দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে.....
জার্মানি মহাপ্রতাপে একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করছে। জার্মানি কখন কোথায় আক্রমন করবে তা কেউ জানে না,সব যুদ্ধেই অপ্রতিরোধ্য ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে জার্মানি।কারণ, জার্মানির হাতে আছে "অ্যানিগমা" নামের একটি যন্ত্র।এই যন্ত্রের সাহায্যেই যুদ্ধের সব গোপন তথ্য - নির্দেশনা আদান প্রদান করত জার্মান বাহিনী।এই অ্যানিগমা মেশিনের মাধ্যমে তথ্য জ্যাবরাল কোড আকারে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো হতো এবং এরপর জার্মান সৈন্যরা তা ডিকোড করত।তখনকার সবচেয়ে গোপন এবং শক্তিশালী যন্ত্র এই "অ্যানিগমা মেশিন"।অ্যানিগমা মেশিনের প্রায় ১৫৯ মিলিয়ন মিলিয়ন কনফিগারেশন ছিলো।এর কোড ভাঙ্গা ছিলো প্রায় অসম্ভব।কিন্তু, কিছু গনিতবিষারদ তা পারলেও একটি তথ্য ডিকোড করে বের করতেই অনেক সময় চলে যেতো।জার্মানরা দিনে শত শত তথ্য আদান প্রদান করত এবং অনেক সময় তা ডিকোড করাও সম্ভব হতো না।জার্মানিও এই অ্যানিগমা মেশিন ব্যবহার করে অপ্রতিরোধ্য ভাবে এগিয়ে চলছিলো।প্রতিদিন রাত ১২ টার পর জার্মানরা অ্যানিগমার কনফিগারেশন পরিবর্তন করত ফলে সারাদিন এর তথ্য বের করার জন্য সব পরিশ্রমই রাত ১২ টার পর বৃথা।
"১০ জন মানুষ যদি প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা ১ টি কনফিগারেশন ১ মিনিট করে ও মিল খুজে তবে সময় লাগবে ২০ মিলিয়ন বছর।"
ইংল্যান্ড অ্যানিগমা এর কোড ভাঙ্গার জন্য একটি দল গঠন করে। দলের অন্যতম দুই সদস্য ছিলেন অ্যালান টুরিং এবং হিউ আলেকজান্ডার।
প্রথমে পুরো দলের দায়িত্ব হিউ আলেকজান্ডার এর উপর থাকলেও পরে দায়িত্ব দেওয়া হয় অ্যালান টুরিং কে।
আলেকজান্ডার এবং অন্যান্য সদস্যদের সাথে প্রথমে অ্যালান টুরিং এর সম্পর্ক খারাপ থাকলেও পরে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
অ্যালান টুরিং বিশ্বাস করতেন প্রতিদিন কনফিগারেশন খুজে খুজে তথ্য বের করা সম্ভব নয়।এজন্য তিনি এক মেশিন বানানোর চিন্তা করেন। সবাই তার এই মেশিনের চিন্তাকে অবাস্তব বলে ধরে নেয় এবং সবার মধ্যে একটা ধারণা বিদ্যমান ছিলো যে অ্যানিগমা মেশিন এর কোড ভাঙ্গা অসম্ভব।অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে টুরিং তার যন্ত্র তৈরী করলেও তার ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। টুররিন তার যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন "ক্রিস্টফার"।ক্রিষ্টফার ছিলেন স্কুলের টুরিং এর প্রিয় বন্ধু।টুরিং ক্রিষ্টফার কে ভালবাসতেন।ক্রিষ্টফার অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান।
টুরিং এর মেশিন ১৫৯ মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন কনফিগারেশন এলোমেলো ভাবে খুজছিলো ফলে মেশিন থেকে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না।
একদিন রাতে রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলার সময় কথার ছলে বলেন তার এক বন্ধু তাকে জার্মানি থেকে বার্তা পাঠান।এতে বার্তা আসে রেডিওতে প্রতিদিন তবুও তিনি ওই বন্ধুর বার্তা চিনতে পারেন কারন তার প্রতিটি বার্তার প্রথমে ৫ বর্ণ এক থাকে ( Cilly)।
এরপর ট্যুরিং এর মনে পড়ে জার্মানরা প্রতিদিন সকাল ৬ টায় একটি আবহাওয়ার বার্তা পাঠায় এবং প্রতিদিনের সকালের বার্তার শেষে লেখে থাকে "Heil Hitler"।
এই "Heil Hitler" শব্দদুটি কমন হিসেবে ব্যবহার করে টুরিং প্রথম "অ্যানিগমা কোড" ভাঙ্গতে সক্ষম হন।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রযুক্তিগত দিক থেকে শক্তিশালী যন্ত্র টুরিং এর কাছে ধরাশায়ী হয়।
জার্মানরা জানতেই পারে নি যে তাদের অ্যানিগমা এর কোড কেউ ভেঙ্গে ফেলেছে।এবং তারা জার্মানদের সব পরিকল্পনার তথ্য মুহূর্তেই জেনে যাচ্ছে।ফলে জার্মানরা একের পর এক যুদ্ধে ধরাশায়ী হতে থাকে।
" বলা হয় টুরিং এর কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্থায়ীত্ব ২ বছর কমেছিলো এবং ২কোটি মানুৃষের প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো।"
কিন্তু,কোনোদিন টুরিং তার তৈরী যন্ত্রের জন্য আবিষ্কারক হিসাবে দাবী করতে পারেন নি।কারণ,প্রায় ৫০ বছর টুরিন সম্পর্কিত সব তথ্য ছিলো টপ সিক্রেট।
এমনকি জার্মানরাও জানতে পারেনি যে তাদের "অ্যানিগমা" ও কোনো একজন মানুষ ভেঙ্গেছে।
টুরিং এর তৈরী যন্ত্র কম্পিউটারের মতোই কাজ করতো।তাকে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক বলা হয়।
অ্যালান টুরিং, অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার, ফেলো অব দ্য রয়েল সোসাইটি (১৯১২ – ১৯৫৪), গনিতবিদ, যুক্তিবিদ ও ক্রিপ্টোবিশেষজ্ঞ। কম্পিউটার বিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক দুটি ধারণার সাথে তাঁর নাম জড়িতঃ টুরিং টেস্ট ও টুরিং মেশিন। প্রথমটি জড়িত বিতর্কিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণার সাথে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে কম্পিউটারের বিমূর্ত গাণিতিক গঠন।
অ্যালান টুরিং ১৯১২ সালের ২৩শে জুন লন্ডনের পেডিংটনে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম জুলিয়াস ম্যাথিসন টুরিং ও মাতার নাম ইথেল সারা স্টোনী। তিনি শেরবর্ন স্কুল থেকে স্কুলজীবন শেষ করেন। তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কিংস কলেজ থেকে গণিতে গ্র্যাজুয়েট শেষ করেন এবং ১৯৩৫ সালে গাউসের এরর ফাংশনে কাজের জন্যে ফেলোশিপ অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে তিনি প্রিস্টোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন।
টুরিন হোমোসেক্সুয়াল ছিলেন। ১৯৫২ সালে টুরিংকে সমকামিতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সে সময়ে যুক্তরাজ্যে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। জেলে যাওয়া এড়াতে তিনি এস্ট্রোজেন (oestrogen) ইঞ্জেকশন গ্রহণ মেনে নেন। টিউরিং ১৯৫৪ সালে তাঁর ৪২তম জম্নদিনের ১৬ দিন আগে ডিপ্রেসনে ভুগে ১৯৫৪ সালের ৭ জুন সায়ানাইড পান করে মারা যান। ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন টুরিংকে যে ক্ষতিকর চিকিৎসায় বাধ্য করা হয় তার জন্য দাপ্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
হলিউডে অ্যালান টুরিংকে নিয়ে বায়োগ্রাফি তৈরী করা হয়েছে। মুভিটির নাম " The Imitation Game "।
মুভিটি দেখতে পারেন। আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন টুরিং সম্পর্কে।
মুভিটি "অস্কার" সব ৪৩ টি পুরষ্কার লাভ করে এবং ১৪০ টি মনোনয়ন পেয়েছিলো....
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৩৩