(০১,এপ্রিল,১৯৯৩)
যেখানে পাওয়ার আনন্দ, হোক সে বেদনা
সেখানেই হারানোর ভয়।
গুমরে ওঠে অনুরাগ অস্ফুট ব্যথায় ;
মিথ্যে নয় পৃথিবীটা মিথ্যে নয় মানুষের মন,
আমিই নিথর কেবল।
তোমার স্নিগ্ধ ভালোবাসাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারি না কখনো ; পারবোও না। তাইলে সে যে আমার নিজকেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। তাইতো চোখের তারায় স্বর্গ নামিয়ে তোমার ভালোবাসার রজনীগন্ধা বাড়িয়ে দিলে যখন, জানলে না, কি এক অদ্ভুত খেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিলে আমাকে, তোমার এই পাপড়ির বুকেই আমাকে উন্মুক্ত করতে হবে- মেলে ধরতে হবে আমাকে। কিন্তু আছে কি এমন কিছু, এক বুক শূন্যতা ছাড়া ? যাকে কিনা ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ তুমি অনায়াসে বুকে টেনে নিলে, ভালোবাসায় সিক্ত করে আমাকেই চিনিয়ে দিলে- কে আমি !
রূপা, মানুষ নাকি সারা জীবন নিজকেই খুঁজে ফেরে। কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। এভাবেই একদিন চলে যায় সবকিছুর আড়ালে। যারা পায়, তাদেরকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান মনে করি, শ্রদ্ধা করি। আর যারা পায় না, তাদের জন্য দুঃখ হয় খুব, তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য।
এমন একটা দুঃসহ সময় আমাকেও পুড়িয়েছে খুব। এই নির্দয় জ্বলনে উদ্ভ্রান্ত আমি ছটফট করেছি একা। অথচ মজার ব্যাপার কি জানো ? এই জ্বলন্ত সময়টাতেই আমার পরিপার্শ্ব অর্থাৎ আমার জানা অজানা চেনা অচেনা বন্ধু বান্ধব সবাই আমাকে স্বীকৃতি দিলো হাস্য-পরিহাসপ্রিয় সতেজ সপ্রাণ একজন জলি ছেলে বলে ! হায়রে বিচিত্র পৃথিবী !
আমার সেই দুঃসহ সময়, কী ভালো লাগে ভাবতে ! চলোনা, একটু কল্পনায় ভেসে উঠি। কল্পনা বললাম বলে আবার ভেবো না যেন ঘটে যাওয়া বাস্তবতার এতটুকুও বাইরে। তোমার মনে পড়ে কি, কোন এক ধূসর এবং রূপালী সন্ধ্যার কথা ?
বিয়ে সম্পৃক্ত কোন এক অনাড়ম্বর সন্ধ্যায় ক্ষীণ হয়ে যাওয়া পরিচিতির সূত্র ধরে খুবই সাধারণ যে তরুণটি অকস্মাৎ অবাঞ্চিতভাবেই তার বেসুরো উপস্থিতি জানান দিলো, তাতে এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্যে সম্পূর্ণ বেমানান পরিচ্ছদে হাজির হওয়া আপদ দেখে উপস্থিতজনদের ফিটফাট চেহারায় বিরক্তির ভাঁজ পড়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। তা সত্যি হয়েছিলো কি না জানি না বা জানা সম্ভব হয়নি। কেননা তা বুঝার আগেই এক প্রাণোচ্ছল মেয়ের উপস্থিতি এই তরুণকে এসব ঠুনকো ব্যাপারের অনেক উর্ধ্বে তুলে নিয়ে গেলো। মনে হলো পৃথিবীটা কত সুন্দর এবং নিষ্পাপ ! তখনও কি এ তরুণ ভাবতে পেরেছে যে কী দুঃসহ সময় সমাগত ? নিষ্পাপ সুন্দরের তীব্র রশ্মি ঘণীভূত হচ্ছে তরুণের নিরেট শুকনো অস্তিত্বে, জ্বলে উঠার অপেক্ষায় ? কোন তরুণ যুবকের সামনে একটি মেয়ের স্বাভাবিক উপস্থিতি খুবই সাধারণ ব্যাপার একটা। অথচ এখন ভাবলে মনে হয় এটা সাধারণ কোন ব্যাপার ছিলো না, অনেক অনেক অনেক বড় কিছু। রূপা, আমি বিধাতার বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে বরাবরেই সন্দিহান সে তো জানোই, তবু বিধাতা শব্দটি কিছু একটা অর্থে ধরে নিয়ে বলতে হয়, বিধাতা বড্ড রসিক বটে !
খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলিত মনে রাত্রির প্রথম বুক চিরে চিরে ফিরেছিল তরুণটি। তখনও নিস্তরঙ্গ অস্তিত্ব এমন সাধারণ ছিলো বলেই হয়তো আজও সে তরুণ জানে না ঐ মুহূর্তে সে নিটোল সুন্দরের ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত ছিলো কি না। ফেলে আসা দিনগুলোতে পারিপার্শ্বিক কতজনেরই তো স্বাভাবিক সংস্পর্শে এসেছে সে, তাই অতি সাধারণভাবেই এতেও স্বাভাবিকতা ক্ষুন্ন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু...? হাঁ, একটা কিন্তুই এই বিশাল পৃথিবীটাকে ওলট-পালট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তরুণের পৃথিবীটা তখনও আগের মতোই স্বাভাবিক থাকলেও কোথায় যেন একটু ছন্দপতন ঘটে গেলো সে বুঝতে পারলো না। তবু কি যেন একটা কিছু হারিয়ে গেছে অথবা নেই, এ ধরনের একটা সুক্ষ অনুভূতি কোথায় যেন বিঁধতে লাগলো। ঐ তরুণ তো তখনও খুবই সাধারণ একটা ছেলে মাত্র। অতশত বোঝে না সে। বোধ করি মানুষের জীবনে প্রথম নিঃসঙ্গতার অবচেতন উপলব্ধি এমনি করেই আসে, অজান্তে। যার উৎস সুনির্দিষ্ট থাকলেও সে মুহূর্তে কেবলই ধূয়াশা !
আজ এই নিঃসঙ্গ অথবা আপাত নিঃসঙ্গ মুহূর্তে মেয়েটি থেকে অনেক দূরে বসে সেদিনের সেই তরুণটি কি ভাবছে জানো রূপা ? ভাবছে সে, সেই দিন সেই মুহূর্তে কেন এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়েছিল নিজেরই অজান্তে, সুন্দরের ছোঁয়ায় ! নইলে এরপর থেকে সে কেমোন আনমনা হয়ে যেতো না যখন তখন। বিশ্বজগতের স-ব কিছুতেই কী যেন খুঁজে বেড়াতো সে প্রাণোচ্ছলতায়। অথচ জানতো না কী খুঁজছে। ঝলসে ওঠা তারুণ্যের ঠিকরে পড়া আলোর উৎস কোন্ সে শিখা, তা জানে না সে। বুঝতে পারে পৃথিবীটা কেন জানি খুব আনন্দময়। কী জানি খুঁজে সে, কখন কোথায় কীভাবে তা-ও জানে না। কী বোকা সে দেখো, প্রায়ই মেয়েটির মুখোমুখি হচ্ছে এবং তারুণ্যে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে, ছাত্রত্বের শ্রেষ্ঠ সময়টা মিছিল মিটিং কবিতা গান খেলাধূলা আড্ডায় সরব উপস্থিতিতে শ্রেষ্ঠতম হয়ে ওঠছে। অথচ সে জানলো না কোন্ সে আলোয় আলোকিত ! সাহসী মাঝি আনন্দে উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা, গন্তব্য জানে না, চোখ তার আকাশের নীলে। তাই সে জানলো না এটা মাঝ দরিয়া। কিন্তু যখন সে জানলো, দৃষ্টি তার নেমে এলো নীচে যেখানে সে আছে। যখন সে বুঝলো এটা মাঝ দরিয়া, চমকে ওঠলো, সমস্ত অস্তিত্ব অকস্মাৎ আলোড়নে স্তব্ধ হয়ে গেলো ! আসলে ঠিক বোঝাতে পারছি না রূপা, এ কেমন প্রচণ্ড অনুভূতি ! কেঁপে ওঠলো তরুণ মাঝ দরিয়া দেখে নয়, দরিয়ার বিশাল বুকের অনন্ত কষ্টের আয়নায় তার বেমানান হাসির অসারতা দেখে, নিজের অস্তিত্বের নগন্যতা উপলব্ধি করে !
মনে পড়ে রূপা, সেই দিনটির কথা ? উদ্দাম তরুণের সময়গময়হীন অবাধ্য যাতায়াতের উচ্ছলতা হঠাৎ থমকে গেলো যেদিন। চমকে ওঠলো, এ কী দেখছে সে ! এ-তো সেই মেয়ে নয় ! একটা ভয়াবহ কষ্টের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সামনে। চোখের পাথর দুটি বেদনায় গলে গলে ঝরছে। কী এক অবরুদ্ধ ব্যথায় গুমরে গুমরে ওঠছে মেয়েটি। না না, মেয়ে নয়, তরুণী ! তাও নয়। হঠাৎ কী-যে হয়ে গেলো পৃথিবীটায়। মুহূর্তের প্রচণ্ড আলোড়নে এমন এক ভয়াবহ ভাঙাগড়া হয়ে গেলো, কেউ কিছু বুঝতে পারলো না। নিমেষে এক চিরায়ত পুরুষের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠলো শাশ্বত এক নারী, যে নাকি হয়ে আছে বেদনায় বিষে নীল। পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের মুখে কে যেনো এক ছোপ কালি মেখে দিলো। জগতের সমস্ত গান বেহাগে মুড়ে গেলো। যুবকে রূপান্তরিত তরুণ নিজের প্রচণ্ড অসহায়ত্বে নিথর হয়ে গেলো। ঐ যুবকের বুকের ভেতরে কী ঘটে গেলো নারীটি তা বুঝলো না। সে শুধু নিজেকে আড়াল করতে চলে গেলো অন্তরালে।
রূপা, বিমূঢ়তারও একটা শেষ আছে। কিন্তু এ যে হারিয়ে যাওয়া নিজেকে ভয়াবহভাবে ফিরে পাওয়া, একেবারে শুদ্ধভাবে। জানো, যুবকটির তখন কি করতে ইচ্ছে হচ্ছিল ? একেবারে হাউমাউ করে কাঁদতে। প্রচণ্ড কষ্ট আর আনন্দে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে পৃথিবীটাকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। এ আমি কী দেখলাম ! আমার হাজার বছরের জন্ম জন্মান্তরের অস্তিত্বের চির পরিচিত খুবই আপন অংশটিকেই তো খুঁজে পেলাম। কিন্তু হায় ! এ যে আমার ধরা ছোঁয়ার একেবারে বাইরে ! অনেক অনেক যোজন দূরে! যেনো কয়েকটা জীবনের দূরত্ব। পাথর চোখে তীব্র জ্বালা হচ্ছিল। বিশ্ব চরাচরের সব কষ্ট নিরেট পাথর হয়ে এই ভাঙা বুকটাতে চেপে বসলো।
যুবকের পৃথিবী বোঁ বোঁ ঘুরছে। সবকিছু একাকার। সে নীলকণ্ঠ হবে, ঐ নারীর সমস্ত কষ্ট শুষে নেবে। ওকে তো ঐ কষ্টে মানায় না ! নির্মল হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে পৃথিবীকে আন্দোলিত করার বদলে এমোন পাথর বিষন্নতা ! না না, এ হতে পারে না। যুবক তার সর্বস্ব বাজি ধরতে উন্মুখ। কিন্তু...? ঐ নারী কার কষ্ট বুকে ধরে এমন নীল ? জানো রূপা, যুবকটি সেদিনই প্রথম কষ্ট কী তা বুঝতে শিখলো। সেদিন সে নারী তার কিছু কষ্ট ঐ যুবককে বইতে দিলো না বলে যুবকটি আহত হলো খুব ; কিন্তু বুঝতে দিলো না। তখনই সে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠলো। তারপর থেকে সে যুবক নতুন নতুন কষ্ট বানিয়ে বয়ে বয়ে নিজকে যোগ্য করে তোলার চেষ্টায় মেতে ওঠলো। হয়তো মেয়েটির কষ্টও বাড়তে লাগলো আরো। আশ্চর্য ক্ষমতায় একা একা বয়েও চললো। অথচ এমন স্বার্থপর মেয়ে, যুবকটিকে তার সামান্য কষ্টও বইতে দিতে নারাজ। যুবক রাগ করে, অভিমান করে, তবুও একগুঁয়ে মেয়ে বুঝতেই চায় না, এই কষ্ট বইতে না দেয়ার কষ্টের ভার যে তার বুকে আরো ভারি পাথর হয়ে সারাক্ষণ চেপে থাকে। যুবকটি তো এতো স্বার্থপর নয়, মেয়েটির মতো। সে কষ্টের ভাগাভাগিতে বিশ্বাসী। সমানে সমান।
রূপা, যুবকের গল্প বলতে পারছি এজন্যেই যে, সে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে নির্দ্বিধায়, অসঙ্কোচে। কেননা তার আর হারাবার ভয় নেই। যা হারাবার, অনেক আগেই তা হারিয়ে ফেলেছে। এবং সেই হারানো জিনিসটাকে মেয়েটির কাছে খুঁজে পেয়ে ওরই জিম্মায় রেখে দিয়েছে যোগ্যতম জায়গা বানিয়ে। সে এখন শূন্য শারীরিক খোলশ মাত্র। আর মেয়েটির গল্প বলতে পারছি না, মেয়েটি যুবকের চোখে এখনো কুয়াশা। নিজেকে গুটিয়ে রাখা একটা ব্যথার পিণ্ড। প্রকাশিত হতে দ্বিধান্বিত।
এবার বলো তো, যুবকটিকে যে এতো কষ্ট দিচ্ছে, কী সাজা প্রাপ্য হতে পারে তার ? কষ্টসহ মেয়েটিকে তুলে এনে যুবকের শূন্য বুকের মধ্যে ঠিক আটকে দেয়া, তাই নয় কি ?
“ রূপা, তোমার বুকের বাঁ-দিকে হাত রাখো ; একটু নীচে। টের পাচ্ছো ? কী পাচ্ছো ? ওটা আমার বসত। অনন্ত আমার একমাত্র ঠিকানা !”
// দিলমে রহ দিলমে,
কেহ্ মেমার এ কজাসে অবতক
এ্যায়সা মতবু মঁকা কোঈ বনায়া নহ্ গয়া //
‘ হৃদয়ের মধ্যে থেকো, হৃদয়ের মধ্যে।
কারণ ভাগ্যনির্মাতা আজ পর্যন্ত
এর চেয়ে মনোরম বাড়ি তৈরি করতে পারেন নি।।’
(- মীর তকী মীরের গজল থেকে -)
চলবে...
ভূমিকা পর্ব (০০): Click This Link
পরের পর্ব (০২): Click This Link