অনেক বছর আগের কথা বেবি’র ভেতরে বসা ১৯ থেকে ২০ বছরের এক শ্যামলা মত তরুণ। ফিনফিনে হালকা দাঁড়িতে ছেলেটিকে কেমন যেন বাউন্ডুলে বাউন্ডুলে লাগছিলো। মাথায় সবুজ রঙ্গের একটি পাগড়ি, সাদা জোব্বা মতন পাঞ্জাবি। বেসুরো আর ভাঙ্গা গলায় বলেই যাচ্ছে “আমরা সবাই তালেবান, বাঙলা হবে আফগান”।
আমি সেই বেবি’র পাশের রিকশাতে বসা। আমার এক পাশে সিনেমা হলের মুনমুনের সফেদ পা আর সুডৌল বক্ষের বিলবোর্ড আর অন্যদিকে বাংলার আফগান তরুণ। বিরক্তিতে আমার ভুরু কুঁচকানো।, কিন্তু এই বাঙালী তালেবান তরুণটি আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে …মনে হোলো ছেলেটি যেন কি এক মোহে আক্রান্ত, গলার রগ টগ ফুলিয়ে বাঙলাকে ক্রমাগত আফগান বানাবার জন্য তার চিন্তা ও চেঁচানোর জুড়ি নেই। তাই সে বলেই যাচ্ছে সেই একই স্লোগান। কর্কশ ভাষায় ছেলেটি সেই ক্রমাগত প্রিন্টিং মেশিনের মত একঘেঁয়ে উচ্চারণে বলেই যাচ্ছিলো,
“আ-ম-রা স-বা-ই তা-লে-বা-ন, বা-ঙ-লা হ-বে আ-ফ-গা-ন…”
রিকশায় বসে আমি ভাবছিলাম বাঙলা কী করে আফগান হবে কিংবা আমরা সবাই কী করে হঠাৎ তালেবান হয়ে গেলাম বা যেতে পারি? এই তরুণ কি উন্মাদ? এর কী হয়েছে?
আসলো নতুন দিন। মানুষজনও পালটে গেলো নতুন দমকা হাওয়ায়। সেই হাওয়া একটি ভবনে এসে আঠার মত লেগে রইলো। নাম নিলো হাওয়া ভবন। হাওয়া ভবনে বাংলাদেশের সব ১০% ধেয়ে আসতে শুরু করলো। তারা আসলো দৌড়ে, নেচে, প্রচণ্ড গতিতে, অসীম তীব্রতায়। ব্যবসায়ীরা ১০% হাদিয়া দিয়ে সেখান থেকে দোয়া নিয়ে আসেন। যেন খালি দশ, খালি দশ…বাইছা লন খালি দশ, দেইখা লন খালি দশ। মিসেস জিয়ার চুল আরো এক দফা ফুলে গেলো তার হেয়ারড্রেসারের করিৎকর্ম দক্ষতায়, হাসিনা আরো জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে লাগলেন, কোকো নামের এক তরুণ বাংলাদেশের সব বিলবোর্ড কিনে ফেললেন স্ব-মহিমায়, মামুন নামের এক মধ্যবয়স্ক লোক হঠাৎ করে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে খাম্বা গাড়তে লাগলেন, এরশাদ সাহেব নতুন নতুন ক্র্যাভেট গলায় পরতে শুরু করলেন, দেশের পতাকা খামচে ধরলো শকুনেরা, একাত্তরের ঘাতক হয়ে গেলো কৃষকদের মন্ত্রী।
ঠিক তখুনি দেশের সব যায়গায় ফাটতে শুরু করলো বোমা। আজ ফাটে গফরগাঁয়ে তো কাল ফাটে লক্ষ্মীপুরে। পরশু ফাটে বাগেরহাটে তো তরশু ফাটে সুনামগঞ্জে। এভাবে বোমা ফাটিয়ে কিছু মানুষ নতুন এক দিনের সূচনা করলেন। ভদ্রলোকের নাম আফগান ভাই হবার কথা থাকলেও এই নামে তিনি আবির্ভূত হননি। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলা ভাই নামে। ঠিক তখুনি আমার মনে পড়ে গেলো বেবিতে চিৎকার করা সেই তরুণটির কথা। বাঙলায় থেকেও যে তরুণ আফগান সুরায় মত্ত ছিলো। বাঙলাকে যিনি তালেবান বানাবার এক মোক্ষম স্থান মনে করেছিলো। অবশ্য তারও আগে দেবী দুর্গাকে ভাঙলো একদল ধর্মান্ধ ব্যক্তি। নারায়ে তাকবীর বলে আক্রমণ হতে লাগলো আমাদের অববাহিকায়। মন্দিরের পর মন্দির পুড়তে লাগলো কোরানের নানাবিধ পঙতি আওড়াতে আওড়াতে। যারা সেসব পঙতি আওড়ালো তারা লাকুম দীনুকুম ওয়ালি দ্বীন বলতে বলতেও ভাঙলো গোটা শতেক দেবী। গোপালকৃষ্ণ মুহুরীর মাথা ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়া হোলো, পূর্ণিমাকে নওজোয়ানেরা ধর্ষণ করলো পালাক্রমে (তার মায়ের আকুতি-মিনতির পর অবশ্য)।
আমাদের নগরে এভাবেই প্রকাশ্য উন্মত্ততা দেখা দিলো বোমা মেরে, ধর্ষণ করে, গুলি ফাটিয়ে। অবশ্য তারও আগে কবি দাউদ হায়দারকে ধর্মের বংশদণ্ডের গোড়ার কেশে আগুন লাগাবার দায় নিয়ে চলে যেতে হয়েছিলো ভিনদেশে, তসলিমা নাসরিন নামে এক লেখককেও চলে যেতে হয়েছিলো একদিন, কার্টুনিস্ট আরিফ একটি রসিকতা করে পুড়িয়ে দিলেন জেলে গেলেন। হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে এই শহরকে অভিশপ্ত করা হয়েছিলো এই দেশেই। সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে। অবশ্য ১০% সাহেবের বাবা এই সংবিধানে আল্লাহতালাকে নিয়ে এসে জবাই করেছেন একটা সময়, সেই ১০% এর বাবার খুনী ক্রাভেট পরা এরশাদ দুই কাঠি সরেস হয়ে ধর্ম দিয়ে চেপে ধরেছিলেন সংবিধানের বুক আর হৃদয়। এত আদরে, এত মমতায় সংবিধান মরে গিয়েছিলো দম বন্ধ হয়ে। আমরা টের পেয়েছিলাম আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের সূত্র ধরে মোল্লারা আরেক দফা মন্দির পুড়ালো, ২০০১ সালের কথাতো বলেছিই, ২০১২ সালে তারা ভাঙ্গলো গৌতমকে। তারা পিটিয়ে মেরে ফেলতে চাইলো অপরের বিশ্বাসকে। তারা এ জনপদে নতুন শব্দ নিয়ে এলো, নাম দিলো “সংখ্যালঘু”। যে শুকু বিন্দু ছিলো আমার সারা জীবনের বান্ধব, আমার সারা জীবনের বন্ধু সেও যেতে চাইলো ভারতে। হয়ে গেলো সংখ্যালঘু। শুধু একটি কারণে। কেননা তার প্রভু আল্লাহ না। তার প্রভু ভগবান। আমার বন্ধু শুকু বললো, “এ মাটি তার নয়”। কিন্তু এই ভীতু আমি বলতে পারিনি উন্মত্ত গর্জনে, বলতে পারিনি চিৎকার করে, “শুকু বিন্দু হিন্দু ছিলো না, ও আমার বন্ধু ছিলো”। বলা হয় নি যথারীতি।
বছরে যেই বায়তুল মোকাররমের উত্তর বা দক্ষিণ গেট ছিলো আমাদের ধর্মানুভূতির আখড়া সেটি খানিকটা বর্ধিত হয়ে ছড়িয়ে গেলো শহরে, বন্দরে। বোমা আর বারুদে তা স্থান করে নিলো সাধারণ জনতার পাঁজরে আর রক্তের মাঝে। এই ধর্মীয় দলগুলোর ভেতর আবার বিভক্তি ছিলো। একই কোরান পড়ে যেমন কেউ হয় মৌলভী, কেউ মাওলানা ঠিক তেমনি এই ধর্মেও জন্মালো কোরানের বিভিন্ন অনুসারী। কেউ হলো জামাত শিবির, কেউবা ওলামা, কেউবা খেলাফত মজলিশ কেউবা হিজবুত তাহরীর। এভাবে আমরা ধীরে ধীরে এক ধর্মান্ধ দেশ হয়ে যেতে লাগলাম। কোনো মতে আমাদের পাসপোর্টেই কেবল লেগে রইলো পিপলস রিপাবলিক। আদতে তা যেন হতে চাচ্ছিলো ইসলামিক রিপাবলিক।
ধর্ম আমাদের আচ্ছাদিত করে ফেললেও সেই ধার্মিক লোকদের কোরান পড়বার অভ্যাস ছিলো না। তারা কোরানকে পুঁজি করে ব্যবসা করলো, কোরানকে নিয়ে নিজেরাই নতুন আদর্শ তৈরি করলো, তরুণ যুবাদের বেহেশত আর হুরপরীদের গল্প বলে, মাথা বুলিয়ে দলে ভেড়ানো হলো। আবার যেসব ছেলেরা হুরপরীদের গল্পে ভুললো না, তাদের দেয়া হলো নতুন বড়ি। বলা হলো খেলাফতের কথা, সাম্রাজ্যবাদীদের দুশমনীর কথা। ওরা লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালি দ্বীনকে ব্যাখ্যা দিলো নিজেদের মত, নিজস্ব আদলে। যে ছেলেটি হতে পারত এই দেশের সম্পদ, যে ছেলেটি হতে পারত এই দেশের স্বপ্ন, সেই ছেলেটি হয়ে গেলো একটি তুচ্ছ বোমার গোলাম। যেই বোমাটি ছেলেটিকে নিয়ন্ত্রণ করে তার পেটে কিংবা পিঠে ফেরি হয়ে হয়ে।
আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন নাফিস নামে একটি ছেলে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ভবনে হামলা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এই একটি ঘটনার বিভিন্ন প্রভাব বসে বসে ভাবছিলাম আর ক্রমাগত মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যেই ছেলেটির বাবা একটি ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট, যেই ছেলেটি নর্থ সাউথ ইনিভার্সিটির মত একটা ভালো ইনিভার্সিটিতে পড়েছে, আইডিয়াল স্কুল কিংবা ঢাকা কলেজের মত এতসব নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলো, তার কী দরকার ছিলো এসবে জড়ানোর? এটা কিসের আশা? বেহেস্ত? পরকালের পরম শান্তির? কিন্তু বোমা হামলা করে বেহেস্ত, শান্তি কোথায় পাওয়া যায় আজ পর্যন্ত কোরান ঘেটে পেলাম না।
প্রতিটি রাত কেমন যাবে এই ছেলেটির বাবা কিংবা মায়ের? যাদের ছেলে আজকে বোমা হামলার দায়ে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে আটক? আগামী ৩০ বছরে এই ছেলেটি আর হয়ত ফিরে আসবে না। যদি ফিরে আসেও, তবে হয়ত তার বাবা মা কেউই বেঁচে থাকবে না। মরে যাবে প্রতীক্ষা করতে করতে। এই কষ্টের অনভূতি হয়ত বুকটি ছিন্ন ভিন্ন করে তাতে লবণ মাখিয়ে দেবার অনুভূতির মত, কিন্তু এটিতেও ব্যাপারটি শেষ হবে না। এই ছেলেটির বাবা মাকে এখন বাংলাদেশে নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতে হবে, পুলিশ এসে তাদের ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকবে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই বাবা-মায়ের দিকে আঙ্গুল তুলে ছি ছি করবে। সবাই দূরে সরে যাবে। পাছে না আবার তাদের ঝামেলা পোহাতে হয় এদের সাথে সম্পর্ক রেখে।
আমি আসলে এসব নিয়ে চিন্তিত হবার চেয়ে শুধু দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ভাবি, ধর্ম তো আমিও পালন করি। আমিও তো মুসলমান। কই আমার তো এসব খায়েশ, এসব ফ্যানাটিজম কোনোদিন বুকের কয়েক হাজার মাইলের ভেতর আসেনি কখনো!! ধর্ম তো আমার কাছে এভাবে ধরা দেয়নি আজও!! আমার আম্মাকে সারাটা জীবন পশ্চিম দিকে ফিরে সেজদা দিতে দেখেছি, আব্বাকে দেখেছি রোজা রাখতে, একাকী অন্ধকার ঘরে তসবি জপতে। আমার বড় ফুফা উচ্চ স্বরে কাঁদতেন “ফাবে আইয়ে আলা ই রাব্বিকুমা তু কাজ্জিবান” পড়তে পড়তে। কই, কোনোদিনও তো ধর্ম নিয়ে তাদের অন্ধত্ব আমাকে দেখতে হয়নি!! কোনোদিন তেমন করে নামাজ পড়িনি, নিয়ম মেনে আর সারাদিন থুথু ফেলতে ফেলতে ঠিক ওইভাবে রোজা রেখেছি বলে মনে পড়ে না, কই কোনোদিন তো আমার বাবা তেড়ে আসেন নি, আমার মাকে তো কোনোদিন কিছু বলতে শুনিনি। শুধু একবারই বলেছিলেন, মন চাইলে আল্লাহকে ডেকো। তারা ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে কোনোদিনও মিছিল করেনি। তারা কি তবে এই ভূখণ্ডের নাগরিক নন? তবে কেন শুধু দক্ষিণ গেট আর শুক্রবার এই দেশে ধর্মের মর্মবাণী শোনায় আলখেল্লা আর পাগড়ি পড়া অচেনা বাঙালি তালেবান যুবকেরা ? আমাদের সাধারণ নাগরিকের ধর্ম কেন এভাবে তুচ্ছ ঘটনাতে নড়ে না? হেলে যায় না..
একটা সময় সুফীজমে ঝুঁকেছি। সেখানেও তো সেই একই কোরানের কথা বলেছেন আমার শিক্ষক। কিন্তু সেখানে শিখেছি প্রেম, শিখেছি কী করে নিজেকে জানতে হয়, কী করে নিজের ধমনী আর হৃদয় দিয়ে নিজেকে খুঁজে নিতে হয়, কী করে স্রষ্টাকে খুঁজে নিতে হয়। কই সেখানে তো রক্তের হোলির কথা ছিলো না!! তবে কি আমার কোরান থেকে ওদের কোরান আলাদা? এটা কি ভিন্ন গ্রন্থ? এটা কি ভিন্ন কথার কোনো পুস্তক? আমি কেন শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম, স্বরস্বতী, মা দুর্গা, জেসাস, মোজেসকে আপন করে নিতে পারি? কেন আমার সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? তবে আমি কোন কোরান পড়ি?
নাকি মূলত ধর্ম একটি তরল পদার্থ? যেটি যে পাত্র, কিংবা যার কাছেই আসুক সেই ব্যক্তির আকারে ধারণ করে বসে থাকে? নাকি যে ব্যক্তিটির ভেতর ধর্ম আসছে তারাই ভয়াবহ? হাজার হাজার মানুষকে উড়িয়ে দেবার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে, পরিবারকে, দেশকে কষ্ট দিয়ে এই বেহেশত পাবার যে আহলাদ, যে সখ, সেই আহলাদে এখন আমার ঘৃণা উপচে পড়ে। কোরান শরীফের সূরা হিজরের আয়াত ২৯ শে লেখা রয়েছে, “আমি তাঁর মধ্যে (আদমের) আমার রুহ ফুঁকে দিয়েছি”, যেই স্রষ্টা বলছেন তিনি তার রুহ ফুঁকে দিয়েছেন আদমের মধ্যে, সেই মানুষকে হত্যা করে তবে স্রষ্টার কাছে যাওয়া? সেই রুহকে বোমা মেরে হত্যা করে এই রক্তাক্ত পথ দিয়েই কি তবে সেই যাত্রা?
কেমন হয় যদি একটি বিশাল ও দীর্ঘ চিড়িয়াখানা বাংলাদেশে বানাই ? একরের পর একর জায়গা নিয়ে। মাইলের পর মাইল। কেমন হয় যদি সে চিড়িয়াখানাতে আমি, আপনি, আমার মা, বাবা, ভাই, বোন, আমরা সবাই ঢুকে পড়ি? সেখানেই আমরা তীব্র শান্তিতে একটু বেঁচে থাকি। ধর্মান্ধরা তখন সেই একলা শহরে, সেই নির্জন শহরে কাকে হত্যা করে বেহেশতে যাবার টিকিট যোগার করে, আমার খুব দেখবার ইচ্ছা।
খুব।