আমেরিকায় আসার প্রায় এক মাস পরে চৈতির সুত্রে জানলাম, যে মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিলিংস ক্যাম্পাসে আরো দুইটা ছেলে নাকি এসেছে। রাজীব আর শুভ। ফোন নাম্বার দিল চৈতি। এভাবেই পরিচয় হয় রাজিবের সাথে। রাজিবকে আপনারা চিনবেন। বাংলালিঙ্কের আলাল-দুলাল এডটার কথা মনে আছে? ওখানে যে জমজ দুইটা ছেলে আলাল-দুলাল হয়েছিল তার একজন ও। পুরো আমার অবস্থায় ছিল ও। আমার সাথে একই সেমিস্টারে এসেছিল ও। রাজিবের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ হত সবচেয়ে বেশি। আমি তো তাও কয়েকজন বাঙালি পেয়েছিলাম, ওরা ছিল শুধুই দুই জন। অবশ্য একমাস পরেই ওরা নিউ ইয়র্কের একটা কলেজে ট্রান্সফার হয়ে যায়। আমি যখন নিউ ইয়র্কে যাই, অনেক মানা করা স্বত্তেও এই ছেলে নিজে মাটিতে ঘুমিয়ে আমাকে ওর বিছানায় ঘুমাতে দিয়েছে। অনেক মানুষের সাথেই তো পরিচয় হলো আসার পর, এমন আথিতেয়তা যারা দিয়েছে, তাদের নাম হাতে গুনে দিন-তারিখ সহ বলা যায়। রাজীব বর্তমানে একটু ঝামেলায় আছে, আপনারা ওর জন্য দোয়া করবেন। এই জিনিসটার ওর এখন খুবই প্রয়োজন।
আরেকজন মানুষ যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন অভি ভাই। জর্জিয়াতে থাকেন। যদিও উনি গ্রিন কার্ড নিয়ে এসেছিলেন, তারপরও কষ্ট করেছেন অনেক আসার পর, কারণ কাজের সাথে উনি পড়াশুনাও চালিয়ে গেছেন। অভি ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস অবাক করার মত। যখন আমি হতাশায় গলা পর্যন্ত ডুবে গেছি, ঐখান থেকে উনি আমাকে টেনে উঠিয়েছেন, ইন্সপায়ার করেছেন। খালি বলতেন -"রাজন খালি পড়াশুনাটা শেষ কর, এরপরই বছরে 100K স্যালারিতে জব শুরু করবা, তখন সব ঠিক হইয়া যাইব, খালি ভাববা 100K, টার্গেট একটাই 100K"। আমেরিকায় অনেক ধরনের মানুষ পাওয়া যায়, কিন্তু হতাশার সময় পাশে থাকার মত মানুষ পাওয়া দুর্লভ। আমি কোনদিন যদি আত্ম-উন্নয়ন টাইপ কোনো প্রতিষ্ঠান খুলি, ওনাকে মেইন ইনসট্রাকটর রাখব । উনি জর্জিয়ায় থেকে নানান জায়গায় আমার জবের জন্য চেষ্টা করেছেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। যেকোনো বিষয়ে যাই জানতে চেয়েছি, নিজে জানলে জানিয়েছেন নাহলে খোজ-খবর নিয়ে জানিয়েছেন। আমি অনেক ভাগ্যবান যে এমন একজন মানুষকে এখানে পেয়েছি। অভি ভাই তার স্বপ্ন পূরণের রাস্তার অনেকটাই পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। আপনার সব স্বপ্ন, সব আশা পূরণ হোক ভাই।
ডর্মে একাকী সময় গুলো কাটত বই পড়ে। জ্বি না, যা ভাবছেন তা না। ইংরেজি বই পড়ার মত ইনটেলেকচুয়াল এখনো হতে পারিনি। বই পড়ার অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই। আব্বু, আম্মু, ভাইয়ার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া। আসার আগে বই এর সংখ্যা ১৮০০+ ছিল, চুরি যাওয়া গুলো বাদে। চুপি চুপি বলি আমার গুলোর মধ্যেও অনেক গুলো চুরি করা । আমার নিজস্ব অমর বাণী হলো - "আপনি যদি অন্যের কাছ থেকে বই চুরি করেই না পড়েন, তাহলে আপনি বই পাগলদের কোনো জাতেই পরেন না।" আপনাকে আমি বড়জোর সৌখিন পাঠক বলতে পারি । আমার প্রথম ভালোবাসা, সেবার বই নিয়ে এসেছিলাম অনেকগুলো সাথে করে। মাসুদ রানা, ক্লাসিক, ওয়েস্টার্ন আর অনুবাদ সব। যারা সেবার বই অথবা মাসুদ রানাকে সস্তা বই ভাবেন, অনুগ্রহ করে আমার থেকে দূরে থাকেন। একদিনের কথা বলি, কাজ ছিলনা ঐদিন, সন্ধ্যার দিকে বসলাম রানার বই নিয়ে। কমফর্টার গায়ে জড়িয়ে পড়তে পড়তে কখন যে হুশ হারিয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। আমার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল আমি বাসায় বসে বই পড়ছি। রাশেদ ভাইদের বাসায় আর যাওয়া হয়নি কারণ আমি ভেবেছিলাম পড়া শেষ হলে আম্মুকে বলব ভাত দিতে !!!!! সত্যি সত্যি এমন হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি বই পড়ার অভ্যাসটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে । বই সহজলভ্য না হওয়া প্রধান কারণ নয়। মাঝে বাংলাদেশ থেকে কতগুলো বই আনিয়েছি। তারমধ্যে কিছু এখনো পড়া বাকি। আগে হলে আনার ১ সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যেত। আজ ৪ মাস হলো শেষ হচ্ছে না। কাজ থেকে এসে মুভি, নাটক অথবা টিভি সিরিজ দেখেই সময় পার হয়ে যায়। অনেকক্ষণ কামলা খাটার পরে হালকা ধরনের বিনোদনই বেশি উপভোগ্য লাগে। মাঝে মধ্যে ভাবি বদলে যাচ্ছি নাকি............হয়ত তাই..............................................
বোজম্যানে এক মাস থাকার পরেই বুঝে গেলাম এখানে আমার আর থাকা হবেনা। এখানে অধিকাংশ লোক সাদা আর বাই বর্ণ আমেরিকান। এরা সাধারনত কাউকে ইল্লিগ্যালি জব দিতে চায় না। আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের অফ ক্যাম্পাস কাজের পারমিশন না থাকায় ইল্লিগ্যালি করা ছাড়া উপায় নেই। অন ক্যাম্পাস জবে মাসে ম্যাক্সিমাম $৬৫০ ইনকাম করতাম, যা কিনা খুবই অপ্রতুল। মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশাল অংকের টিউশন ফিস দেয়া যা দিয়ে কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। চিন্তা শুরু করলাম লাগলাম কোথায় যাওয়া যায়। এই এত বড় দেশটায় আমার রিলেটিভ বলতে কেউ নেই। তাই খুজতে শুরু করলাম ফ্যামিলির পরিচিত কারা আছে। বেশ কয়েকজনকেই পেলাম। তারা কেউ ভুল নাম্বার দিল, কেউ একবার কথা বলে আর ফোন ধরল না, কেউ নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে কথা বলত.....তাদের কেবল আমিই ফোন দিতাম.....তারা কখনই ফোন দিত না। কেন এমন করত কে জানে.....হয়ত ব্যস্ত থাকত, হয়ত অন্য কোনো ঝামেলায় থাকত। এই দেশে ব্যস্ততা আর ঝামেলার তো শেষ নেই। জানিনা কারণ। অবশেষে আব্বুর এক বন্ধুর ছেলেকে পেলাম। ফিরোজ ভাই। উনি নিয়মিত খোজ খবর নিতেন আমার, যতটা পারতেন। স্বার্থপরদের এই দেশে উনি মোটামুটি দেবদূত হয়ে হাজির হলেন। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। গ্রিন কার্ড হোল্ডার। ততদিনে আমিও মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি নিউ ইয়র্কেই মুভ হব.....ওখানে অনেক বাঙালি, জব ও পাওয়া যায় শুনলাম। অভি ভাই আর ফিরোজ ভাই আশ্বাস দিলেন কিছু না কিছু একটা ম্যানেজ করে দিবেন কাজ, তাদের পরিচিত লোকজনদের বলে। নিউ ইয়র্কের কিউনি সিস্টেমের আন্ডারে চারটা কলেজে এপ্লাই করে দিলাম। এডমিশন পেয়ে গেলাম সহজেই। ট্রান্সফার নিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। মাত্র ১ সেমিস্টার হয়েছে আসছি, এর মধ্যেই চলে যাচ্ছি। কোনো প্রবলেম হয় নাকি এই নিয়ে। আপনারা বিশ্বাস করবেন না ট্রান্সফার হতে আমার ৫ মিনিটেরও কম সময় লেগেছিল। আমার ইন্টারন্যাশনাল এডভাইসর নাথালি ছিল খুবই হেল্পফুল। ট্রান্সফার হওয়ার পর, ও আমাকে বসিয়ে অনেক কথা বলল। মন্টানা আর নিউ ইয়র্কের মধ্যে ডিফারেন্স গুলো, সামনে কি কি আরো করতে হবে এইসব। আমাকে বলল আমি বুঝি তোমাদের এত টিউশন ফিস দিতে সমস্যা হয়, অনেকেই ট্রান্সফার হয়ে যায়। তুমি চিন্তা কোরনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তোমার খাবার সমস্যাও আর থাকবে না ওখানে গেলে (ডাইনিং এ কিছু খেতে পারতাম না বলে আমি ওর কাছে টাকা রিফান্ড চেয়েছিলাম, পাইনি যদিও)। যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ভালো থেক। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে, আমি হেল্প করার চেষ্ঠা করব। পরে একটা সমস্যা হওয়ায় সত্যি সত্যি ও আমাকে অনেক হেল্প করেছিল। যখন ট্রান্সফার নিতে ঢুকি তখন অনেক এক্সসাইটেড ছিলাম, আর কয়েকটা দিন পরেই স্বপ্নের নগরী নিউ ইয়র্কে থাকব। কিন্তু ট্রান্সফার প্রসেসিং কমপ্লিট হওয়ার পর নাথালির আন্তরিকতা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অত বড় নিউ ইয়র্ক শহরে কি এখানকার মত এত বড় হৃদয়ের মানুষগুলোর মত কাউকে খুঁজে পাব?
এরপর সামারের এক ঝলমলে রোদেলা সকালে ফ্রন্টিয়ার এয়ারলাইন্সের প্লেনে রওয়ানা হলাম নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে আসলেন আহসান আঙ্কেল আর মাকসুদ ভাই। চেকিং পার হবার সময় ওনাদের দিকে তাকিয়ে বুকটা ভারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কি বা করার ছিল.....সবার কপালে সব কিছু থাকে না। ফ্লাইটের ঘোষণা আসায় চড়ে বসলাম প্লেনে। খুললাম জীবনের আরেক অজানা অধ্যায়ের প্রথম পাতা।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)