সকাল থেকে রেজওয়ানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না !!!!! মোটেলের রুমে, লবিতে, পাশের গ্যাস স্টেশন, ক্যাসিনো, নাই তো নাই কোথাও নাই। জলজ্যান্ত মুখ ভর্তি দাড়িওয়ালা সুন্দর ছেলেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আজকে শুধু ড্রাইভিং এর প্ল্যান থাকায় আলসেমি করে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে সবাই। ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা খেতে যেয়ে দেখি এই নিখোঁজ সংবাদ। অণু ভাই লবিতে এলাইয়া বসে লেখালেখির কাজ চালাচ্ছেন, অপু ভাই দেশে নানান জায়গায় ফোন দিতে ব্যস্ত, আমি অলস ল্যাটাইয়া ছিলাম বিছানায়। যাই হোক নাস্তা খেয়ে রেজওয়ানকে বার বার ফোন দেয়ার পরেও ও যখন ধরছিল না, তখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে বাছাধন নিশ্চয়ই কোথাও ফস্টিনস্টি করতে যেয়ে ন্যাটিভ আমেরিকানদের কাছে ধরা খেয়ে নিজের মাথার খুলির ছালটা হারিয়েছে। রেজওয়ানের চুল ভর্তি মাথার ছাল উদ্ধারের জন্য পোসি নিয়ে বুনো পশ্চিমের শেরিফদের মতো বের হব এমন উত্তেজনাকর চিন্তা-ভাবনা করার মাঝখানে অণু সাহেব তার বিরস বদনখানি নিয়ে হাজির। ভাবলেশহীন গলায় বললেন আমাকে নাকি একটা জায়গায় যেতে হবে। কোথায় জিজ্ঞেস করে বললেন গেলেই নাকি দেখতে পাব !!!!! এই ভদ্রলোকের সমস্যা হল অহেতুক উদাসী ভাব নিয়ে বেশির ভাগ কথাই নিজের মধ্যে চেপে রাখা, যা প্রায়ই বিরক্তির উদ্রেক করে এবং নানান ঝামেলার সৃষ্টি করে। আমার চিরাচরিত পোশাক হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে রওয়ানা হওয়ায় উনি বললেন ভালো জামা পরে বের হতে। ওনাকে কেমনে বুঝাই আমেরিকানদের কাছে পরিষ্কার কাপড় মানেই ভালো পোশাক। যথা আজ্ঞা বলে জিন্স, টি-শার্ট পরে নিচে নামলাম। দেখি উনি এক সাদা আমেরিকানের সাথে নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। সংক্ষেপে আমাকে বললেন সকাল থেকে রেজওয়ানের প্রচন্ড শরীর খারাপ হওয়ায় ও হসপিটালে ভর্তি আছে, কেউ যেন চিন্তা না করে তাই উনি কাউকে জানান নি। সাদা ব্যাটা হসপিটালের ডাক্তার। আমার ওনার সাথে যেতে হবে হসপিটালে রেজওয়ানের গাড়ি আনতে। ডাক্তার ভদ্রলোক অসম্ভব ভাল মানুষ হওয়ায় আমাদের এই উপকার করতে রাজি হয়েছেন।
হসপিটালে যেয়ে দেখি রেজওয়ান স্যালাইন নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। কাতর গলায় বললো ফোনের চার্জ শেষ, গাড়ি থেকে যদি ওর চার্জারটা এনে দেই তাহলে খুব উপকার হয়। ফোন ইউজ করতে পারছে না। ভাবতে পারেন !!!!! ইয়াং জেনারেশন :p ডাক্তার বললেন ঘন্টা তিনেক দেখে ওকে ছেড়ে দেবেন, তখন যেন এসে নিয়ে যাই। আমি মোটেলে ফিরে সবার সাথে গোছগাছ শুরু করলাম। ৪ ঘন্টা পর্যাপ্ত আলসেমির পরে রেজওয়ান ফোন দিলো। তাকে আর কেউ হসপিটালে রাখতে রাজি না। আমাদের বোঝা ওরা আমাদের ফিরিয়ে দিতে চায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাই রেজওয়ান নামক দুস্টু এবং নষ্ট বোঝাটাকে হসপিটাল থেকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। এবার যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আজ সারাদিনই গাড়ির উপর। প্রধান ড্রাইভার রেজওয়ান, সহকারী ড্রাইভার আমাকে গাড়ি চালাতে দিয়ে পিছনের সিটে আয়েশের দিক থেকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হার মানাতে ব্যস্ত। অপু ভাই নাক ডেকে ঘুম। আমি আর অণু ভাই সামনে যুদ্ধ জারি রেখেছি।
চলছে গাড়ি, যাত্রাবাড়ী............
যেতে যেতে রাস্তায় বিরাট সাইনবোর্ড। “1,00,000 Old Books”। বেশ ইন্টারেষ্টিং লাগলো ব্যাপারটা। তবে চিন্তা করতে করতেই পার হয়ে গেলাম। একটু পরে আবার সেই সাইনবোর্ড। তবে এবার নিচে লেখা "Next Exit"। নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, পল্টন আর সেবা প্রকাশনীর গোডাউনে দিনের পর দিন খুঁজে বইয়ের প্রথম সংস্করণ বের করাটা একসময় নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। কি আছে জীবনে ভেবে গাড়ির স্টিয়ারিং ডানে কেটে নিয়ে নিলাম এক্সিট। একটু পরেই ঢুকে পড়লাম আলবার্টোন নামের ছোট্ট এক নিরিবিলি শহরে। বইয়ের দোকানটার নাম "মন্টানা ভ্যালি বুক স্টোর"। রেজওয়ান আর অপু ভাইয়ের বইয়ের ব্যাপারে কোন আগ্রহ না থাকায় আমি আর অণু ভাই ঢুকলাম ভিতরে। সে যেন আস্ত এক লাইব্রেরি। সারি সারি সেলফে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত বই সাজান। সব পুরোন বই, এবং বেশ ভাল অবস্থার। নিচে বেসমেন্টেও একই অবস্থা। বইয়ের এক মহাসমারোহ সেখানে। এই অসাধারণ গুপ্তধনের মালিক কেরেন ওয়ালস। এমন কোন জনরা নেই যার উপর এখানে বই পাওয়া যাবে না। অনেক দুষ্প্রাপ্য বই এখানে রয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি ভালোই জানেন তবে আমরাই প্রথম বাংলাদেশী যারা তার বইয়ের সাম্রাজ্যে এলাম। বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনলেন উনি আমাদের রোড ট্রিপের কথা। বললেন নিজের অনেক কথাও। ১৯৭৮ থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন উনি। ওনার বাবার শখ এবং ব্যবসা ছিল পুরোনো বইয়ের। সেখান থেকেই তার রক্তে এই নেশা ঢুকে যাওয়া। পুরোন বইয়ের রাজত্বে তিনি আছেন সেই আট বছর বয়স থেকে। ১,০০,০০০ বইয়ের কথা লেখা থাকলেও, বই আছে তারও অনেক বেশি। এলাকার বাচ্চাদের উনি বিনা পয়সায় বই ধার দেন পড়ার জন্য যাতে তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে ওঠে। ওনার পরে এই সাম্রাজ্যের হাল ধরবেন তার মেয়ে। উনি ও কেরেনের মতোই পুরান বইয়ের পাগল। বই উল্টে পাল্টে দেখা শুরু করতেই কেরেন বলে দিলেন দাম নিয়ে চিন্তা না করতে। আমাদের জন্য থাকবে তার স্পেশাল ডিসকাউন্ট। ফটোগ্রাফি সেকশানে যত বই দেখলাম তা সচরাচর বইয়ের দোকানে দেখা যায় না। গাড়িতে একটা মশা ঢোকানোর জায়গা নেই তারপর ও অনেক বাছাই করে দুটো বই নিয়েই নিলাম। কারেন দাম রাখলেন মাত্র ৫ ডলার, সাথে দিলেন একটা ফ্রি পোস্টকার্ড যার দাম ২ ডলার। এরমধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি সেটাও একটা ছোট লাইব্রেরি, তিন ধারেই বুক সেলফ !!!!! ছোটবেলায় জামার নিচে গল্পের বই লুকিয়ে নিয়ে বাথরুমে যেয়ে পড়ার কথা মনে পড়তেই হাসি এসে গেল। এরপর কেরেনের সাথে ম্যান্ডাটরি ফটোসেশন। এই দোকানের ওয়েবসাইট এড্রেস হল: http://www.montanavalleybookstore.com/ কেরেনের খুব সুন্দর কিছু কথা আছে সেখানে-
“My aim is to get as many books as possible into the hands of the people who will love them the most. Running a used book store with old books that are sometimes hard to find is a public service, like a museum or a library. There’s value in just having those books there for the public to look at, even if they don’t take them home.”
— Keren Wales, Owner
১,০০,০০০+ বই আর তাদের সম্রাজ্ঞীর উষ্ণ ভালোবাসা বুকে নিয়ে আবার নামলাম রাস্তায়। রাতের মধ্যে পৌঁছাতে হবে ওয়াশিংটন স্টেটে।
*****অনেকেই ছবি দেখতে চেয়েছেন। সামুতে ছবি আপলোড দেয়া এক বিশাল ঝামেলা লাগে। আমার ফেসবুক প্রোফাইলে যেয়ে ছবিগুলো দেখতে পারেন (যদি ধৈর্য্যে কুলায়, হাজার দুয়েক ছবি আছে :p)। এলবাম পাবলিক করা।
https://www.facebook.com/rajon.al.masud/media_set?set=a.2057339444310714&type=3
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪৮