বাজান একটা ঠান্ডা কোক দাও।
আজ বড্ড গরম পরছে। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ লোক রিক্সাটা দোকানের পাশে রেখে একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে দোকানের সামনে এসে দাড়ালো। শাহেদ খুব একটা পাত্তা দিলো না, আসলে কাস্টমারের চেহারা দেখেই দোকানীরা ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করে। আড়চোখে দেখলো কাঁচা পাঁকা চুল, দাড়ি ও পেঁকে গেছে প্রায় পুরোটাই। একটা জীর্ন সাদা গেঞ্জি পরে আছে, লুংগিটার অবস্থাও খুব সংগিন। কোক দেয়ার আগেই শাহেদ একটু কঠিন করেই বললো পনের টাকা দেন। আগে বহুবার এমন হয়েছে, কোক, পেপসি চায় তারপর খাবার পরে দাম দেয় দশ টাকা। পনের টাকা চাইলে প্যানপ্যানানি শুরু করে দশ টাকাই তো দাম পনের টাকা চান ক্যা? প্রথমে আরো দুই টাকা দেয় তারপর বললে আরো দুই টাকা। আরেক টাকা চাইলে বলে, নাই বাবা কম রাখো। অভিজ্ঞতা থেকেই এখন আগেই দাম বলে দেয় পরে কেওয়াস ভাল লাগে না।
বৃদ্ধ লোক বিশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বলে বাজান দাম দিয়াই খামু, মাগনা কিছু খাওয়েনের অভ্যাস নাই, সহ্য হয় না।
শাহেদ একটু অপ্রস্তুত হলেও মুচকি হেসে একটা ঠান্ডা কোক এগিয়ে দিয়ে বলে চাচা বসে খান। দোকানের সামনের ব্যাঞ্চিতে বসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে শাহেদকে বলে বাজান তুমি এই পাড়ায় নতুন নাকি? শাহেদ বললো নাতো চাচা, আমি প্রায় তিন বছর ধরে এখানে। আসলে দোকানে কম বসি, একটা অফিসে কেরানীর চাকুরী করি। অবসর সময়ে দোকান চালাই এমনিতে আমার চাচাতো ভাই বসে। আপনি কোথায় থাকেন চাচা? নাম কি আপনার?
আমি থাকি পাল পাড়ার পেছনের বস্তিতে, আমারে সবাই সিরাজ মিয়া বইলাই ডাকে। শাহেদ বৃদ্ধের পায়ের দিকে তাকায় জানতে চায় কি হয়েছে?
সিরাজ মিয়া হাসে আর বলে এইটা কিছু না। একখান গাড়ী পায়ের উপর দিয়া চইলা গেছিলো।
শাহেদ অবাক হয়েই জানতে চায় বলেন কি ক্যান? কবে? কিভাবে? এরপর কি হলো?
সিরাজ হাসতে হাসতে বলে বাজান রেল গাড়ী থামাও, আমি চইলা যাইতাছিনা। বলে ঢক ঢক করে কোকটা শেষ করে ফেললো কিন্তু ঠিক তৃষনা মিটলো না। কয়দিন ধরে গলা বুক শুধু শুকনা লাগে পানি খায় কিন্তু গলা ভিজে না! বয়স হয়েছে আগের মতো গায়ে জোড় পায়না এখন।
সিরাজ আস্তে আস্তে বলে বাজান, বোতলের পানি ছাড়া ঠান্ডা পানি আছে? শাহেদ একটু বিরক্ত হতে গিয়েও হাসি দিয়ে বললো আছে। বাসা থেকে আনা পানির বোতলটা ফ্রিজ থেকে নামিয়ে দিয়ে সিরাজ মিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। এক নিমিষে অর্ধেক বোতল পানি পান করে মনে হলো বুকটা একটু ঠান্ডা হয়েছে।
আল্লাহ তোমার ভাল করুক, অখন আর কেউ হাসি মুখে কথা কয় না। সবাই কেমন কঠিন মনের মানুষ হয়ে গেছে। আপনাও কেমন পর হয়ে গেছে।
শাহেদ আবারো জিজ্ঞেস করে পায়ে কি হয়েছে? ওর কেন যেন মনে হচ্ছিলো এর পেছনে কোন গল্প আছে।
সিরাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করে, পরথম থেইকাই বলি, আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, বয়স ১৬/১৭ হবে। গ্রামের ছেলে তাই বয়স একটু বেশীই ছিলো। আমার মিয়া ভাই স্কুলে পড়ায়, বাবা গৃহস্থ মোটামুটি স্বচ্ছল। ভালই কাটতেছিলো দিন গুলান। স্কুলে যাইতাম আর সারাদিন টোটো কইরা ঘুরতাম, ডাংগুটি, হাডুডু আর মার্বেল খেলতাম। সেই বছর মার্চ মাসে যখন শেখ সাবেরে ধাপ্পা দিলো ভুট্টুরা তখন বুঝবার পারিনাই কি হইতেছে? ২৫ তারিখের পর সব বদলায় গেলো। আমাগো সুন্দর নিরিবিলি গ্রামটা রাতের অন্ধকারে বদলায় গেলো। পাকিস্তানি আর্মিরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালায় দিতেছে, মা বোইনেরে ধইরা নিয়া যাইতেছে, জোয়ান পোলাগোরে গুল্লি কইরা কাকপক্ষির মতো মাইরা ফালাইতেছে সেই সময় আমার মিয়া ভাই একদিন সন্ধ্যায় আমারে ডাইকা কয় সিরাজ্জা আমি ভারত যাই টেরনিং নিতে, আইসা পাক হালাগো ছিল্লা খামু। আমি কইলাম আমারেও লয়া যাও মিয়া ভাই। নিলো না কইলো বাপজান আর মারে দেইখা রাখিস। আমি থাইকা গেলাম বাড়ীতেই।
জুন মাসে আমাগো গ্রামের মেম্বার রমিজ্জা হঠাৎ কইরা পাঞ্জাবি আর পাক টুপি পইরা ঘুরতে লাগলো। শুনতাছিলাম পাকিস্তানি আর্মিগো লগে বলে তার বেজায় ভাব। একদিন সক্কাল বেলা আমি পায়খানায় গেছি, গ্রাম দেশ পায়খানা বাড়ির থেইক্কা একটু দূরে। ঠাস ঠাস করে গুলির আওয়াজ শুনলাম। আমি ভয়ে ওইখান থেইকা বাইর হইনা। অনেক সময় বাদে সব সুনশান মনে হইলো। বাইর হইয়া দেখি আমাগো বাড়ী আগুনে জ্বলতাছে। দৌড়াইয়া উঠানে গিয়া দেখি আমার বাপজান উঠানের মাঝখানে চিৎ হইয়া পইরা রইছে। বুকে পেটে গুলি আর বায়োনেট এর খুচানির দাগ। মারেও গুলি কইরা মাইরা ফেলছে রমিজ্জা রাজাকার আর পাক আর্মিরা। পাশের বাড়ির ছালেহা খালায় কইলো মিয়া ভাইরে খুজতে আইছিলো না পায়া কুত্তার বাচ্চারা আমার নিরীহ বাপজান আর মারে মাইরা বাড়িতে আগুন দিয়া গেছে?
সেইদিন আমিও রাতের বেলা পালায়া বর্ডার দিয়া ভারত চইলা গেছিলাম। তিন মাস ট্রেনিং নিয়া আবার দেশে ঢুকছি। কুমিল্লার দেবিদ্বার এ যুদ্ধ করছি, রাতের অন্ধকারে গিয়া পাক ক্যাম্পে আক্রমন কইরা ১৩ জনরে মারছি কিন্তু অপারেশন শেষ কইরা আসার সময় রাজাকারগো লইয়া যেই গাড়ী যাইতেছিলো তার নীচে পরলাম। পায়ের উপর দিয়া গাড়ী গেলোগা কিন্তু শব্দ করিনাই বুজলেতো দিব শেষ কইরা!! বাইচা গেলাম কিন্তু পাটা খোড়াই হয়া গেল।
যুদ্ধ শেষে সবাই মুক্তিযোদ্ধার কাগজ নিলো, আমি গেলাম না। আসলে তখন নিজের পা এর চিকিৎসা করাইতে করাইতে সব শেষ। পরে একটু ভালা হইয়া আইলাম কিন্তু আমারে কাগজ দিলো কিন্তু আমিতো যুদ্ধে আহত হইনাই তাই যুদ্ধাহত কইলো না। আমিও আর যাই নাই কি হইবো কাগজ দিয়া, বাপজান মারে কি ফিরা পামু? গেরামে চইলা গেলাম। রমিজ্জারে খুজতে গিয়া দেখি পরিবারসহ পালায় গেছে। তাজ্জব ব্যাপার চার বছরপর রমিজ্জা আবার গেরামে ফিরা আইল। এইডা কি দেখলাম আগের চেয়েও জোড় বেশি, নাদুস নুদুস হইয়া গেছে। এইবার চেয়ারম্যান হয়া গেল! আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পরতিবাদ করলাম উল্টা আমাগো গেরামে এক ঘইরা কইরা দিলো।
আরেকটা কথা আমার মিয়া ভাই কইলাম অক্টোবর এর ১৯ তারিখ হবিগঞ্জে যুদ্ধ করতে গিয়া শহীদ হইছে। কিন্তু রমিজ্জা গেরামে মিয়া ভাইএর নামডাও মুইছা দিলো। মাদ্রাসার নাম দিলো রমিজ আলী মাদ্রাসা। গেরামে ওগো প্রতাপের চোডে টিকা থাকাই দায় হয়া গেল। আমি বাপজানের জমি চাষ কইরা কোন রকম দিনগুজরাইতে ছিলাম। কিন্তু রমিজ্জা রাজাকার আসতে আসতে আমাগো মুক্তিযোদ্ধাগোরে কোনঠাসা কইরা ফেললো। আমাগো জমি দখল কইরা নিলো। কত জায়গায় গেলাম কতজনরে ধরলাম, সবাই আশা দেয় ভালা ভালা কথাও কয় কিন্তু রমিজ্জারে কেউ কিছু কইবার সাহস পায় না। সে এখন চেয়ারম্যান আবার জামায়েতের জেলার আমির তার ছেলে ও নাকি বড় নেতা। আমারে কয়েকবার বিচার শালিস বসায় অপদস্থ করছে। এরপর সম্মান বাচাইতে রাইতের অন্ধকারে গেরাম ছাড়ছি। এই শহরে আইসা প্রথম প্রথম রাস্তায় থাকছি, কেউ কাজ দেয় নাই। বলে ল্যাংড়ারে কাজ দিবো না। পরে অনেক বইলা কইয়া এই রিক্সাটা ভাড়া নিবার পারছি। কষ্ট হয় কিন্তু ভিক্ষা করি না। এই দেশের লাগি অস্ত্র হাতে তুইলা নিছিলাম আজ নিজের লাগি এই রিক্সাই আমার অস্ত্র। জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার।
বাজান, রমিজ্জায় চার বছর আগে মইরা গেছে। বাইচা থাকতে ওরে কিছুই করতে পারি নাই। মরনের পরে ওই হারামজাদার কবরের পাশ দিয়া যতবার যাই একদলা থুতু ওর কবরে ফালায় দিয়া মনেরে শান্তি দেই।
রাজাকারের বাচ্চা দেশের স্বাধীনতা চায় নাই কিন্তু দেশ স্বাধীন এরপরে সব সুবিধা ঠিকি নিয়া লইছে। আমাগো শান্তিতে থাকতে দেয়নাই।
সেদিন যখন আরেক রাজাকার কাশেম্মারে ঝুলানের খবর পাইছি আল্লাহের কাছে খাস দিলে দোয়া করছি শেখের বেটির জন্য। একদিনের জন্যে হইলেও আমার পায়ের ব্যথা সাইরা গেছিলো। বাপজান, মা, মিয়াভাই রে হারানোর কষ্ট বুইজা গেছে।
শাহেদ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে সিরাজ মিয়া কথা বলছে আর গড়গড়িয়ে পানি নেমে আসছে চোখ থেকে গালে, টপটপ করে মাটিতে পরছে। শাহেদের মনে হচ্ছিলো ইস এই কয়েক ফোটা চোখের পানি যদি ও সংগ্রহ করে রাখতে পারতো!! এর চেয়ে খাটি দেশ প্রেমের নমুনা আর কোথায় পাবে ও? অস্বস্তিতে কিছুই বলতে পারলো না কিন্তু মনে মনে সালাম ঠুকলো অপরিচিত, সনদ বিহীন এক মুক্তিযোদ্ধাকে।।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৮