কানেকটিকাট:
বাসে করে নিউ ইয়র্ক থেকে একটু বের হতেই আশে পাশের দৃশ্য আর নিউ ইয়র্ক সিটির সাথে মিলানো গেল না। বিরাট হাইওয়ের পাশে গাছ, ছোট ছোট পাথুরে টিলা অথবা একেবারেই ফাঁকা। হেডফোন কানে গান শুনতে শুনতে সেই হাইওয়েতে ভালই লাগছিল। কোথায় যেন মন্টানার সাথে একটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। সাড়ে তিন ঘন্টা পর পৌঁছালাম হার্টফোর্ডে। পোর্ট অথরিটির তুলনায় ছোট্ট একটা বাস স্টেশন। বাস স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সেই মোটেলে। ডাউন টাউনের পাশেই কিন্তু একটু নিরিবিলিতে মোটেলটা। ট্যাক্সি থেকে নামতেই দেখি ইমেল ভাই স্যুটেড-বুটেড হয়ে দাড়িয়ে আছে, জবে ঢোকার জন্য তৈরী। প্রথমে আমাকে মোটেলের অন্যান্য স্টাফদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথমেই পরিচয় হলো মানু পাটেল ওরফে মেশিন পাটেলের সাথে। এই ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ৬৫+। কাজ করতে পারে সমানে। সেইটা প্রবলেম না। প্রবলেম হলো এই ব্যাটা মালিকরে তেল মারতে প্রায়ই ফ্রি কাজ করে যার মাশুল পরে আমাদের দিতে হয় । ওনার বেতনও আমাদের চেয়ে কম। অবশ্য এই তেল মারার সুফল সে ভালই পায়। ইংরেজিতে খুবই দুর্বল হওয়ার পর ও হাউজকীপার থেকে সে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ নিয়ে নিছে। বুদ্ধিমান লোক হওয়ায় জোড়া-তালি দিয়ে অদ্ভুত ইংরেজিতে কেমন করে জানি কাজও চালিয়ে নিচ্ছে।
ইমলু ডিমলু
হার্টফোর্ডে দেখতে দেখতে অনেকদিন হয়ে গেল। এই লম্বা সময়ে বন্ধু, বড় ভাই, যে কোনো কিছু শেয়ার করার মানুষ, সমস্ত বদমাইশির সঙ্গী এই ইমেল ভাই। ছোট খাটো, হাসি খুশি, হ্যান্ডসাম ছেলে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বি.বি.এ শেষ করে এখানে এম.বি.এ করছেন। বিরাট বড়লোকের ছেলে কিন্তু ভিতরে বড়লোকি ভাব নেই। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ার সুবাদে বাংলাদেশের অনেক শিল্পপতির ছেলেদের ক্লাসমেট হিসাবে পেয়েছিলাম। তাদের অনেকেই ভাবের চোটে প্রায় উল্টাইয়া থাকত বেশিরভাগ সময়। ইমেল ভাই সম্পূর্ণ এর বিপরীত। মজার মজার কথা বলে বেশির ভাগ সময় হাসায়া আমার মুখ ব্যাথা করা তার দৈনন্দিন কাজের একটা অংশ। প্রথমে যখন ইমেল ভাইকে দেখি তখন অবশ্য এমন মনে হয়নি। যে কনফারেন্সে পরিচয় হয়েছিল সেখানে উনি বড় জোর ৫-৬ টা বাক্য মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন। আমি আর চৈতী কনফারেন্স থেকে বের হয়ে বলতেছিলাম -"শালার ভাব কি, ব্যাটা মাত্র ভিসা পাইছস আর ভাব নিতাছস যেন আমেরিকা থেকে পি.এইচ.ডি. শেষ কইরা আসছস" । সেই ইমেল ভাইয়ের পুরাই অন্যরকম চেহারা এইখানে আসার পর। পরে জেনেছিলাম ঐদিন উনি খুবই টেনসড ছিলেন কারণ দুই দিন পরেই ছিল ওনার ফ্লাইট। ইমেল ভাইয়ের জব করার কোনো প্রয়োজন নেই কারণ বাসা থেকেই ওনার টিউশন ফিস আসে। চাইলে ফ্যামিলি থেকে থাকা-খাওয়ার খরচ ও পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু এই ধাড়ি বয়সে বাবার থেকে টিউশন ফিস এর সাথে থাকা-খাওয়ার খরচ নিতে ওনার লজ্জা লাগে তাই জব করেন।
ইমেল ভাইয়ের আছে এক ঐতিহাসিক প্রেম । ঐতিহাসিক বললাম এই কারণে যে এই ব্যক্তি সারাক্ষণ প্রেমের মধ্যেই ডুবে থাকেন। সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে এই কপোত-কপোতির মুঠোফোনে প্রেমের কল-কাকলিতে। সকালের এই প্রেম চলতে থাকে দুপুরের রান্না পর্যন্ত। ইমেল ভাইয়ের কপাল খারাপ যে বাংলাদেশে রাত নামক একটা বিরক্তিকর বস্তু আসে যার ফলে আপুর ঘুমাইতে যেতে হয়। এই সময়টা ইমেল ভাইও অতিকষ্টে কোনমতে ফেসবুক, মুভি দেখে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। তারপর? আবার যাত্রা শুরু প্রেমের। রাত্রে জবেও চলতে থাকে এই অবিনশ্বর প্রেম। আপুটাও অনেক সুইট। ইমেল ভাইয়ের সাথে কিচির মিচির করতেই থাকে। ইমেল ভাইয়ের নাম ইমলু ডিমলু ওনারই দেয়া। ইমেল ভাই ও খেয়েদেয়ে ফুলতে ফুলতে নামকরণের স্বার্থকতা প্রমানে ব্যস্ত (আমিও মোটকু হওয়ায় ইমেল ভাইয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছি, হেরে যাওয়ার জন্য সকলের দোয়া প্রার্থী )। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে গিফট, প্রেমময় ইমেইল, চিঠি তো আছেই। এমন ঝগড়া বিহীন সুখী প্রেম সাধারনত দেখা যায় না। ওনার এই প্রেম থাকুক সারাজীবন। কয়েকটা মানুষের নাহলে ঘুম নষ্ট হলো, রান্না একটু দেরিতে হলো..........কি আসে যায় তাতে? প্রেম চলুক তার আবহমান গতিতে।
ইমেল ভাইয়ের এম.বি.এ প্রায় শেষের দিকে। কিছুদিন হয়ত জব করবেন তারপর বাংলাদেশে যেয়ে নিজেদের বিজনেস দেখাশুনা। ১২৬ নাম্বার রুমের অসাধারণ স্মৃতিগুলো নিয়ে আমি রাজন আবার একলা................ইমেল ভাই বিহীন আমেরিকা কেমন লাগবে? নিয়তি আমাকে বহুবার আপনজনদের থেকে দুরে নিয়েছে, আরেকবারও নেবে। আমি নিয়তির প্রতি শীতল দৃষ্টি দেব আর ভাবব একদিন আমারও সময় আসবে। সেইদিন আমার নিয়তি আমি নিজেই লিখব।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)