মিশিগানে আমাদের মূলত দেখার প্ল্যান পৃথিবীর পাঁচটি গ্রেট লেকসের (সুপেরিয়র, মিশিগান, ইরি, ওন্টারিও, হিরন) মধ্যে দুইটি| লেক মিশিগান আর লেক সুপেরিয়র| অণু ভাইয়ের থেকে জানতে পারলাম এই পাঁচটি হ্রদে যে পরিমান সুপেয় পানি জমা আছে তা পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত হ্রদের থেকেও বেশি (এই মানুষটা একটা চলন্ত বিশ্বকোষ)| মিশিগান লাইটহাউজ বা বাতিঘরের স্টেট নামেও পরিচিত| বিশাল দুই লেকের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ১০০০ লাইটহাউজ| মিশিগানে ঢোকার মুখের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে যে ম্যাপ পাওয়া গেল তাতে দেখলাম দারুন এক কাঠের লাইট হাউজ আছে| বেশ আলাদা অন্যগুলোর চেয়ে| প্ল্যান হয়ে গেল যে এটা দেখতে যাব|
প্রথম স্টপেজ ম্যাকিনাও সিটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল| লেক মিশিগান আর লেক হিরণ এসে মিশেছে এখানেই| আজ রাতে আস্তানা গাড়ব এই শহরেই| রেজওয়ান থাকার জন্য ঠিক করল ওয়াটার ফ্রন্ট ইন নামে লেক হিরণের সৈকতের সাথে লাগানো ছিমছাম একটা মোটেলে| রেজওয়ানের পছন্দ আছে বলতে হবে| ফ্রন্ট ডেস্কে চেক-ইনের সময়ই শোনা গেল লেক হিরনের মৃদু গর্জণ| মোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে কর্মরত কালো মহিলাকে আমার কিছুটা বর্ণবাদী মনে হল| দীর্ঘদিন মোটেলে কাজের সুবাদে কিছু কিছু ব্যাপার খুব সহজেই ধরতে পারি| যাই হোক এইসব বেশি পাত্তা না দিয়ে চলে গেলাম নিজেদের রুমে| ডাবল বেডরুম নেয়ার কথা থাকলেও নেয়া হল কিচেনসহ দারুন এক কেবিন| ফুল কিচেন পেয়ে আমি আর অপু ভাই লেগে গেলাম রসনাবিলাসের কাজে| রেজওয়ানের আবদার খিচুড়ি আর গরুর মাংসের| সাথে অণু ভাইয়ের ছোট করে যোগ করলেন- "একটু আলু দিয়ে" (বি.দ্র. ইনসাইড টিপস- অণু ভাইয়ের প্রিয় খাবার তরকারির মধ্যের আলু| তার রুচি মোতাবেক আলুর সরবরাহ বজায় রাখতে এই বছর আইডাহো'র আলুর মজুদে টান পরার সম্ভবনা আছে)| দুই পেটুককে গরুর মাংশ আর টুকটাক বাজার করতে পাঠিয়ে আমি আর অপু ভাই লেগে গেলাম ভাত, বেগুন ভাজি আর আলু ভর্তা বানানোর কাজে| রাতে খাব আর পরদিন দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে যাব| রাঁধুনী সরিষার তেলে পেঁয়াজ হালকা করে ভেঁজে, কাঁচা মরিচ দিয়ে অপু ভাই যে আলুভর্তাটা বানালেন, বেগুন ভাজার সাথে তা জমলো বেশ| পেটপূজাটা যা হল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না| চেটেপুটে খেয়ে কোনমতে খিচুড়ি আর গরুর মাংশ চুলায় চড়িয়েই পড়িমড়ি করে সবার দৌড় সৈকতে| আমি ধারণা করেছিলাম যেহেতু একে বলা হয় গ্রেট লেক তাই বড় তো অবশ্যই হবে কিন্তু একি হ্রদ না মহাসমুদ্র !!!!! যেদিকেই চোখ যায় শুধু বিপুল জলরাশির সমাহার| "অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে" গান যেন এর সাথেই খাটে| অকূল দরিয়ার পাশে চাঁদের মায়াবি আলোয় মাঝরাত পর্যন্ত কাটিয়ে মোটেলে ফিরে নাক ডাকিয়ে দে ঘুম !!!!!
আলু ভর্তা আর বেগুন ভাঁজার কল্যানে ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলাই হয়ে গেল| স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে দিনের আলোতে হ্রদের রূপ দেখে সবাই যার যার ম্যান্ডাটরি সেলফি, ছবি তুলে রওয়ানা দিলাম লেক সুপিরিয়রে হাইকিং আর ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে| যাওয়ার পথে পড়লো লেক মিশিগান| গাড়ি থেকেই দেখে নিলাম যতটুকু দেখা যায়, লেক সুপেরিয়র যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!!!!! এই অপরূপাকে আমরা দেখবো Pictured Rocks National Lakeshore থেকে যা মূলত লেক সুপেরিয়রের দক্ষিণ অংশ| নানান রঙের পাথুরে ক্লিফের জন্য এটা বিখ্যাত| আজ রাত আমরা ক্যাম্পিং করে কাটাবো এই অপরূপার তীরে| প্রথম ক্যাম্পিং সাইট লিটল বিভারে যেয়ে দেখা গেলো ফোর্থ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লং উইকেন্ড পেয়ে ক্যাম্পিং সাইট পুরো ভর্তি| তাঁবু ফেলার মত একটা জায়গাও খালি নেই| অভিজ্ঞ "শেরপা" রেজওয়ান জানালো ১.৫ মাইল হাইকিং করে গেলে সবচেয়ে সুন্দর ভিউটা পাওয়া যাবে| হোক তাহলে তাই| লিটল বিভার হ্রদের ক্যাম্পিং সাইটে সাথে আনা খিচুড়ি, গরুর মাংশ সমানে সাঁটানো শুরু করলাম সবাই বোঝা কমানোর জন্য (সব বাজে কথা, আসলে রান্নার পর থেকেই গলধ:করণ করার পায়তারায় ছিল সবাই)| ছোট্ট একটি চিপমানক সম্মানিত অতিথি হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনে আমাদের সাথে অংশ নিয়ে সম্ভবত ইতিহাসে প্রথম খাঁটি বাঙালি স্বাদের ঝাল গরুর মাংশ, খিচুড়ি খেয়ে নিজেকে এবং লিটল বিভার হ্রদকে সম্মানিত করল| খাওয়া-দাওয়া শেষে তাঁবু আর পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে শুরু করলাম হাইকিং| জঙ্গলের সেই হাইকিংয়ে নিরেট প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো মশা| ৬ বছর আগে বাংলাদেশ ছাড়ার পর দেশীয় মশককূল আমাকে আর তেমন বাগে পায়নি| জাতভাইদের লোকসানের হিসাব মিশিগানের মশককূল করায় গন্ডায় আদায় করে নিল| কি তাদের সাইজ, কি তাদের কামড় !!!!! ৬ বছরের অনাদায়ী পাওনা এক বিকালে শোধ দিতে গিয়ে আমার ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি অবস্থা| জোর কদমে চলছি সবাই, ক্যাম্পিং সাইট অথবা বিচে পৌঁছাতে পারলেই মশার কামড় থেকে রক্ষা পাবো এই আশায়| বন পেরিয়ে যখন সৈকতে পৌছালাম তখন সবাই সেই রূপে জাস্ট নির্বাক| লেক সুপেরিয়র আসলেই সুপেরিয়র| কিনারায় স্বচ্ছ সবুজ জলের সাথে কিছুটা দূরে নীল জলের সঙ্গম চোখ ফেরাতে দেয়না| চোখ জুড়িয়ে দেখলাম সবাই এই সুন্দরী কন্যাকে| এর দিকে তাকিয়ে পার করা যায় সারা জীবন| সম্বিত ফিরতেই সকলে দৌড়াদোড়ি শুরু করে দিল| না রূপে পাগল হয়ে না| সৈকতের একচ্ছত্র অধিপতি মাছি| আর কি তাদের হুল !!!!! এক কামড়েই রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে যায়| কোটি কোটি মাছির সাম্রাজ্য সেই সৈকত জুড়ে| দাঁড়ান যায় না ৫ মিনিট ও| অণু ভাই মনের দু:খে কবিতা লিখলেন-
"বনে মশা, সৈকতে মাছি
এই নিয়ে মিশিগানে আছি"
এতক্ষনে বোঝা গেল বীচের অনান্য লোকজনের মুখে পরা অদ্ভুত জাল লাগান টুপির মানে| তারা সবাই পুরোপুরি ঢাকা জামা-কাপড় দিয়ে| দৌড়ে গেলাম লেকের পানিতে| হিমশীতল পানি দাঁড়াতে দেয় না বেশিক্ষন| বিরক্ত হয়ে অণু ভাই আর রেজওয়ান ভাই চলে গেল তাঁবু খাটাতে| সূর্যাস্ত পর্যন্ত মশা-মাছির ভয়ে ভিতরেই বসে আড্ডা মারলাম সবাই| সূর্যাস্তের আগে আগে আবার চলে গেলাম বীচে| সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য| সেই সৌন্দর্য মাছির হুলের বিষকেও শরীরে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলো কিচ্ছুক্ষনের জন্য|
আলো কিছুটা থাকতে থাকতে ফিরে এলাম তাঁবুতে| ক্যাম্পিংয়ে এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা| তাই প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আনিনি| না জানার খেসারত দিতে হয়েছে রাতের বেলা কষ্ট করে| কিছুটা কষ্ট হলেও সেই এক্সপেরিয়েন্স কখনো ভোলার নয়| তাঁবুর উপরের কভার খুলে সেই গহীন অরণ্যের গাছের ফাঁকে তারা দেখার তুলনা হয়না কোন কিছুর সাথেই| দূর থেকে ভেসে আসছিলো লেক সুপেরিয়রের ঘুম পাড়ানি গান............
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:১৩