মানব সভ্যতার জন্য নতুন এক ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি খবর দিয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেড সেভেন থেকে টুয়েলভ ক্লাসের ছাত্রীদের অর্ধেকই যৌন হয়রানির শিকার। অন্তত গত শিক্ষাবছরের ওপর পরিচালিত গবেষণা রিপোর্ট তাই বলছে। যৌন নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের শতকরা ৮৭ ভাগের ওপর পড়েছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। এদের বেশিরভাগই এখন স্কুল কামাই করা শুরু করেছে; তার ওপর পাকস্থলির সমস্যা তো লেগেই আছে। অনেকের আবার রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে তারা জীবন কাটাচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি অলাভজনক সংগঠন হচ্ছে ‘দি আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ইউনিভারসিটি উইমেন’। তারাই এক হাজার ৯৬৫ জন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। এ গ্রুপটি যৌন হয়রানিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে-“যৌন হয়রানি হচ্ছে এমন অপ্রত্যাশিত যৌন আচরণ যা শারীরিক কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে করা হয়।”
গ্রেড সেভেন থেকে টুয়েলভ ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। গবেষণায় বলা হচ্ছে, ছেলেরা যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার সেখানে মেয়েদের সংখ্যা শতকরা ৫৬ ভাগ। তবে, মাধ্যমিক স্কুলে এ অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। সেখানে ছেলেদের হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাই বেশি। তবে, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে- কম আয়ের পরিবারের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার। আর এদের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে বেশি।
এ সম্পর্কে ‘দি আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ইউনিভারসিটি উইমেন’র পরিচালক ক্যাথেরিন হিল বলেছেন,“যৌন নির্যাতনের ঘটনা সর্বব্যাপী এবং স্কুলের জন্য এটা একটা স্বাভাবিক অংশ হয়ে গেছে।”
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১০-১১ শিক্ষা বছরে গড়পড়তা শতকরা ৪৮ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার। শতকরা ৪৪ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী বলেছে, তারা মানুষের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। এরা নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত মন্তব্য, কৌতুক কিংবা ইচ্ছকৃত স্পর্শ অথবা ভয়ভীতির মাধ্যমে যৌনাচারের শিকার হয়েছে। শতকরা ৩০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী অনলাইনে ই-মেইল, ফেইসবুক এবং অন্য মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত নানা মন্তব্য, কৌতুক অথবা ছবি পাঠানো হয়েছে কিংবা যৌন সম্পর্কিত নানা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীরা বেশি শিকার
মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ সংখ্যা শতকরা ৫২ ভাগ। এরা সবাই শারীরিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে আর শতকরা ৩৬ ভাগ অনলাইনে। এর বিপরীতে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রদের শতকরা ৩৫ ভাগ শারীরিক যৌন হয়রানির শিকার এবং ২৪ ভাগ অনলাইনে।
গ্রেড নাইনের এক ছাত্রী জানিয়েছে,“আমাকে সবাই বেশ্যা বলে ডাকে। কারণ আমার অনেক ছেলে বন্ধু আছে।” আবার গ্রেড এইটের এক ছাত্র জানিয়েছে,“আমাকে সমকামী বলে গুজব ছড়ানো হয়েছে কারণ আমি বাস্কেটবল টিমে খেলি।”
ইউনিভারসিটি এসোসিয়েশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হলি কার্ল জানিয়েছেন, জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, “আমরা চাই না যে স্কুলগুলো যৌন নির্যাতনের ঘটনা ভুলে যাক এবং এ সম্পর্কে চুপ থাকুক।”
গবেষণা রিপোর্টে বলা হচ্ছে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা তা হলো- অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন বিষয়ক মন্তব্য, ইশারা কিংবা কৌতুক। এগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহার করা হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে। শতকরা ৪৬ ভাগ মেয়ে এমন মন্তব্য, ইশারা কিংবা কৌতুকের শিকার। সেখানে এ ধরনের ঘটনার শিকার শতকরা ২২ ভাগ ছেলে। শতকরা ১৩ ভাগ ছাত্রী অপ্রত্যাশিত স্পর্শের শিকার, আর ছেলেরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয় শতকরা তিন ভাগ। শতকরা তিন দশমিক পাঁচ ভাগ ছাত্রী জানিয়েছে, শারীরিকভাবে কোনো না কোনো যৌনকাজে লিপ্ত হতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে। এমন ঘটনার শিকার শতকরা শূন্য দশমিক দুই ভাগ ছাত্র। এ ছাড়া, শতকরা ১৮ ভাগ ছেলে ও মেয়েকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘গে’ অথবা ‘লেসবিয়ান’ (সমকামী) বলা হয়েছে।
যৌন হয়রানির শিকার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জরিপ পরিচালনাকরীরা জিজ্ঞাসা করেছেন, কোন ঘটনা তাদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। জবাবে ছেলেরা বলেছে, সমকামী বলে ডাকা সবচেয়ে কষ্টকর। একই প্রশ্নের জবাবে মেয়েরা বলেছে, যৌন বিষয়ক অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য, কৌতুক কিংবা ইশারা-ইঙ্গিত তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক ছিল।
পরিণতি ভয়াবহ
মার্কিন মুল্লুকে এই যে অবাধ যৌনাচারের পরিণতি কিন্তু ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েরা মারাত্মক নেতিবাচক পরিণতির কথা বলেছে। এমন মেয়েদের শতকরা ৩৭ ভাগ বলেছে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর আর স্কুলে যেতে চায়নি। ছেলেদের বেলায় এ সংখ্যা ছিল শতকরা ২৫ ভাগ। শতকরা ২২ ভাগ মেয়ে বলেছে তারা ঘুমের সমস্যায় ভুগছে আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যায় ভুগেছে শতকরা ১৪ ভাগ। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এমন মেয়েদের শতকরা ৩৭ ভাগ বলেছে তারা পেটের পীড়ায় ভুগছে আর ছেলেরা ভুগছে শতকরা ২১ ভাগ।
অনলাইন এবং শারীরিক দুইভাবেই যেসব ছাত্র-ছাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের শতকরা ৪৬ ভাগ বলেছে তারা আর স্কুলে যেতে চায়নি, ৪৪ ভাগ পাকস্থলির সমস্যায় ভুগছে এবং শতকরা ৪৩ ভাগ ছাত্রছাত্রীর পক্ষে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
যৌন হয়রানির শিকার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জরিপকারী দল প্রশ্ন রেখেছিল-কোন ধরনের ছাত্রছাত্রী বেশি হয়রানির শিকার হয়। এর জবাবে তারা জানিয়েছে, সুন্দর চেহারার ছাত্ররা নিরাপদ। কিন্তু সুশ্রী-কুৎসিত সব ধরনের মেয়ে এবং মেয়েলি স্বভাবের ছেলেরা যৌন নির্যাতনকারীদের প্রধান টার্গেট। ছাত্র-ছাত্রীরা জানিয়েছে, সুঠাম দেহের মেয়েরা এবং যাদের শরীর তুলনামূলক আগেই বেড়ে ওঠে তাদের ঝুঁকি বেশি।
এ সম্পর্কে সংস্থার পরিচালক মিসেস ক্যাথেরিন হিল বলেন, যদিও যৌন হয়রানির ঘটনা সবাইকে প্রভাবিত করে তবে মেয়েদের জন্যই বিষয়টি বেশি জটিল। তিনি বলেন, ছেলেরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, কিন্তু মেয়েরা সরাসরি হয়রানির শিকার হয়।
নিউয়ক টাইমসের মূল রিপোটটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৮:২২