somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমেরিকার পথে পথে ৩

১৩ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিশিগানে আমাদের মূলত দেখার প্ল্যান পৃথিবীর পাঁচটি গ্রেট লেকসের (সুপেরিয়র, মিশিগান, ইরি, ওন্টারিও, হিরন) মধ্যে দুইটি| লেক মিশিগান আর লেক সুপেরিয়র| অণু ভাইয়ের থেকে জানতে পারলাম এই পাঁচটি হ্রদে যে পরিমান সুপেয় পানি জমা আছে তা পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত হ্রদের থেকেও বেশি (এই মানুষটা একটা চলন্ত বিশ্বকোষ)| মিশিগান লাইটহাউজ বা বাতিঘরের স্টেট নামেও পরিচিত| বিশাল দুই লেকের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ১০০০ লাইটহাউজ| মিশিগানে ঢোকার মুখের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে যে ম্যাপ পাওয়া গেল তাতে দেখলাম দারুন এক কাঠের লাইট হাউজ আছে| বেশ আলাদা অন্যগুলোর চেয়ে| প্ল্যান হয়ে গেল যে এটা দেখতে যাব|

প্রথম স্টপেজ ম্যাকিনাও সিটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল| লেক মিশিগান আর লেক হিরণ এসে মিশেছে এখানেই| আজ রাতে আস্তানা গাড়ব এই শহরেই| রেজওয়ান থাকার জন্য ঠিক করল ওয়াটার ফ্রন্ট ইন নামে লেক হিরণের সৈকতের সাথে লাগানো ছিমছাম একটা মোটেলে| রেজওয়ানের পছন্দ আছে বলতে হবে| ফ্রন্ট ডেস্কে চেক-ইনের সময়ই শোনা গেল লেক হিরনের মৃদু গর্জণ| মোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে কর্মরত কালো মহিলাকে আমার কিছুটা বর্ণবাদী মনে হল| দীর্ঘদিন মোটেলে কাজের সুবাদে কিছু কিছু ব্যাপার খুব সহজেই ধরতে পারি| যাই হোক এইসব বেশি পাত্তা না দিয়ে চলে গেলাম নিজেদের রুমে| ডাবল বেডরুম নেয়ার কথা থাকলেও নেয়া হল কিচেনসহ দারুন এক কেবিন| ফুল কিচেন পেয়ে আমি আর অপু ভাই লেগে গেলাম রসনাবিলাসের কাজে| রেজওয়ানের আবদার খিচুড়ি আর গরুর মাংসের| সাথে অণু ভাইয়ের ছোট করে যোগ করলেন- "একটু আলু দিয়ে" (বি.দ্র. ইনসাইড টিপস- অণু ভাইয়ের প্রিয় খাবার তরকারির মধ্যের আলু| তার রুচি মোতাবেক আলুর সরবরাহ বজায় রাখতে এই বছর আইডাহো'র আলুর মজুদে টান পরার সম্ভবনা আছে)| দুই পেটুককে গরুর মাংশ আর টুকটাক বাজার করতে পাঠিয়ে আমি আর অপু ভাই লেগে গেলাম ভাত, বেগুন ভাজি আর আলু ভর্তা বানানোর কাজে| রাতে খাব আর পরদিন দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে যাব| রাঁধুনী সরিষার তেলে পেঁয়াজ হালকা করে ভেঁজে, কাঁচা মরিচ দিয়ে অপু ভাই যে আলুভর্তাটা বানালেন, বেগুন ভাজার সাথে তা জমলো বেশ| পেটপূজাটা যা হল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না| চেটেপুটে খেয়ে কোনমতে খিচুড়ি আর গরুর মাংশ চুলায় চড়িয়েই পড়িমড়ি করে সবার দৌড় সৈকতে| আমি ধারণা করেছিলাম যেহেতু একে বলা হয় গ্রেট লেক তাই বড় তো অবশ্যই হবে কিন্তু একি হ্রদ না মহাসমুদ্র !!!!! যেদিকেই চোখ যায় শুধু বিপুল জলরাশির সমাহার| "অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে" গান যেন এর সাথেই খাটে| অকূল দরিয়ার পাশে চাঁদের মায়াবি আলোয় মাঝরাত পর্যন্ত কাটিয়ে মোটেলে ফিরে নাক ডাকিয়ে দে ঘুম !!!!!

আলু ভর্তা আর বেগুন ভাঁজার কল্যানে ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলাই হয়ে গেল| স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে দিনের আলোতে হ্রদের রূপ দেখে সবাই যার যার ম্যান্ডাটরি সেলফি, ছবি তুলে রওয়ানা দিলাম লেক সুপিরিয়রে হাইকিং আর ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে| যাওয়ার পথে পড়লো লেক মিশিগান| গাড়ি থেকেই দেখে নিলাম যতটুকু দেখা যায়, লেক সুপেরিয়র যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!!!!! এই অপরূপাকে আমরা দেখবো Pictured Rocks National Lakeshore থেকে যা মূলত লেক সুপেরিয়রের দক্ষিণ অংশ| নানান রঙের পাথুরে ক্লিফের জন্য এটা বিখ্যাত| আজ রাত আমরা ক্যাম্পিং করে কাটাবো এই অপরূপার তীরে| প্রথম ক্যাম্পিং সাইট লিটল বিভারে যেয়ে দেখা গেলো ফোর্থ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লং উইকেন্ড পেয়ে ক্যাম্পিং সাইট পুরো ভর্তি| তাঁবু ফেলার মত একটা জায়গাও খালি নেই| অভিজ্ঞ "শেরপা" রেজওয়ান জানালো ১.৫ মাইল হাইকিং করে গেলে সবচেয়ে সুন্দর ভিউটা পাওয়া যাবে| হোক তাহলে তাই| লিটল বিভার হ্রদের ক্যাম্পিং সাইটে সাথে আনা খিচুড়ি, গরুর মাংশ সমানে সাঁটানো শুরু করলাম সবাই বোঝা কমানোর জন্য (সব বাজে কথা, আসলে রান্নার পর থেকেই গলধ:করণ করার পায়তারায় ছিল সবাই)| ছোট্ট একটি চিপমানক সম্মানিত অতিথি হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনে আমাদের সাথে অংশ নিয়ে সম্ভবত ইতিহাসে প্রথম খাঁটি বাঙালি স্বাদের ঝাল গরুর মাংশ, খিচুড়ি খেয়ে নিজেকে এবং লিটল বিভার হ্রদকে সম্মানিত করল| খাওয়া-দাওয়া শেষে তাঁবু আর পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে শুরু করলাম হাইকিং| জঙ্গলের সেই হাইকিংয়ে নিরেট প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো মশা| ৬ বছর আগে বাংলাদেশ ছাড়ার পর দেশীয় মশককূল আমাকে আর তেমন বাগে পায়নি| জাতভাইদের লোকসানের হিসাব মিশিগানের মশককূল করায় গন্ডায় আদায় করে নিল| কি তাদের সাইজ, কি তাদের কামড় !!!!! ৬ বছরের অনাদায়ী পাওনা এক বিকালে শোধ দিতে গিয়ে আমার ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি অবস্থা| জোর কদমে চলছি সবাই, ক্যাম্পিং সাইট অথবা বিচে পৌঁছাতে পারলেই মশার কামড় থেকে রক্ষা পাবো এই আশায়| বন পেরিয়ে যখন সৈকতে পৌছালাম তখন সবাই সেই রূপে জাস্ট নির্বাক| লেক সুপেরিয়র আসলেই সুপেরিয়র| কিনারায় স্বচ্ছ সবুজ জলের সাথে কিছুটা দূরে নীল জলের সঙ্গম চোখ ফেরাতে দেয়না| চোখ জুড়িয়ে দেখলাম সবাই এই সুন্দরী কন্যাকে| এর দিকে তাকিয়ে পার করা যায় সারা জীবন| সম্বিত ফিরতেই সকলে দৌড়াদোড়ি শুরু করে দিল| না রূপে পাগল হয়ে না| সৈকতের একচ্ছত্র অধিপতি মাছি| আর কি তাদের হুল !!!!! এক কামড়েই রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে যায়| কোটি কোটি মাছির সাম্রাজ্য সেই সৈকত জুড়ে| দাঁড়ান যায় না ৫ মিনিট ও| অণু ভাই মনের দু:খে কবিতা লিখলেন-

"বনে মশা, সৈকতে মাছি
এই নিয়ে মিশিগানে আছি"

এতক্ষনে বোঝা গেল বীচের অনান্য লোকজনের মুখে পরা অদ্ভুত জাল লাগান টুপির মানে| তারা সবাই পুরোপুরি ঢাকা জামা-কাপড় দিয়ে| দৌড়ে গেলাম লেকের পানিতে| হিমশীতল পানি দাঁড়াতে দেয় না বেশিক্ষন| বিরক্ত হয়ে অণু ভাই আর রেজওয়ান ভাই চলে গেল তাঁবু খাটাতে| সূর্যাস্ত পর্যন্ত মশা-মাছির ভয়ে ভিতরেই বসে আড্ডা মারলাম সবাই| সূর্যাস্তের আগে আগে আবার চলে গেলাম বীচে| সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য| সেই সৌন্দর্য মাছির হুলের বিষকেও শরীরে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলো কিচ্ছুক্ষনের জন্য|

আলো কিছুটা থাকতে থাকতে ফিরে এলাম তাঁবুতে| ক্যাম্পিংয়ে এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা| তাই প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আনিনি| না জানার খেসারত দিতে হয়েছে রাতের বেলা কষ্ট করে| কিছুটা কষ্ট হলেও সেই এক্সপেরিয়েন্স কখনো ভোলার নয়| তাঁবুর উপরের কভার খুলে সেই গহীন অরণ্যের গাছের ফাঁকে তারা দেখার তুলনা হয়না কোন কিছুর সাথেই| দূর থেকে ভেসে আসছিলো লেক সুপেরিয়রের ঘুম পাড়ানি গান............










সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:১৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×