আমেরিকায় আসার আজকে ১ বছর ৯ মাস হয়ে গেল। এখনো মনে হয় এইতো সেইদিন এসেছিলাম। বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের ঐপারে আব্বু-আম্মু, মামা, বন্ধুরা সবাই দাড়িয়ে আছে। আম্মু শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখার চেষ্টা করতেছিল। আমি শেষ পর্যন্ত ভালো মত দেখতে পাইনি। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। জীবন বলতে আসলে যা বুঝায় তা ফেলে এসেছিলাম ঐদিন বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের ঐপারে। এরপর এই এতটা সময় কিভাবে চলে গেছে জানিনা। এভাবে হয়ত আরো বহু বছর কেটে যাবে................জানি না কবে দেশে আসার সুযোগ হবে। মনে হয় এক অনন্তকাল আগে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম। দেশে আসতে গেলে টিউশন ফিসের টাকায় শর্ট পরে যায়। তাছাড়া একদম খালি হাতে তো দেশে আসা যায় না। আত্মীয়-স্বজনের জন্য গিফটের ব্যাপার আছে। নিজের খরচ আছে।
আমি দেশের কথা ভাবি যেভাবে রেখে আসছিলাম সেইভাবেই। আম্মু সকালে নাস্তা বানাচ্ছে, আব্বু বাজারে যাচ্ছে। আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরী করছি দেখে আমার উপর দুইজনই চরম বিরক্ত। আম্মু বার বার বলছে "বাবু নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে"। সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়ার আগে নাস্তা না হলে আমার চলতই না। আম্মু অফিস থেকে এসে তাই কিছু না কিছু বানিয়ে দিত। তারপর আড্ডা আর আড্ডা। ভাবি বন্ধুরা হয়ত আড্ডা দিচ্ছে আগের মতোই। কারো কোনো কাজ নাই। কে কার চেয়ে বড় ভাদাইম্মা তা নিয়ে তর্ক চলে এখনো। বন্ধুরা সবাই আছে একসাথে। ওদের স্মৃতিতে হয়ত রাজনের কথা ঝাপসা হয়ে যাবে একসময়..........অনেক নতুন স্মৃতি লেখা হবে আমার স্মৃতির উপরে। কিন্তু ওরা থাকবে আমার কাছে সবসময় আগের মতই, আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোর সাক্ষী হয়ে। ভাবি স্বপ্নগুলোর কতটা সত্যি হয়েছে যা দেখেছিলাম সবাই মিলে।
প্রিয় এক মানুষের কথা মনে পরে। মনে পরে তার সাথে কাটানো সেই দিনগুলো। পুরান ঢাকার সব কোনায় কোনায় ঢুঁ মেরে খাবারের দোকান খুঁজে বের করে তাতে খাবার টেস্ট করা। আমার অতিরিক্ত খাই খাই স্বভাবে তার মিষ্টি বিরক্তি। নান্না অথবা মামুনে খাওয়ার পর সেই ছোট্ট মিষ্টি পানের দোকানটার অসাধারণ পানের স্বাদ কি তার মনে আছে এখনো? বিরতিহীন সেই ঘুরে বেড়ানো.........আমি নেই তাই আজ তার কোথাও যাওয়া হয়না, খাওয়াও হয়না।
ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকালে আনমনা হয়ে যাই, সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে ইচ্ছা হয়। তারপর থমকে যাই। আমার ভাবতে ভালো লাগে একদিন আমিও দেশে যাব, এয়ারপোর্ট থেকে নেমে উত্তরার যানজটে আটকা পরে অতিষ্ট হব, খিদমায় ভাদাইম্মার মত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিব নিশ্চিন্ত ভাবে পয়সা ছাড়া, চিনি বেশি চা এর সাথে এক সিগারেট ৩-৫ জন কাড়াকাড়ি কইরা খাব, কারেন্ট গেলে গরমে ত্যাক্ত-বিরক্ত হইয়া ছাদে যাব.....সেই পানির টাঙ্কির উপরে শুইয়া হেড়ে গলায় গান গাব আর সিগারেট খাব.....বৃষ্টির দিনে রিক্সায় পুরান ঢাকায় যাব তেহারি খেতে অতি আপন বিশেষ সেই মানুষের সাথে.....সারা রাত বন্ধুদের সাথে তাস খেলব.....পরে বিকালে ঘুম থেকে উঠব এলার্ম ছাড়াই.....তারপর আম্মুর মজার রান্না খাব.....আমার ভাবতে ভালো লাগে একদিন আমি দেশে যাব...........এইবার দেশে গেলে রাঙামাটি আর বান্দরবান বন্ধুদের সাথে ঘুরে আসতেই হবে। টাকার অভাবে কতবার প্ল্যান করেও যাওয়া হলোনা। এবার যেতেই হবে। সাঙ্গু নদীতে নৌকায় তিন চার রাত থাকার স্বপ্ন যে অনেকদিনের।
যারা সামনে আমেরিকায় অথবা অন্য যে কোনো দেশেই পড়তে যাচ্ছেন তাদের জন্য কয়েকটা কথা...........কারো থেকে কোনো আশা রাখবেন না বিদেশে। মানুষ কত বিচিত্র স্বভাবের হতে পারে তা বিদেশে না আসলে কোনদিন বুঝবেন না। এই দেড় বছরে আমি কি শিখেছি? শিখেছি "দিনের শেষে আমরা সবাই একা....." এখানে কেউ কারো নয়। ভেবে রাখবেন জীবনের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন একা। তাহলে পরে অতটা খারাপ লাগবে না। কাজ করার সময় মাঝে মধ্যে মন খারাপ হবে। কাজের চাপে অথবা দেখবেন আপনার বন্ধু-বান্ধব বাইরে কোথাও একসাথে যাবার বা গেট টুগেদারের প্ল্যান করেছে কিন্তু ঐসময় আপনার কাজের শিডিউল পরেছে। এম.এস.ইউ তে সেমিস্টারের শেষে আমার সাথে আসা নতুন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা যখন পার্টি করছিল, সেই একই জায়গায় আমি কাজ করছিলাম। তীব্র মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। এভাবেই দূর থেকে দেখতে হয়েছিল, দেখতে হয় আর সামনেও দেখতে হবে। মানিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। বেস্ট উপায় হলো আপনার কাজের পরে একটা পার্টি করে নেয়া, ছোট করে হলেও। সব সময় না হলেও মাঝে মধ্যে তো বটেই। না হলে হতাশা এমন ভাবে একসময় আঁকড়ে ধরবে যে পালাবার পথ পাবেন না। আর খরচ? সব সময় টাকার কথা চিন্তা করলে হয় না রে ভাই। পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজার সময় অসম্ভব মন খারাপ হবে। হয়ত কাজের চাপে নামাজ পড়তে যেতে পারবেন না, ভালো রান্না করার সময় পাবেন না। নিউ ইয়র্ক ছাড়া বাইরের স্টেটে থাকলে ঈদের দিন যে কতটা ভয়াবহ রকমের সাধারণ হতে পারে তা দেখবেন। নিউ ইয়র্কে যা হয় তাও বাংলাদেশের ১০০ মাইলের ধারে কাছে দিয়ে যায় না। কারণ ? কারণ এটা বাংলাদেশ না। আপনার আত্মার মানুষগুলো এখানে নেই। সব চেয়ে ভালো হয় যদি এই উৎসবগুলোর দিন কাজ থেকে ছুটি নিতে পারেন। ভালো কিছু বাসায় রান্না করলেন নাহলে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসলেন যাদের সাথে এখানে বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের নিয়ে। অথবা বাসায় বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিয়েই কোনো পার্টি করলেন। দেখবেন ভালো লাগবে অনেকটাই।
আমেরিকায় আমার প্রথম বছরের কাহিনী এতটুকুই। এই দীর্ঘ একবছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, কারো কারো সাথে মনোমালিন্য হয়েছে, নিজের নড়বড়ে অবস্থার কারণে অনেকের অনেক দুর্ব্যবহারও সহ্য করতে হয়েছে। এই লেখায় ওইগুলোর রিলেটেড সব ঘটনা আমি এড়িয়ে গেছি একটা বিশেষ কারণে। কারণটা হলো যখন অনেক বুড়ো হয়ে যাব (যদি ততদিন বাঁচি আর কি), স্মৃতির পাতা যখন ঝাপসা হয়ে যাবে, তখন হয়ত কোন একদিন এই লেখা পরে স্মৃতি রোমন্থন করব, নিজে নিজে হাসব। ওই মানুষগুলোর কারণে একবার কষ্ট পেয়েছি, দ্বিতীয়বার পাওয়ার কোনো মানে হয় না।
সময় নষ্ট করে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
(সমাপ্ত)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)