বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত জুড়ে ভারতের সাতটি প্রদেশ। এগুলো হলো মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম। এ রাজ্যগুলোর জন্য এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। (এক). সমগ্র এলাকার আয়তন বাংলাদেশের চেয়েও বৃহৎ অথচ অতি জনবিরল। (দুই). সমগ্র এলাকাটিতে হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ নিয়ে সমগ্র উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক সংঘাত ও উত্তাপ এ এলাকায় সেটি নেই। ফলে এখানে বাংলাদেশ পেতে পারে বুসুলভ প্রতিবেশী যা তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্ঠিত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। (তিন). একমাত্র বৃটিশ আমল ছাড়া এলাকাটি কখনই ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, এমনকি প্রতাপশালী মুঘল আমলেও নয়। হিন্দু আমলে তো নয়ই। ভারতভুক্ত হয় বৃটিশ আমলের শেষদিকে। ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া সে জন্যই এখানে ততটা সফলতা পায়নি। গণভিত্তি পায়নি ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। (চার). সমগ্র এলাকাটি শিল্পে অনুন্নত এবং নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। অথচ এলাকাটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ভারতের সিংহভাগ তেল, চা, টিম্বার এ এলাকাতে উৎপন্ন হয়। অথচ চা ও তেল কোম্পানীগুলোর হেড-অফিসগুলো কলকাতায়। কাঁচামালের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও এলাকার বাইরে। ফলে রাজস্ব আয় থেকে এ এলাকার রাজ্যগুলো বঞ্চিত হচ্ছে শুরু থেকেই। শিল্পোন্নত রাজ্য ও শহরগুলো অনেক দূরে হওয়ায় পণ্যপরিবহন ব্যয়ও অধিক। ফলে সহজে ও সস্তায় পণ্য পেতে পারে একমাত্র উৎস বাংলাদেশ থেকেই। ট্রানজিট দিলে সে সুযোগ হাতছাড়া হতে বাধ্য। (পাঁচ). যুদ্ধাবস্খায় অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্খা। কিন্তু এ এলাকায় সে সুযোগ ভারতের নেই। ভারতের সাথে এ এলাকার সংযোগের একমাত্র পথ হলো পার্বত্যভূমি ও বৈরী জনবসতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে অবস্খিত ১৬ কিলোমিটার চওড়া করিডোর। এ করিডোরে স্খাপিত রেল ও সড়ক পথের কোনটাই নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে শত শত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির সেখানে প্রাণনাশ হয়েছে। (ছয়). নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে তারা মঙ্গোলীয়। ফলে মূল ভারতের অন্য যে কোন শহরে বা প্রদেশে পা রাখলেই একজন নাগা, মিজো বা মনিপুরি চিহ্নিত হয় বিদেশীরূপে। তারা যে ভারতী নয় সেটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এ ভিন্নতাই যথেষ্ট। এ ভিন্নতার জন্যই সেখানে স্বাধীন হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলছে বিগত প্রায় ৬০ বছর ধরে। ভারতীয় বাহিনীর অবিরাম রক্ত ঝরছে এলাকায়। বহু চুক্তি, বহু সমঝোতা, বহু নির্বাচন হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার সে যুদ্ধ না থেমে বরং দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ভারতের অর্থনৈতিক রক্তশূন্যতা। সমগ্র এলাকা হয়ে পড়েছে ভারতের জন্য ভিয়েতনাম। আফগানিস্তানে একইরূপ অবস্খার সৃষ্টি হয়েছিল রাশিয়ার জন্য। সে অর্থনৈতিক রক্তশূন্যতার কারণে বিশালদেহী রাশিয়ার মানচিত্র ভেঙ্গে বহু রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ভারত রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী নয়। তেমনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে এ এলাকার মানুষের অঙ্গীকার, আত্মত্যাগ এবং ক্ষমতাও নগণ্য নয়। ফলে এ সংঘাত থামার নয়। ভারত চায় এ অবস্খা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু ভারতের কাছে সংকট মুক্তির সে রাস্তা খুব একটা খোলা নেই।
ভারত ট্রানজিট চাচ্ছে পণ্য-পরিবহন ও আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দোহাই দিয়ে। বিষয়টি কি আসলেই তাই? মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের সমুদয় জনসংখ্যা ঢাকা জেলার জনসংখ্যার চেয়েও কম। এমন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পণ্য সরবরাহ বা লোক চলাচলের জন্য এত কি প্রয়োজন পড়লো যে তার জন্য অন্য একটি প্রতিবেশী দেশের মধ্য দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চাইতে হবে? যখন তাদের নিজের দেশের মধ্য দিয়েই ১৭ কিলোমিটারের প্রশস্ত করিডোর রয়েছে? এ করিডোর দিয়ে একটি নয়, ডজনের বেশি রেল ও সড়ক পথ নির্মাণ করা যেতে পারে। এলাকায় নির্মিত হতে পারে বহু বিমানবন্দর। ভারতের সেদিকে খেয়াল নেই, দাবী তুলেছে বাংলাদেশের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার পথ চাই-ই। যেন কর্তা ব্যক্তির তুঘলকি আব্দার। গ্রামের রাস্তা ঘুরে যাওয়ায় রুচি নেই, অন্যের শোবার ঘরের ভিতর দিয়ে যেতেই হবে। গ্রামের ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তায় পথ চলতে অত্যাচারী কর্তার ভয় হয়। কারণ তার কুকর্মের কারণে শত্রুও বেশি। না জানি কখন কে হামলা করে। একই ভয় চেপে বসেছে ভারতীয়দের মাথায়। সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতে তারা চিহ্নিত হয়েছে ঔপনিবেশিক বৃটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীরূপে। ভারত করিডোর চাচ্ছে নিতান্তই সামরিক প্রয়োজনে। আর বাংলাদেশের জন্য শংকার কারণ মূলত এখানেই। ভারত তার চলমান রক্তাক্ত যুদ্ধে বাংলাদেশকেও জড়াতে চায়। কারো ঘরের মধ্য দিয়ে পথ চললে সে পথে কিছু ঘটলে সহজেই সেটির দায়-দায়িত্ব ঘরের মালিকের ঘাড়ে চাপানো যায়। তার বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা ঠুকা যায়। কিন্তু বিজয় মাঠ বা ঝোপঝাড়ের পাশে সেটি ঘটলে আসামী খুঁজে পাওয়াই দায়। ভারত এ জন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৬শত মাইলের করিডোর এবং সে করিডোরের নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের কাঁধে চাপাতে চায়। তখন এ পথে ভারতীয়দের উপর হামলা হলে বাংলাদেশকে সহজেই একটি সন্ত্রাসী দেশরূপে আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক মহলে নাস্তানাবুদ করা যাবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতেও তোলা যাবে।
তাছাড়া বহুবার ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েক কিলোমিটার ঢুকে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ইচ্ছামত গরু-বাছুরও ধরে নিয়ে গেছে। বাঁধ দিয়ে সীমান্তের ৫৪টি যৌথ নদীর পানি তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। ফারাক্কা নির্মাণ করেছে এবং পদ্মার পানি তুলে নিয়েছে একতরফাভাবেই। সুরমা, কুশিয়ারা ও তিস্তার উপর উজানে বাঁধ দিয়ে এ নদীগুলোকে পানি শূন্য করার ষড়যন্ত্র করছে। এদের মুখে আবার প্রতিবেশীমূলক সহযোগিতার ভাষা?
ভারতের এসব আগ্রাসী ভূমিকার কারণ ভারতবিরোধী চেতনা এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। বেতনভোগী র'এর এজেন্ট দিয়ে এমন চেতনাধারিদের দমন অসম্ভব। সেটি ভারতও বুঝে, তাই চায়। বাংলাদেশ সরকার ভারত বিরোধীদের শায়েস্তা করতে বিশ্বস্ত ও অনুগত ঠ্যাঙ্গারের ভূমিকা নিক। যেমনটি মার্কিন সরকার চাচ্ছে পাকিস্তান সরকার থেকে। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী সীমান্ত ছেড়ে কামানের নলগুলো নিজ দেশের জনগণের দিকে তাক করুক। যেমনটি পাকিস্তানের স্বৈরাচারি পারভেজ মোশাররফ করেছে। ট্রানজিট দিলে তেমন একটি যুদ্ধাবস্খা বাংলাদেশের সৃষ্টি হতে বাধ্য। তখন দেশটি পরিণত হবে আরেক ইরাক বা আফগানিস্তানে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়-দায়িত্ব একান্তই ভারতের। কিন্তু ভারত সেখানে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। আর সে ব্যর্থতার দায়ভার চাপাচ্ছে বাংলাদেশের ঘাড়ে। ভারতের অভিযোগ, বাংলাদেশ তার নিজ ভূমিতে বিচ্ছিন্নবাদী ভারতবিরোধী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলছে। আরো গুরুতর অভিযোগ, এ কাজে তারা পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সাথে সহযোগিতা করছে। অথচ এর কোন প্রমাণ তারা দেয়নি। সম্প্রতি তাদের বিদেশনীতিতে আরেক উপসর্গ যোগ হয়েছে। ভারতের যে কোন শহরে বোমা বিস্ফোরণ হলে তদন্ত শুরুর আগেই ভারত সরকার বাংলাদেশীদের দায়ী করে বিবৃতি দিচ্ছে। যেন এমন একটি বিবৃতি প্রচারের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু এ অবধি এমন কাজে বাংলাদেশীদের জড়িত থাকার পক্ষে আজ অবধি কোন প্রমাণ তারা পেশ করতে পারিনি। এমন অপপ্রচারের লক্ষ্য একটিই। আর তা হলো, বাংলাদেশের দুর্বল সরকারকে ব্লাক-মেইল করা। এভাবে ট্রানজিটসহ ভারত যে সুবিধাগুলো চায় সেগুলো আদায়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা। ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির এটিই হলো এখন মূল স্ট্রাটেজী। লক্ষ্যণীয় হলো, সেদেশে বার বার সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের প্রতি তাদের এ নীতিতে কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বিপদ বাড়বে যদি এ লড়াইয়ে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ নেয়। পণ্যের পাশাপাশি সৈন্য ও সামরিক রসদ তখন রণাঙ্গনে গিয়ে পৌঁছবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। ফলে ঐ এলাকার বিদ্রোহীদের কাছে প্রতিপক্ষরূপে চিহ্নিত হবে বাংলাদেশ। আজ অবধি যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি তীরও ছুঁড়েনি তারাই পরিণত হবে চরম শত্রুরূপে। তখন সশস্ত্র হামলার লক্ষ্যে পরিণত হবে বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক স্খাপনা। তখন অশান্ত হয়ে উঠবে দেশের হাজার মাইলব্যাপী উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত। অহেতুক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ। কথা হলো, যে গেরিলা যোদ্ধাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশাল ভারতীয় বাহিনীই হিমসিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশ কি সফলতা পাবে? তখন বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহীগণ বু ও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে এ এলাকায়। এ কারণেই বাংলাদেশের জন্য অতিশয় আত্মঘাতি হলো ভারতের জন্য ট্রানজিট দান।
আরো লক্ষ্যণীয় হলো, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এ এলাকাটিতে ভূ-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন হচ্ছে অতি দ্রুতগতিতে। মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড রাজ্যগুলো ইতোমধ্যেই পরিণত হয়েছে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে। খৃষ্টান ধর্ম জোরেশোরে প্রচার পাচ্ছে পার্শ্বðবর্তী প্রদেশগুলোতেও। ফিলিপাইনের পর সমগ্র এশিয়ায় এটিই এখন সর্ববৃহৎ খৃষ্টান অধ্যুষিত এলাকা। তাছাড়া ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আচরণে এ ধর্মমতের অনুসারীরাও অতি অতিষ্ঠ। উগ্র হিন্দুদের কাছে হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে দীক্ষা নেয়া এক অমার্জনীয় অপরাধ। ফলে অতি জোরদার হচ্ছে খৃষ্টান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি অখণ্ড খৃষ্টান রাষ্ট্র নির্মাণের ধারণা। পশ্চিমা খৃষ্টান জগতে এমন রাষ্ট্রের পক্ষে আগ্রহ দিন দিন বাড়বে সেটিই স্বাভাবিক। ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে আলাদা করার পিছনে যে যুক্তি দেখানো হয়েছিল। সে যুক্তির প্রয়োগ তখন ভারতের বিরুদ্ধেও হবে। ফলে খৃষ্টান জগত এবং চীনের ন্যায় বৃহৎ শক্তিও নিজ নিজ স্বার্থে স্বাধীনতাকামীদের পক্ষ নিবে। এ অবস্খায় ভারতের পক্ষ নেয়ার খেসারত দিতে হবে অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তির বিরাগভাজন হয়ে। বাংলাদেশের জন্য সেটিও অতি বিপজ্জনক দিক নয় কি?