিবর্তনবাদ যদি প্রাকৃতিকভাবে চলে আসছে বুঝায় তাহলে অন্তত গত ১০ হাজার বছরের ইতিহাসে কেন উল্লেখ নেই যে কেউ এমন কোন প্রানী দেখেছে যা কিনা বিবর্তিত হচ্ছে অর্থাৎ দুইটি বিদ্যমান প্রানীর মধ্যবর্তী প্রানী। অথবা বিবর্তনবাদ মানুষ পর্যন্ত এসে থেমে গেল কেন?
(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৩৩