আগেই একবার বলেছিলাম মন্টানায় শিকার খুব জনপ্রিয়। লোকালদের অনেকেরই ব্যক্তিগত ফায়ার আর্মস আছে। আর শিকারের মত বন্য প্রাণীও প্রচুর। তবে কোন কোন প্রাণী শিকার করা যায় আর কোনগুলো শিকার করা নিষেধ তা আমার জানা নেই। বন্য প্রাণীরা রাতের বেলা প্রায়ই পাহাড়ি এলাকা থেকে শহরে চলে আসে। একদিন রাশেদ ভাইয়ের বাসায় সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় ফোনে কথা বলতে বলতে নিচে চলে গেলাম, তারপর হাটতে হাটতে একটু দুরে। রাত প্রায় ১১.৩০ এর মত হবে তখন। হঠাৎ দেখি অন্ধকারে শিং ওয়ালা অনেকগুলো প্রাণী আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। একটু ভয় ভয় লাগলো। এর মধ্যে একটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ভয়ের সাথে সাথে লেজ ধরে যে কৌতুহলও আসে তা ঐদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। আমি ভাবলাম দেখিনা কি জিনিসটা। একটু আলোতে আসলে দেখি একটা হরিন !!!!! বিরাট শিং ব্যাটার। দুই-তিন হাত দুরে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আমি তখন অবাক। তারপর পুরো হরিনের পাল আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। ২০ টার উপরে হরিন তো ছিলই। বোজম্যানের ডাউনটাউনে পর্যন্ত রাত্রে বেলা ভালুক দেখা গেছে বলে আমি শুনেছি। পুরো ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। এই ওয়াইল্ড ওয়েস্টের একটা অংশ আমি কিছুদিনের জন্য হলেও ছিলাম এটা ভাবতেই ভালো লাগে।
এখানে দেখার মত প্রচুর জায়গা থাকলেও কিছুই দেখতে পারিনি। কারণ একটাই গাড়ি। নিউ ইয়র্ক আর অন্যান্য অল্প কয়েকটা জায়গা ছাড়া আমেরিকায় গাড়ি ছাড়া আপনি পঙ্গু। পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা জনপ্রিয় নয় এখানে। টাকাও একটা মাথাব্যাথা ছিল। আমার অবস্থা তো এমনিতেই করুন, রাশেদ ভাই, মাকসুদ ভাই টি.এ. হলেও যে টাকা পেতেন তাতে বাসা ভাড়া আর খাবার খরচের পর বলতে গেলে তেমন কিছুই থাকত না। আর একটু সেভিংস তো করতেই হয়। বিপদ আপদের কমনসেন্স যে কম তাতো সবাই জানি আমরা। বোজম্যান শহরে বাস চললেও দেখার মত জায়গাগুলোতে বাসে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমেরিকানরা যতই ভালো হোক, অন্তরঙ্গতা কেন জানি ওদের সাথে সবার সবসময় খুব একটা হয়ে ওঠে না। একটা অদৃশ্য সীমারেখা ওরা মেইনটেইন করে চলে। কেন জানি না। হয়ত কালচারাল ডিসট্যানসের কারণে। আমি অল্প কিছুদিন ছিলাম ওদের সাথে, এটাও একটা কারণ হতে পারে। হয়ত অনেকদিন থাকলে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেত। ওরাও গোনার বাইরে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের সাথে সাধারনত অন্যান্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদেরই ভালো বন্ধুত্ব হয়। কিছু এক্সসেপ্শন ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের সবার অবস্থা প্রায় একই।
আহসান আন্কেল প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায় অনেকবার যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি কিছু জায়গায়। অন্যান্য যাদের গাড়ি ছিল, তাদের আমাদের জন্য সময় ছিলনা। প্রথম প্রথম যারা আসে তাদের একটু খারাপ লাগে এই সব দেখে, কিন্তু একসময় আপনি বুঝতে পারবেন এটাই এখানকার রীতি। বলতে পারেন ওটা তো আমেরিকান রীতি, বাঙালিরা তো তাদের মতই থাকবে। দুঃখের ব্যাপার হলো আমাদের কয়েকজনের সাথে সেটা হয়নি। আমেরিকাতে কারো জন্যই কারো সময় নেই, এর উপর যদি আপনি হন তাদের ক্লাস অথবা সার্কেলের বাইরে তাহলে ওই আশা মরীচিকা। অনেকেই ভাবতে পারেন বাঙালিদের সবার তো এক সার্কেলে থাকার কথা। জ্বি না ভাই। তা হয় না। সবার সাথে সবার হয়ত সম্পর্ক ভালো থাকে কিন্তু সবাই একই সার্কেলে? ভায়া মক্কা বহুদূর। বাঙালি একাই একশ হতে পারে কিন্তু একশ বাঙালি যে কখনো এক হতে পারেনা এটা তো পুরানো ব্যাপার। আপনারা বলতে পারেন সার্কেল বানানো আর এমন কি? আমার কত বন্ধু বান্ধব। ঘটনাটা হলো, দেশে স্কুল, কলেজে আমরা একটা লম্বা সময় পার করি, আশেপাশের সব কিছুই আমাদের নিজের, এছাড়া সবাই আমাদের মতই হওয়ায়, কার সাথে বন্ধুত্ব করব তা আমরাই ঠিক করতে পারি। যেটা বিদেশে সম্ভব হয় না। যারা আছে, তারা যেমনই হোক তাদের সাথেই আপনাকে চলতে হবে। ৫ জন মানুষকে বদলানোর চেয়ে নিজেকে বদলানোই মনে হয় সোজা। বহুদিন প্রবাসে থাকার পর দেশে আসলে, অনেকেই বলে "যাওয়ার আগে কি ভালো ছিল, আর এখন কি হইছে, শালার বিদেশে থাইকা একটু পয়সা হইছে, তাই ভাব বাড়ছে"। আমি নিজেই এমন বলেছি। এখন বুঝি তারা বদলাতে চায়নি, পরিস্থিতি তাদের এমন বানিয়েছে। বিচিত্র রকমের সব স্বার্থপরতা দেখার পর নিজের মন অথবা আত্মাও বোধহয় ছোট হয়ে যায়। দেশের সবাই শুধু দেখে ডলার আর ফেসবুকে দেয়া ঘুরতে যাওয়া সুন্দর সুন্দর জায়গার ছবি, কিন্তু অপূর্ব ওই প্রাকৃতিক নৈসর্গের জায়গাগুলোয় একা যাবার যে হাহাকার, ওই ডলার গুলো কামানোর পিছনে যে কত নির্ঘুম রাত, কত নি্ঃশব্দ কান্না, মনের ভেতর একবার দেশে যাওয়ার গুমরে মরা যে আকুতি তা কে দেখে.....দীর্ঘদিন বলতে গেলে প্রায় একা থাকার পর, নিজের মত সব করার পর, দেশে এসে হঠাৎ কারো কথা শুনে অথবা সবাইকে খুশি করে কাজ করাটা একটু কঠিনই হয়ে যায়। একা থাকতে আমি বুঝাতে চেয়েছি যে, নিজের ফ্যামিলি বা দেশের মত ক্লোজ বন্ধু-বান্ধব পাওয়াটা এখানে প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। যারা বন্ধু হবে, তাদের সাথে যদি সব শেয়ার না করতে পারেন, তাহলে ব্যাপারটা একা থাকারই নামান্তর।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)