বাসায় এসে আকাশ-পাতাল চিন্তা করলাম। শেষ পর্যন্ত ফাইনাল ডিসিশন নিলাম যে এ.এস.এ. কলেজেই আপাতত পড়ব। এর পিছনে কয়েকটা কারণ ছিল। প্রথমত ফিরোজ ভাই তখনও আসেননি। নিউ ইয়র্কে এসে পরলে আবার বেকার অথবা অল্প স্যালারীর জব করতে হবে। দ্বিতীয়ত এতদিন আরামের জব করে শরীরে বেশ তেল হয়েছে। এখন আর রেস্টুরেন্ট অথবা গ্যাস স্টেশনে জব করতে ইচ্ছা করে না। তৃতীয়ত এ.এস.এ. কলেজে উইক-এন্ড ক্লাস আছে। এর মানে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন এখানে এসে ক্লাস করে আর বাকি পাঁচদিন আমি কানেকটিকাটে জব করতে পারব। আসা যাওয়ায় একটু কষ্ট আর খরচ হবে কিন্তু অন্য দিকে থাকা-খাওয়ার খরচ বাঁচবে। রুম শেয়ার করতে হবেনা, আরামে থাকা যাবে। এই সব ভেবে তার পরদিন সার্টিফিকেট, ব্যান্ক স্টেটমেন্ট নিয়ে এ.এস.এ. কলেজে গেলাম। ওগুলো সাবমিট করে এপ্লিকেশন ফিস দিয়ে সাথে সাথে এক্সেপ্টেন্স লেটার নিয়ে নিলাম। তখনি আবার গেলাম হোস্টস কলেজে। যেয়ে বললাম আমি এখান থেকে ট্রান্সফার নিব। তারা বলল ট্রান্সফার দেয়া যাবেনা। কারণ তুমি এখনো রেজিস্ট্রেশন করনি। রেজিস্ট্রেশন করা ছাড়া আমরা কারো নামে আই-২০ ইস্যু করি না। আর আই-২০ ইস্যু না হলে ট্রান্সফার করা যাবে না। ওখান থেকেই ফোন দিলাম এ.এস.এ. কলেজের এডভাইসরকে। বললাম অবস্থা। সে বলল তুমি ওখানকার ইন্টারন্যাশনাল এডভাইসর এর ই -মেইল আই.ডি. নিয়ে এস, আমি যোগাযোগ করব। আমার কাছেই ছিল। মেসেজ করে পাঠিয়ে দিলাম।
নিউ ইয়র্কে কলেজের কাজে আছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। কানেকটিকাটে তেমন কিছু বলে আসিনি। ইমেল ভাই সামলে নিচ্ছিল। তাই ট্রান্সফারের প্রসেসিং শেষ হতে হতে আমি এখানে বসে থাকার কোন মানে দেখলাম না। কানেকটিকাটে যেয়ে জব করতে থাকলাম।
দুই-তিন দিন পরে এ.এস.এ কলেজের ইন্টারন্যাশনাল এডভাইসর আগাথা আমাকে ই -মেইলে জানালো তার সাথে লিসান্কা সোতো'র যোগাযোগ হয়েছে। ই -মেইলের মাধ্যমেই। যদিও আমার পাঠানো ই -মেইলের জবাব লিসান্কা সোতো তখন পর্যন্ত দেয়নি। লিসান্কা সোতো তাকে জানিয়েছে তাদের পক্ষে আমাকে এই মুহুর্তে ট্রান্সফার করা সম্ভব নয় কারণ এখন পর্যন্ত আমি তাদের কলেজে রেজিস্টার্ড স্টুডেন্ট নই। আগাথা তাকে বলেছিল যে আমাকে রেজিস্ট্রার করে তারপর ট্রান্সফার করতে কিন্তু সে তাতেও রাজি হয়নি। এটা নাকি তাদের কলেজের নিয়মে নেই। লিসান্কা সোতো'র সাজেশন হলো আমি যেন এই সেমিস্টার হোস্টস কলেজে করে তারপর ট্রান্সফার হই। কি অদ্ভুত কথা !!!!! যেখানে এনরোল করতে গিয়ে ঝামেলার কারণেই ট্রান্সফারের কথা চিন্তা করলাম সেইটাই আবার বলতেছে উনি। বলি এনরোলের জন্য যে সব ফর্ম পূরণ করতে হবে ওগুলার কি হবে? আগাথাকে জিগ্গেস করলাম এখন কি করব? তুমি কি আমাকে আর কোনো ভাবে হেল্প করতে পার? ও বলল আমার পক্ষে আর কোনো হেল্প করা সম্ভব না তোমাকে, কারণ তুমি আমাদের কলেজের স্টুডেন্ট না। এখন তুমি যদি একান্তই ট্রান্সফার হতে চাও, তাহলে একমাত্র হেল্প করতে পারবে তোমার আগের স্কুল মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্টমেন্ট। তুমি আমাদের কলেজের এক্সেপ্টেন্স লেটার ওদেরকে পাঠাও, সব ঘটনা খুলে বলে রিকোয়েস্ট কর আগের ট্রান্সফার ক্যানসেল করে আমাদের এখানে নতুন করে ট্রান্সফার করতে। এখন ওরা এটা করবে কিনা সেইটা হচ্ছে কথা। কারণ যেহেতু ওরা তোমাকে একবার ট্রান্সফার করে দিয়েছে তাই এখন এটা আর ওদের দায়িত্ব না। আর এই কাজটা করাটা একটু ঝামেলার ও। সেভিস ডিপার্টমেন্টকে ফোন করে কাজটা করতে হবে ওই এডভাইসরের। কথা বলে দেখো যদি তারা এটা করতে রাজি হয় তাহলে এ.এস.এ. কলেজে আসতে পারবে নাহলে এই সেমিস্টার তোমাকে হোস্টস কলেজেই করতে হবে।
আগাথার সাথে এই কথা হওয়ার পর আমি মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্টমেন্টের নাথালির সাথে যোগাযোগ করলাম। আগেই একটা পর্বে বলেছিলাম যে এই মহিলা অসম্ভব ভালো। আর আমি আসার আগে ও বলেছিল ভবিষ্যত এও কোনো সাহায্যের দরকার হলে আমি যেন ওর সাথে যোগাযোগ করি। নাথালিকে সব ব্যাপার খুলে বললাম। ও আমাকে বলল তুমি শিওর এটা করবে? আমি বললাম হ্যা। নাথালি আমাকে আশ্বস্ত করলো ও এটা করে দিবে। ১৫ দিন পর এ.এস.এ. কলেজ থেকে মেইল পেলাম যে আমার সেভিস ট্রান্সফার হয়ে গেছে। নাথালি এতই ভালো যে কিছুদিন পর ও আবার মেইল করে জানতে চেয়েছিল সব কিছু ঠিক ঠাক মত হয়েছে কিনা, আমি এখন পুরো সেট কিনা, আর কোনো সমস্যা আছে কিনা। ওকে প্রতিউত্তরে জানালাম সব ঠিক আছে আর অনেক ধন্যবাদ ও জানালাম। এই ভদ্রমহিলার কথা মনে থাকবে সবসময়।
এরপর শুরু হলো ভিন্ন দুই স্টেটে আমার নতুন জীবন। থাকি কানেকটিকাটে, ক্লাস করি নিউ ইয়র্কে এসে। সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস। শনিবার আর রবিবার, সকাল ৯.০০ টা - বিকাল ৬.০০ টা পর্যন্ত। শনিবার মাঝে এক ঘন্টা ব্রেক পাওয়া যায় আর রবিবার টানা। শনিবার ভোর ৫.০০ টায় ঘর থেকে বের হয়ে ৫.৩০ এর বাস ধরতাম। ৮.৩০-৮.৪৫ এর মধ্যে পৌছে যেতাম নিউ ইয়র্ক সিটিতে। শনিবার রাতটা ফিরোজ ভাই অথবা শিবলীর বাসায় থেকে রবিবার ক্লাস করে আবার বাস ধরে হার্টফোর্ড এ এসে পরতাম। বাকি ৫ দিন জব। অনেকেই কানেকটিকাট থেকে নিউ ইয়র্ক এসে ক্লাস করি শুনলে অবাক হয়ে যেত। কেউ কেউ আমাকে বেকুব ভাবত। কিন্তু আমার ভালই লাগত। আমার পয়েন্ট অফ ভিউটা ছিল যে নিউ ইয়র্কে থাকলে আমার ৭ দিনই কষ্ট করতে হবে। যেহেতু মোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কের মত আরামের জব পাওয়া এইখানে কঠিন। তাছাড়া স্যালারি ও কম পাব। বেশ অনেক গুলো টাকা ভাড়া দেয়ার পরও রুম শেয়ার করতে হবে। এর চেয়ে আমি সপ্তাহে দুই দিন কষ্ট করব বাকি পাঁচ দিন আরামে থাকব। হ্যা এটা ঠিক যে নিউ ইয়র্কের একটা আলাদা চার্ম আছে। সেই চার্ম আমি পুরোটা নিতে না পারলেও বেশ অনেকটাই নিয়েছি। এর পুরো ক্রেডিট অবশ্য যায় অর্ণব আর শিবলীর উপর। আমার এই দুই বন্ধু আমি নিউ ইয়র্ক আসলে প্রতি সপ্তাহে যে পরিমান সময় আমাকে দেয় তা কল্পনার বাইরে। শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত ওদের সাথে ঘোরাঘুরি, রাত্রে জ্যাকসন হাইটসে খেয়ে দেয়ে রাস্তার পাশে চা হাতে গল্প করা অথবা শিবলীর বাসায় থাকলে প্রতিবারই আমাকে নতুন কিছু রান্না করে খাওয়ানো। ওদের দুই জনের কারণে কষ্ট আর কষ্ট লাগত না। এটুকু বলতে পারি আমার পরিচিত অনেকেই যারা রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারী শপ অথবা গিফট শপে রাত দিন পরিশ্রম করে টিউশন ফিস আর থাকা-খাওয়ার খরচ ম্যানেজ করত তাদের চেয়ে আল্লাহর রহমতে আমি আরামে ছিলাম, আল্লাহ আমাকে ভালো রেখেছিলেন।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)