অখ্যাত গায়কের বাজনা ও সুরের মুর্ছনা
------------------------------ ড. রমিত আজাদ
যাচ্ছিলাম সিলেটে। বহুদিন ট্রেনে চলাচল করিনা, তাই ট্রেনের টিকিটের দুস্প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারনা ছিলোনা, অথবা ভুলে গিয়েছিলাম। সেই ভুলে জার্নির ঠিক আগের দিন গেলাম টিকিট কাটতে। বিশাল লম্বা লাইন, সেই লাইনে দাঁড়িয়ে ধৈর্য্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন কাউন্টারে পৌঁছলাম, তখন বিক্রেতা আমাকে সুসংবাদ দিলেন, এ/সি ও ফার্স্ট ক্লাসের কোন টিকিট নাই। অনন্যোপায় হয়ে বললাম, "তাহলে অন্য কোন ক্লাসের টিকিট দিন", আমার মুখ চেয়ে হয়তো মায়া হলো বয়স্ক রেইলওয়ে কর্মচারীর, অবশেষে একটা টিকিট হাতে দিয়ে বললেন, "নিন, একেবারে সাধারণ বগির টিকিট, যেতে কিছুটা কষ্ট হবে।" কি আর করা, মেনে নিলাম। তবে পরদিন যখন ট্রেনে চাপলাম, তখন বুঝলাম সাধারণ বগিতে যাওয়ারও কিছু আনন্দ আছে। বগির এ্যাটেনডেন্স ও ক্যান্টিনের কর্মচারী আমাকে খুব সম্মান করলো। বারবার এসে খোঁজ করছিলো, কোন কষ্ট হচ্ছে কিনা, কোন কিছু লাগবে কিনা, ইত্যাদি। আমাকে কমপ্লিমেন্টারি চা খাওয়াতেও চাইলেন তারা। বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামলে কিছু যাত্রী নেমে যাচ্ছিলো, আবার কিছু নতুন যাত্রী উঠছিলো, ভীড় তেমন কমছিলো না। মাঝে মাঝে ফেরীওয়ালারাও উঠছিলো, এর এক পর্যায়ে বেহালা নিয়ে হাজির হলো এক বাদক প্লাস গায়ক, বললো, "বাজাই?" একজন তরুণ যাত্রী সিলেটি উচ্চারণে বললো, "গাও, আগে কি সোন্দর দিন খাটাইতাম, গাও।" বেহালা নামক বাজনাটির প্রতি আমার একটা দুর্বলতা রয়েছে, ছোটবেলায় খুব সখ ছিলো ঐ যন্ত্রটি বাজাতে শেখার, যা আর হয়ে উঠেনি। আমি গভীর মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম অখ্যাত এই প্রত্যন্ত বাদক প্লাস গায়কের গান। বেহালায় ঝড় তুলে সে গাইতে লাগলো, "গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।" একটি গান শেষ হওয়ার পর সবাই বাহবা দিলো। তারপর সে শুরু করলো তার দ্বিতীয় গান, "ছাইড়া যাইবা যদি, কেন পিড়িতি বাড়াইলা বন্ধু?" আবেগ আপ্লুত হলো মন, তাইতো, 'ছেড়ে যাবো জেনেও প্রেমিক/প্রেমিকা কেন প্রেম বাড়ায়?' গান শেষ করে সে বললো। "দ্যান ভাই, কিছু দ্যান।" মনে মনে ভাবলাম, কত দিবো? এটা নির্ভর করছে তাঁর আমাদেরকে দেয়ার উপর। তারপর আমার মনে হলো, আমিও তো কবিতা লিখি। আমাদের লেখা কবিতাগুলোয় কোন সুরকার সুরের অলংকার পড়ায়, তারপর কোন গায়ক সুরে ও ছন্দে সাজানো কথাগুলো তার মধুর কন্ঠে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়। তাদের অবদানকে খাটো করে দেখি কি করে? আমাদের সংস্কৃতির রয়েছে রীচ হেরিটেইজ। আজ দারিদ্র্য ও নানাবিধ কারণে সংস্কৃতি চর্চা মন্থর হলেও, হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা খাঁচার ভিতর অচীন পাখীর খোঁজ অব্যাহত রেখেছি। সেখানে খ্যাতিমানদের পাশাপাশি এই অখ্যাতদেরও অবদান আছে। হাত খুলে কিছু দিলাম (আমার সামর্থ্য অনুযায়ী)। অল্পতেই বেশী খুশী হওয়া বোধহয় সব শিল্পীদেরই স্বভাব। আমার উপর সে ভীষণ তুষ্ট হয়ে বললো, "উনার জন্যি, আরেকটা গান গাইতাম।" তারপর সে আরো একটি গান গাইলো। অখ্যাত এই গায়কের বাজনা ও সুরের মুর্ছনা আমার যাত্রাপথের সকল ক্লান্তি মুছে দিলো। বেঁচে থাক শিল্প, বেঁচে থাক শিল্পীরা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:৫০