মন্টানায় গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক লিস্টের প্রথমে থাকলেও প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে গেল আমার ছোট্ট একটা কথায়| মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ন্যাটিভ আমেরিকানদের ফেস্টিভাল পাও-আও দেখার| যে এই উৎসব দেখেনি তার পক্ষে আন্দাজও করা সম্ভব না কতটা সুন্দর এই উৎসব| আমার অভিজ্ঞতার কথা গ্রূপের সবাইকে বলতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলো এটা দেখার জন্য| গুগল মামুকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল একদিন পরেই লেম ডিয়ার সিটিতে এই উৎসব হবে| ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় এই সুযোগ আর এড়ানো গেল না| প্ল্যান পাল্টে রুট বদলে রওয়ানা দিলাম লেম ডিয়ারের উদ্দেশ্যে| যাওয়ার পথে পড়ল স্মৃতি বিজড়িত বোজম্যান শহর| প্রথম দিকের সেই দিনগুলির স্ট্রাগল মনটা খারাপ করে দিল| এতো সুন্দর শহরটার কিছুই দেখতে পারিনি শুধু একটা গাড়ির অভাবে আর কিছু মানুষের সহযোগিতার অভাবে| আজ সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি গাড়ি ড্রাইভ করে| জীবন কিভাবে বদলে যায়.....মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাইন রাস্তায় দেখে মনটা হু হু করে উঠলো| প্রায়ই ভাবি আমেরিকায় না আসলে জীবনটা কেমন হতো? সিদ্ধান্তটা কি ঠিক ছিল? জানা হবে না আর কখনোই.....যা যাওয়ার তার সবই চলে গেছে জীবন থেকে গত ৬ বছরে|
বিকাল ৬টায় পৌঁছালাম লেম ডিয়ার শহরে| পৌঁছে একটু বোকা বনে গেলাম| পুরো ফ্যাসিলিটি বন্ধ| নানান জানালা দিয়ে কিউরিয়াস কাঠবিড়ালীর মতো কতক্ষন উঁকিঝুঁকি মারার পর ভিতরে দেখা গেল এক ন্যাটিভ আমেরিকান দাদী আর সাদা এক মেয়ে ক্লিনিং এর কাজ করছে| বন্ধ দরজায় ঠক ঠক করার পর অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুললো| কমবয়েসী মেয়েটা দেখলাম মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির টি-শার্ট পরা| আমিও ওখানকার ছাত্র ছিলাম রবং আরও বিস্তারিত পরিচয় দেয়ার পর তারা সহজ হলেন| জানা গেল ওয়েবসাইটে যে ঠিকানা দেয়া সেখান থেকে ৫ মাইল দূরে হচ্ছে আসলে উৎসব। তাদের দেয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে সেই জায়গায় পৌঁছাতে খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হল না| এর মধ্যে রাস্তায় লক্ষ্য করলাম এখানকার মানুষজন পোষা কুকুরগুলোর একটাও বাঁধা নেই| গলায় বেল্ট ছাড়াই ওরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে মনিবদের সাথে| জায়গামতো যখন পৌঁছালাম তখন একটু জড়সড় লাগছিল সবারই| আমি আগে এমন একটা অনুষ্ঠানে গেলেও ওটা ছিল নিজের ইউনিভার্সিটিতে| এখানের উৎসবটা অনেকটাই বলতে গেলে ঘড়োয়া মত, যা আমাদের আরও উৎসাহী করে তুলল| ন্যাটিভ আমেরিকানরা ছাড়া আর কেউই নেই| একে তো ন্যাটিভ আমেরিকানদের বন্ধুবৎসল হিসাবে খুব একটা সুনাম নেই তার উপর রোদে ঘুরে ঘুরে আমাদের চারজনের চেহারা হয়েছে দেখার মতো| পোড়া চামড়া, লম্বা উশখু-খুশকো ঝুঁটি বাঁধা চুল, ধুলো মলিন জুতা দেখে কেউ হটাৎ ছন্নছাড়া ভাবলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না| পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ের মত প্রথমে উৎসব ভেবে আমরা এক ফ্যামিলি মিটিংয়ে ঢুকে গেলাম| তীক্ষ্ণ সরু দৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে মানে মানে কেটে পরলাম ওখান থেকে| একটু হাঁটার পরেই মূল জায়গার হদিস পাওয়া গেল| মাঠের চারপাশে বাঁশ দিয়ে গ্যালারি বানানো| সন্ধ্যার পরের প্যারেড উপভোগ করার জন্য সকাল থেকেই মানুষজন জায়গা দখলের জন্য ভাল জায়গায় চেয়ার, গ্যালারিতে তোয়ালে, কম্বল পেতে রেখে গেছে| অবাক লাগল গ্যালারির চারপাশে চাইনিজ খেলনা, মেক্সিকান খাবারের দোকান দেখে, যার বেশিরভাগই চালাচ্ছে খোদ ন্যাটিভ আমেরিকানরা !!!!! মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত উৎসবে আসল আদিবাসি পণ্য ছাড়া কিছুই ছিল না| এসব দেখে মনটা আবার একটু দমে গেল| দুই চক্কর দেয়ার পর একটা যুতসই জায়গা পাওয়া গেল| পাশেই বসা একজন ন্যাটিভ আমেরিকান আমাদের তথ্য দিয়ে প্রচুর সাহায্য করলেন| নিজেদের একজন আমাদের সাথে কথা বলছে দেখে আশেপাশের মানুষজনও সহজ হয়ে গেল আমাদের সাথে| চাইতেই ছবি তুলল| মাত্রই তাদের সুন্দরী প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ায় মেয়েরা বেশ বাহারি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঘুরছিলো| আমি নিজে না তুললেও রেজওয়ান আর অপু ভাই প্রচুর ছবি তুললেন|
সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ, যুদ্ধের দামামার বাদ্যে শুরু হল প্যারেড| তারপর নিজস্ব ভাষায় গান| গানের কিছুই না বুঝলেও রক্তে কেমন জানি নাচন লাগিয়ে দিচ্ছিল সেই সুর| গানের পরে আসল প্যারেড শুরু হল| নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অনেক বয়স্ক একজন লোক| তার চামড়ার ভাঁজই বুঝিয়ে দিচ্ছিল কত অভিজ্ঞতা, কত ঘটনা, কত গল্প লুকিয়ে আছে তার পরতে পরতে| ন্যাটিভদের যারা ইউ.এস. আর্মিতে আছে তারা ইউনিফর্ম পরে প্যারেডে অংশ নিয়েছিল| তবে আমার সাথের লোকজন যতটা উপভোগ করছিল আমি ততটা করিনি| এর কারণ মনে হল পূর্ববর্তী এম.এস.ইউ এর প্রোগ্রাম| ওই অনুষ্ঠানটা অনেক বড় পরিসরে হয়েছিল আর অনেক বেশি ট্রাইব অংশগ্রহণ করেছিল| এখানের অনুষ্ঠানটা ঘরোয়া হলেও অনেকেই দেখলাম জিন্সের প্যান্ট আর স্নিকার পরে নাচে অংশ নিয়েছে| এই ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি| আগের অনুষ্ঠানে এমনটা দেখিও নাই| মনে হচ্ছিলো ট্রাইব কালচারের মধ্যে মেইনস্ট্রিম আমেরিকান কালচার মিশে গেছে| ওদের কুটির শিল্পের কোন দোকান না থাকার ব্যাপারটাও আমাকে বেশ হতাশ করেছে| এছাড়া ট্রাইবাল প্যারেডের মধ্যে ইউ.এস. আর্মির ইউনিফর্ম পরে হাঁটাটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগছিল| তবে এগুলো আমার নিজস্ব মতামত| এরপরেও পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সেই প্রাচীন নাচ, যুদ্ধের বেশভূষা, মেয়েদের ঝলমলে পোশাক, সবার পোশাকেই ঈগলের পালকের কাজ রক্ত গরম করে দেয়| মনে হয় আমিও তাদেরই একজন| মাটির দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে আমারও এই বুনো পশ্চিমকে তার দূর্বার সৌন্দর্য নিয়ে স্বাধীন রাখতে| রাত অবধি এই উৎসব উপভোগ করে তারপর আবার পথে নামলাম|
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:২৩