বাংলাদেশের জাতীয় অস্তিত্ববিনাশী প্রকল্প ভারতের টিপাইমুখ ব্যারাজ ইস্যুতে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব প্রতিবাদ ও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। ১/১১-এর বিপর্যয়ের পর এটিই সম্ভবত জাতির বড় অর্জন। সরকার ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পকে শুরুতে শুধু সমর্থনই করেনি, এ বাঁধ বাংলাদেশের কোন ক্ষতি করবে না বলে ভারতের দেয়া বক্তব্যেরও প্রতিধ্বনিত হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কণ্ঠে। এমনকি টিপাইমুখ পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে বাংলাদেশের লাভবান হবার কথাও কোন কোন মন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত হয়েছে। জাতীয় অস্তিত্ববিনাশী ভারতের এ পরিকল্পনা প্রতিরোধ না করে তাকে উপকারী বলা এবং যারা এ নিয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সেমিনার, গোলটেবিল করে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত, তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিদ্রূপ-কটাক্ষ করার একটা সংস্কৃতিও ক্ষমতাসীন মহলে দেখা গেছে। তবে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলের বাইরেও সামাজিক শক্তি, নাগরিক সমাজ ও সকল মতের দেশপ্রেমিকদের মাঝে দেশে-বিদেশে যে ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, শেষ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের সরকারদ্বয় তাকে সরাসরি অবজ্ঞাও করতে পারেনি।
ব্যাপক প্রতিবাদী জনমতের চাপে প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত মিসরে অনুষ্ঠিত ন্যাম সম্মেলন উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টিপাইমুখ ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কোন প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবেন না। কিন্তু কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংই মনিপুরের বরাক নদীর টিপাইমুখে ব্যারাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। আসাম রাইফেলস এবং ভারতের সেনাবাহিনীর প্রহরায় একটি বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে ভারতীয় সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশের আপত্তির মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী একথা বলেননি যে, যৌথ সমীক্ষা শেষে রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সম্মতি পাবার আগে তারা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম মুলতবি রাখবেন। তাহলে বাংলাদেশের আশ্বস্ত হবার ভিত্তিটা কী? বাংলাদেশের ক্ষতি করে ভারত কিছু করবে না, এরকম আশ্বাস ফারাক্কাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর বাঁধ নির্মাণের সময়ও তারা দিয়েছিল। তাদের এসব কথা কূটনৈতিক শঠতার আড়ালে নিছক প্রতারণা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। এজন্যই বাংলাদেশের মানুষ সরকারের আইওয়াশ ও সময়ক্ষেপণ বা ভারতের মিষ্টি কথার আশ্বাসে বিশ্বাস আনতে পারছেন না।
এদিকে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে এক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে শক্ত অবস্থান নেবার আহবান জানিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সরকারের প্রতি এক আনুষ্ঠানিক আহবানে বেগম জিয়া গত শনিবার বলেছেন, ‘মাথা নোয়াবেন না। ভয় পাবেন না। আপনারা একা নন। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখলে আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকবো।' নানা ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে দূরত্ব ও মতানৈক্য থাকলেও জাতীয় ক্রান্তিকালে জাতীয় ইস্যুতে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা আমাদের চলমান রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিরোধী দলীয় নেত্রীর এই আহবান তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারও দ্যুতি বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষতি করে ভারত কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে বেগম খালেদা জিয়া সাধুবাদ জানিয়ে টিপাইমুখ প্রকল্প বাতিল করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দাবী করেছেন ভারতের কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে একই আহবান জানান ভারতের প্রতি, তাহলে ভারত বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে বাধ্য হবে। কিন্তু টিপাইমুখ ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট নয়। সরকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে সন্তুষ্ট থাকতে চাইলে তাতে ভারত হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। ভারত লক্ষ্য করছে যে, টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধীদল অভিন্ন অবস্থান নিতে পারেনি এবং বিরোধীদলের অতীত ভূমিকা নিয়ে সরকার এখনও দোষারোপের রাজনীতি চর্চায় ব্যস্ত।
এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যটি বিচার করলে আশাবাদী হওয়ার কোন উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীর সহযোগিতা দানের প্রস্তাবের পটভূমিতে গত শনিবার তাঁর দলের কাউন্সিল অধিবেশনের প্রস্তুতি সভায় বলেছেন, টিপাইমুখ নিয়ে বিভেদ হলে সুযোগ নেবে প্রতিবেশী। দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীও ‘সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ' হবার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি টিপাইমুখ ইস্যুতে বিরোধী দলের গণজাগরণ সৃষ্টিকেও তিনি কটাক্ষ করেছেন। টিপাইমুখ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান মেনে নেয়া যদি জাতীয় ঐক্যের প্রমাণ হয়, তবে সেটা কোন দেশপ্রেমিকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। টিপাইমুখ ইস্যুতে যারা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে আপসহীন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মতে তারাই কী বিভেদপন্থী? নাকি যারা গোটা জাতির মতামত উপেক্ষা করে ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্পসহ অন্যান্য ইস্যুতে দিল্লীর প্রতি মাথা নোয়ানোর নীতি অনুসরণ করছে, তারাই বিভেদপন্থী? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলেও জাতীয় স্বার্থকেই মানদন্ড হিসেবে ধরতে হবে। সরকারের এতেও জড়তা আছে বলে মনে হয়।
টিপাইমুখ কোন দলীয় ইস্যু নয়। এটা জাতীয় ইস্যু। ভারতীয়রা এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু আমরা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না? প্রধানমন্ত্রী বিভেদ এড়িয়ে নিজেই এব্যাপারে জাতীয় ঐক্যের একটা রূপরেখা দিতে পারেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীর এগিয়ে আসার ফলে কাজটি সহজ হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর এগিয়ে যাবার পালা। জনগণের নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবেও এ ব্যাপারে তাঁর দায়বদ্ধতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে জাতীয় ক্রান্তিকালে কেউ দলীয় বিভেদাত্মক কথা শুনতে চায় না। সরকার টিপাইমুখসহ অন্যান্য জাতীয় ইস্যুতে ভারতের লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে দেশ ও জনগণের পক্ষে অবস্থান নিলেই রাজনৈতিক বিভেদের মেকী দেয়ালটা আর থাকবে না। সুতরাং বিভেদের জন্য বিরোধীদলকে দোষারোপ না করে সরকারের উচিত হবে তার নীতি-অবস্থানকে পুনর্বিন্যাস করা