ওয়াশিংটনের স্টেট লাইন পেরিয়ে ওরেগনে ঢুকতে ঢুকতেই ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছাড়িয়ে গেল। প্রথমে দেখতে যাব ওরেগন স্টেটের প্রাকৃতিক বিস্ময় পেইন্টেড হিলস। মপিন শহরের বেয়ার স্প্রিংস ক্যাম্পগ্রাউন্ডে থাকার প্ল্যান থাকলেও সেখানে পৌঁছানোর পর দেখা গেল ঢোকার রাস্তাই বন্ধ। চারদিকে কতক্ষন চক্কর মারার পরেও কোন জনমানবের আর ঢোকার কোন রাস্তা না পাওয়ায় পত্রপাঠ সেখান থেকে প্রস্থান করা ছাড়া আর উপায় থাকল না। ভোরের আলোয় নাকি সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে পেইন্টেড হিলস। তাই তার সবচেয়ে কাছে, মাত্র ৯ মাইল দূরে প্রাচীন সোনা সন্ধানী আর কাউহ্যান্ডদের শহর "মিচেল" এ রাতে থাকার ডিসিশান হল। জনবিরল এই এলাকায় রাস্তায় কোন আলো নেই। তাই সাবধানে গাড়ি চালিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন রাত আড়াইটা। মিচেল শহরের জনসংখ্যা ১৩০। পুরো শহরে কোথাও কোন আলোর লেশমাত্র দেখলাম না। স্কাইহুক মোটেলে রেজওয়ান রুম নিয়েছে। ছোট-খাট একটা টিলার উপরে মোটেলটা। সর্বসাকুল্যে রুম ৭টা। মোটেলের মালিক রিসেপশন নামের একটা পুলিশ চেকবক্সের মতো রুমের সামনে আমাদের রুমের চাবি রেখে বহুআগেই বিদায় নিয়েছে। রুমে ওয়াই-ফাই থাকলেও তার কাজ করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। রুমের ভিতরে বহুদিন পর সিলিং ফ্যানের দেখা পাওয়া গেল। ঠান্ডা বাতাস পাবার এটাই একমাত্র ব্যবস্থা। আসবাবপত্রও বহু পুরোন আমলের তবে এখনো ব্যবহার উপযোগী। রুমের ভিতরে ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় বাইরে এসে দাঁড়ালাম। যে এক বার নেটওয়ার্ক আসলো তাতে কাজ চালানোর মতো কোন উপায় হল না। এর কারণে সেলফোনের "সেল" ভেঙে আশেপাশে চোখ বুলানোর সময় পাওয়া গেল। ওয়াকওয়ে বাঁধানো না। মাটির উপরে নুড়িপাথর বিছানো। সামনেই ওয়াগনের বহু পুরানো ভাঙা কাঠের চাকা। তার আশেপাশে কেউ গাছ কেটে রেখেছে। নিচে যে রাস্তা চলে গেছে তা নিকষ কালো। সামনে বহুদূর পর্যন্ত পাহাড়ের সারি। ভাঙা চাকার পাশের গাছের গুঁড়িতে কিছুক্ষন বসার পরই পাহাড়ের গায়ে বাতাসের ধাক্কা যে মৃদু এক মায়াবী সুর তৈরী করে তা শুনতে পেলাম। এমনকি হতে পারে না যে বহু আগে এই গুঁড়ির উপর এমন গভীর রাতে কোন ন্যাটিভ আমেরিকান যোদ্ধা অথবা কোন কাউবয় আমারি মতো এই মায়াবী সুর শুনতে পেয়ে নতুন পৃথিবীর বাকি সব কিছুকে ভেবেছিল অর্থহীন? এই পাহাড়েই তারপর কেটেছে তার বাকি জীবন? আমি সেই সুরের মূর্ছনা শুনতে শুনতে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে সিগারেট ধরালাম। আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথির নিচে এখন শুধু আমি, পাহাড়, বাতাসের সুর, আর অন্ধকার চিরে সিগারেটের লাল আগুন।
ভোরের প্রথম আলোয় পেইন্টেড হিলস দেখার কথা থাকলেও অনেক দেরিতে ঘুমাতে যাওয়ায় উঠতে পারলাম না আমি আর অপু ভাই। সকাল ৭ টার দিকে উঠে দেখি অণু ভাই আর রেজওয়ান বেরিয়ে গেছে। আমরা ধীরে সুস্থে ফ্রেশ হলাম, নাস্তা আর দুপুরের রান্না শেষ করলাম। বাকি দুইজন ৮ টার দিকে ফিরে এসে বললো তারা নাকি যাওয়ার আগে আমাদের অনেক্ষন ডেকেছে কিন্তু আমরা উঠিনি। এক বিন্দুও বিশ্বাস করলাম না কারণ আমার ঘুম খুবই হালকা। আমি নিশ্চিত এই দুইজনও উঠতে দেরি করায় তাড়াহুড়োয় আমাদের না ডেকেই বেরিয়ে গেছে। যেহেতু পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার পথে ওটা আবার পড়বে তাই চিন্তার বিশেষ কোন কারণ ছিল না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে লম্বা গোসল দিয়ে এক টানে পেইন্টেড হিলসে। অবাস্তবরূপী এক পাহাড়ী অঞ্চল, নানা রঙে রাঙানো পাহাড়ের শরীর। বিশেষ করে লাল আর খয়েরিতে। দেখলে মনে হয় কোন শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে রং তুলির আঁচড় কেটেছেন পাহাড়গুলোর উপর। নামকরণের স্বার্থকতা পুরো ১০০ তে ১০০। পেইন্টেড হিলস, জন ডে ফসিল বেডসের তিনটি উনিটের একটি। আয়তনে ৩,১৩২ একর। ৪০ মিলিয়ন বছর আগে সাগরের তলদেশ ছিল এই এলাকা, নানা জীবাশ্ম, বিশেষ করে পাতার জীবাশ্ম পাওয়া যায় এখনো। পাহাড়ের মাঝে মূলত লাল, কমলা আর খয়েরি রং দেখা যায়। সূর্যের আলো আর বাতাসের জলীয় বাষ্পের পরিমানের উপর রং কিছুটা পরিবর্তিত হতে থাকে দিন জুড়ে। রঙের গাঢ়তা একেকজন একেক রকম দেখে। বিজ্ঞানের নানা পাললিক কারণেই এখানে রঙের বাহার। আবার প্রাকৃতিক কারণেই একসময় এই পাহাড়গুলো সাধারণ পাহাড়ে পরিণত হবে বাতাস, বালি, ঘাস জন্মানোর পরিমাণ এবং মানুষের দখলদারিত্বের উপর নির্ভর করে তা কত তাড়াতাড়ি অথবা কত দেরিতে হবে। আমেরিকান সরকার নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে সেই সময়টাকে যত দেরি করানো যায়। পাহাড়ের উপর মানুষ ওঠা নিষেধ, তারপরও অনেক জায়গাতেই মানুষের জুতোর চাপ দেখা গেল যে যা ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। আমরা অনেক পাহাড়ই দেখলাম যা পুরোপুরি ঘাসে ঢেকে গেছে।
রেজওয়ান আর অণু সাহেব আগেই ঘন্টা দুই পার করায় তাদের মধ্যে এখন আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। রেজওয়ান সুযোগ পেয়ে আবার ড্রোন উড়িয়ে দিল আকাশে। অণু ভাইয়ের মধ্যে তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট। বার বার আমাদের তাগাদা দিচ্ছিলেন। তবে তার তাগাদাতে তেমন কোন লাভ হল না। আমরা আমাদের মতোই দেখতে থাকলাম। ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আমাদের পঙ্খীরাজ টয়োটা প্রিয়াস চললো নীল জলরাশির ক্রেটার লেকের দিকে।
ক্রেটার লেক একটা মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে জল জমে তৈরি। টলটলে স্বচ্ছ হ্রদের পানি। হ্রদের মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ- উইজার্ড আইল্যান্ড। এই লেকের সৃষ্টি ৭,৭০০ বছর আগে মাউন্ট মাজামা আগ্নেয়গিরির ধ্বংস হওয়ায়। পানির গভীরতা প্রায় ১,৯৪৯ ফুট। ক্রেটার লেক আমেরিকার সবচেয়ে গভীর আর পৃথিবীর ৯ম গভীরতম হ্রদ। এই লেকের সাথে কোন নদীর যোগাযোগ নেই। বৃষ্টি আর তুষারপাতের মাধ্যমেই এর পানির লেভেল ঠিক থাকে সবসময়। লেকের একদম উপর পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রাস্তা আছে। তিনটা ভিউ পয়েন্ট থেকে পুরো লেকটা দেখা যায়। ওয়েলকাম সেন্টারটা তো দারুন। ভিতরে স্থানীয় লোকজনের তৈরী এমন অদ্ভুত সুন্দর সব শো-পিস রাখা যে মাথা নষ্ট হয়ে প্রায় কিনেই ফেলতে নিয়েছিলাম, শেষ মুহূর্তে পকেটের আসল অবস্থা মনে পরে যাওয়ায় ক্ষান্ত দিলাম।
ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে লেক ক্রেটারে পার করে দিলাম পুরো বিকাল। বের হওয়ার পথে বাড়তি পাওয়া হল ক্লিয়ারওয়াটার ওয়াটারফলস। এটা আমেরিকার সবচেয়ে ফটোগ্রাফড জলপ্রপাত। আমি শিওর অনেকেই ক্যালেন্ডারের পাতায় এই ওয়াটারফলসের ছবি দেখেছেন। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসলেও সময়ের যথাসম্ভব সব্দব্যবহার করে যা ছবি তোলার তুলে নিলাম।
অণু ভাইয়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড মেলিসা ব্রাউন থাকেন ওরেগন স্টেটেই। ওনার ফেসবুক পোস্ট দেখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কাছাকাছি আছেন শুনে। মেলিসার সম্ভবত জানা ছিল না আমরা চারজন। জানার পরে সে জানাল তার বাসায় চারজন থাকার মত জায়গা নেই কারণ ওর বাবা-মা ঘুরতে এসেছেন কয়েকদিন আগে তবে আমাদের যদি আপত্তি না থাকে তবে তার এক বন্ধু ও সহকর্মীর বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। সেই বন্ধুর বাড়ি এখনো নির্মাণাধীন, বাসিন্দা চারজন- বন্ধু, তার বান্ধবী, একটা কুকুর আর একটা বিড়াল। আমরা যেখানে রাইত, সেখানেই কাইত নীতিতে চলছি সুতরাং আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। রওয়ানা দিলাম ক্রেটার লেক থেকে ৩ ঘন্টা ড্রাইভিং দূরত্বের রোজবার্গ শহরে। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে রাত সাড়ে দশটার দিকে মেলিসার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছালাম। পাহাড়ের পাদদেশে নিরিবিলি এক নেইবারহুড। আমরা বেশ ইতস্তত করছিলাম রাত বেশি হয়ে যাওয়ায়। অনেক আমেরিকানই এই সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। কিন্তু না, দুই বার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেল। ওরা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বন্ধু আর বান্ধবী যে আসলে দুজনেই বান্ধবী তা আমাদের জানা ছিল না। আরেকটু ইতস্তত পরিবেশ। তবে সোনিয়া আর লিজের উষ্ণ অভ্যর্থনায় কিছুক্ষনের মধ্যেই তা কেটে গেল। ওদের কুকুর কুইন্সি বেশ গা ঘেঁষা। আদরের জন্য সবার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে ছিল। বিড়াল ব্যাটা অলস। ঘর থেকে বের হল না। সোনিয়া আর লিজের সম্পর্ক প্রায় পাঁচ বছর। শীঘ্রই গাঁটছড়াটা বেঁধে ফেলবে। দুজন মিলেই তাই এই বাড়িটা কিনেছে। একসাথে রেনোভেশনের কাজ করে অফিস থেকে ফিরে।নিজেদের সংসার নিজেরাই একটু একটু করে সাজাচ্ছে। সমকামীদের যারা অন্য পৃথিবীর মনে করে তাদের হয়তো চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন হত যদি কাছাকাছি থেকে এদের জীবন দেখত। আমাদের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। সোনিয়া কাজ করে বন বিভাগে। ক্যাম্পিং করা নিয়ে নিয়মনীতি বিষয়ক কিছু ইনসাইড টিপস দিল আমাদের। সকালে ওদের দুজনেরই অফিস আছে যেহেতু উইকডেইজ এর মধ্যে আমরা হাজির হয়েছি তাই ওদের আর যন্ত্রনা না দিয়ে শুতে চলে গেলাম। অণু ভাই আর রেজওয়ান লিভিং রুমে, আমি আর অপু ভাই চিলেকোঠায়। শোয়ার পরে মজা টের পাওয়া গেল। বাড়ির কাজ শেষ না হওয়ায় সব রুমে এ.সি. নেই। চিলেকোঠায় নেই জানালা। একটা স্ট্যান্ড ফ্যান থাকলেও বদ্ধ রুমে অসম্ভব গরমের সাথে তা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না কোনমতেই। গরমে আমি আর অপু ভাই দিগম্বর প্রায়। এই অবস্থায় কখন যেন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৯ দুপুর ২:৫৬