আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী
নিয় ঘরনী চণ্ডালে লেলী
চন্ডালের মেয়েকে বিয়ে করে কবি ভুসুকু বাংগালী হলো।বৌদ্ধ দোহায় এ প্রথম “বাংগালী” শব্দ বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হলো। এর পর সহস্র বছর পার হলো। গাঙ্গেয় বদ্বীপের জলাভুমির (বং) অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে গড়িয়ে গেল। বৌদ্ধ পাল রাজাদের পর সেন রাজারা এলেন, সেন রাজাদের তাড়িয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী এলেন, তারই ধারাবাহিকতায় এলেন হোসেনশাহী আমলের-শাহ-ই-বাঙ্গাল, এলেন বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দি খান, এলেন তারই উত্তরসুরী সিরাজদৌলা, তাকে পরাস্ত করে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এলো বৃটিশের বানিজ্য কোম্পানী- ইস্ট-ইণ্ডীয়ার কতিপয় বনিকসহ ২০০ জন মাঝিমাল্লা। এদের ২০০ বছরের শাসনের পর ধর্ম রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত শাসনে নেমে এলেন ধর্ম অবতারগন (অবতার মোহাম্মদ আলী জিন্নার থিউরী অনুযায়ী)। বাংলার একাংশের নাম হলো পুর্ব পাকিস্তান আর তা’হলো পাকিস্থানী শাসনের অধীন। এর পর আরেক শহীদী কারবালার লড়াই শেষে আমরা রবীন্দ্র নাথের সোনার বাংলা ও কাজী নজরুলের বাংলাদেশ কায়েমে সক্ষম হলাম। দেশ পেয়েছি। তবে আজো প্রশ্ন আমরা বাঙ্গালী কি না? হিন্দু কি না? মুসলমান কি না? মানুষ হলাম কি না?
বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার দু’টি চরন প্রায়ই আমার মনে পড়ে। চরন দু’টি হলোঃ
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাংগালী করে মানুষ করনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংগালী মা’দের প্রতি আপশোস করেছেন। বলেছেন বাংগালীর সন্তান মা’দের কারনে মানুষের স্তরে উত্তীর্ন হতে পারেনি। মান (Value) ও হুশ (Conscience ) অর্জন করতে পারেনি। তা’হলে বাংগালীর মান কি নির্ধারিত হল? সে মানবিক স্তরে (Humanity)স্তরে নয়, পশুর স্তরে(Animality) রয়ে গেছে। মনুষ্যত্ত্ব ও বাংগালিত্ত্বের মান বিচারে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর মনুষ্যত্ত্বকে উর্দ্ধে ঠাঁই দিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দ্বিজাতি তত্ত্বের বিপরীতে হয়েছে। এ কারনে অতীতে যারা ধর্ম সমাজের নামে বাংলার মানুষকে অবহেলা ও লুন্ঠন করেছে, তারা স্বাধীনতার উষালগ্ণ থেকেই ধর্মদ্বয়ের নামে আবার ক্ষমতার বলয় তৈরী করে নিতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর ভেবে ছিলাম আমরা বাংগালী। আমরা বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র পেয়েছি। বাংলাদেশী বলে আমরা এখন সারা দুনিয়ায় পরিচয় দিতে পারি। স্বাধীনতার আগে ধর্ম-রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান।আমরা নিজেদের পরিচয় দিতাম পাকিস্থানী বলে। এরও আগে বৃটিশ ছিল আমাদের রাজা। আমরা নিজেদের বৃটিশের প্রজা হিসেবে পরিচয় দিতাম। এবার আর কেহ আমাদের জাতিস্বত্তাকে হেয় করে দেখবে না। আমরা বুকের রক্ত ঢেলে বাংগালী জাতির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ কায়েম করেছি। কিন্তু বেশীদিন পার হলো না। আমাদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য আধিপত্যবাদী শক্তি সিধ্যান্ত নিল।আমরা বাংগালী হলে আধিপত্যবাদের অসুবিধা।মানুষে মানুষে ভালোবাসা ভালো নয়। আঞ্চলিক মানুষ, একই ভাষার মানুষ, একই স্ংষ্কৃতির মানুষদের মধ্যে ঐক্য আধিপত্যবাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তাই বাংলাদেশের মানুষকে মুসলমান এবং হিন্দু হতে হবে। অন্য পরিচিতি অগ্রহনীয়। একদল লোক নেমে পড়লো এ পরিচিতির রাজনীতি-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে। যারা অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা নিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তি চেয়েছিলেন, তাদেরকে সাম্প্রদায়িক শক্তি ঝান্ডা পেটা শূরু করলো। মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নানা কৌশল আঁটা হলো। গত ৪৩ বছর ধরে প্রকৃত মুক্তি্যোদ্ধা হত্যা আর বর্নচোরাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে। শুরু হয়েছে নয়া-ধার্মিক বানানোর প্রকল্প। এ নয়া প্রকল্পে সাম্প্রদায়িক পরিচিতি ও ঐক্য কাম্য। আপনি মুসলমান ঐক্যবদ্ধতা কাম্য। ঐক্য বদ্ধতা দল সৃষ্টি করে। দল ক্ষমতা সৃষ্টি করে। কিছু লোক এতে করে ক্ষমতাবান হন। আপনি হিন্দু, হিন্দুর নামে ঐক্যবদ্ধ হউন। ক্ষমতাবান হবেন।আপনি মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হউন। ক্ষমতার শেয়ার পাবেন। এটা হলো বাংলাদেশের পরিচিতির রাজনীতি।
দার্শনিকদের জ্ঞানের খেলায় যোগ দিয়ে দিন রাত একাকার করেছি।দেখি শূন্য এ মস্তিষ্কে কিছু একটা ঢূকাতে পারি কিনা। সকলেই পরিচিতির ছবক দেয়। নিজকে চেন।নিজকে জান।বুর্জ়োয়া হও। প্রলেতারিয়েত হও।গনতন্ত্রী হও। লিবারেল হও। জাতীয়তাবাদী হও। মানবতাবাদী হও, নারীবাদী হও।পরিবেশবাদী হও। বিপ্লবী হও। এ সব পরিচিতর ধারার যে কোন একটির সাথে যুক্ত হলে তোমার কাজ হবে। দলের কাছে বা আইডিয়ার কাছে মাথা পেতে দাও। জাত ভুক্ত হও। আধুনিকতা-উত্তর দার্শনিক মিশেল ফুকো(১৯২৬-১৯৮৪) শুধু বললেন, “আমি কে এ কথা আমকে জিজ্ঞাসা করো না। আর আজ যা আমি আছি, কাল আমাকে এরূপ থাকতে ও বলো না” । আরে, এ দেখি আমাদের লালন ফকিরের (১৭৭৪-১৮৯০) মত কথা বলছেন!
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কিরূপ দেখলাম না এই নজরে। কেউ মালা কেউ তছবি গলায়/তাই তে কি জাত ভিন্ন বলায়, জাতের চিনহ রয় কার রে। যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/তবে নারী লোকে কি হয় বিধান। বামন ছিনি পৈতা প্রমান/বামনী ছিনি কিসে রে। জগত জুড়ে জাতের কথা/লোকে গর্ব করে যথাতথা।লালন কয় জাতের ফ্যাতা/ডুবাইছি সাত বাজারে।
এটা অস্বীকার করার কারো উপায় নাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল।বাংলার দরিদ্র মানুষরা শত শত বছর ধরে যখন দেখলো তারা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার, এবং যখন তারা বুঝতে পারলো যারা তাদের অবহেলা ও বঞ্চনা করছে, তাদের হাতে রয়েছে দু’টি মহত ও শক্তিশালী ধর্ম প্রতিষ্ঠান। তারা এ ধর্ম প্রতিষ্ঠান দু’টিকে তাদের ক্ষমতা বলয় অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ব্যবহার করে। বাংলার অবহেলিত মানুষরা নিজেদের মত করে ধর্মীয় কাঠামোবাদের বিপরীতে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে মরমী পন্থা ও বাউল পন্থার দল গড়লেন। অবহেলা, বঞ্চনা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষকে সচেতন করে গড়ে তোলার জন্য আজো গান গাইছেন। লালন ও লালন অনুসারীদের অসংখ্য গান শত শত বছর ধরে গীত হচ্ছে। মরমীবাদীদের প্রিয় মানুষ মজলূম জননেতা মওলানা ভাসানী গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে এদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুললেন। এবং এদেরে সহযোগীতায় ১৯৬৯ গনঅভ্যুত্থান ঘটালেন। এদের সন্তানরাই ১৯৭১ সালের গেরিলা যুদ্ধা ছিলেন। বাংলার মরমীবাদের গ্রামীণ বীরদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস কেহ লিখে্ন নাই। তবে তাদের গানে যে মুক্তির চেতনা তা আজ ও আমাদেরে পথের স ন্ধান দেয়।