আলোচনার ঝড় তুলেছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। না, ২০০৪ সালের মতো খ্রিস্টান স্ত্রী ক্রিস্টিনাকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসার কারণে কিংবা কুলা-ডালা সাজিয়ে, ফুল ছিটিয়ে এবং নেচে-গেয়ে জয়-ক্রিস্টিনাকে ‘বরণ’ করে নেয়ার কারণে নয়, এবারের ঝড় উঠেছে জয়ের একটি নিবìেধর কারণে। মা শেখ হাসিনা যখন আরো একবার প্রধানমন্ত্রী হই-হই অবস্খায় এসে গেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের ক্ষমতায় আসা যখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, ঠিক তেমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে নিবìধটি। এজন্য বাংলাদেশের কোনো পত্রিকাকেও বেছে নিয়ে ধন্য করেননি হাসিনা-তনয়। লিখেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ’-এ। এটাও আলোচনার প্রধান কারণ নয়। প্রধান কারণ নিবìেধর বিষয়বস্তু। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ম্যাগাজিনটির ১৯ নভেম্বর সংখ্যায় ‘স্টেমিং দ্য রাইজ অব ইসলামিক একস্ট্রিমিজম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবìেধ জয় একদিকে বাংলাদেশকে একটি তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে কিভাবে বাংলাদেশ থেকে ‘ইসলামিস্ট’, ‘ইসলামী মৌলবাদী’ ও ‘জেহাদীদের’ উৎখাত করতে হবে এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগকে উপদেশ দিয়েছেন। উপদেশও দিয়েছেন তিনি ‘প্রেসক্রিপশনের’ স্টাইলে যেমনটি চিকিৎসকরা রোগীদের দিয়ে থাকেন।
জয়ের এ নিবìধটি বিশেষ কিছু কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একটি কারণ জয়ের পরিচিতি। না, নিবìেধর লেখক সজীব ওয়াজেদ জয় যে শেখ হাসিনার ছেলে সে কথার উল্লেখ নেই ম্যাগাজিনটির কোথাও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জয়ের গুরুত্ব ও যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য নিবìেধর শুরুতে জানানো হয়েছে, দেশটির সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অ্যাডভাইজার’ বা উপদেষ্টা তিনি। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে দেন-দরবার বা নিগোসিয়েশন করে থাকেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বাংলাদেশের ‘মিলিটারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন বলেও জানানো হয়েছে।
নিবìধটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার দ্বিতীয় কারণ জয়ের কো-অথর বা সহ-লেখক কার্ল সিওভাক্কোর পরিচিতি। এই পরিচিতি শুধু তাৎপর্যপূর্ণ নয়, সকল বিচারে ভীতিকরও। কার্ল সিওভাক্কো জয়ের মতো সিভিলিয়ান নন, একজন প্রাক্তন সেনা অফিসার এবং সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ। মার্কিন সেনা বাহিনীর ৬-৫২ এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারির ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইরাক দখলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। সউদী আরব, পোলান্ড ও জার্মানীতেও সিওভাক্কো সেনা অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তার বড় পরিচয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী আন্তর্জাতিক যুদ্ধের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ তিনি। তার বেশ কিছু গবেষণা কর্ম প্রকাশিতও হয়েছে। মার্কিন সরকার তার পরামর্শের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সিওভাক্কো মার্কিন সেনা বাহিনীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট’-এর সঙ্গে জড়িত যেখানে সামরিকভাবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সিওভাক্কোর মতো একজন যুদ্ধবাজকে সহ-লেখক হিসেবে বেছে নেয়ায় পরিষ্কার হয়েছে, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশকে বিবেচনায় নিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। এর সঙ্গে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধও যে জড়িত রয়েছে সে কথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। এক কথায় বলা যায়, হাসিনা-তনয় বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক টার্গেট বানিয়ে ছেড়েছেন। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে নিবìেধর মূল সুরের মধ্যেও। জয় ও সিওভাক্কোর মতে বাংলাদেশে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ খুবই বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং ‘ইসলামিস্ট’ উগ্রপন্থী ও জেহাদীদের প্রতিহত করতে হলে ঠিক সে ধরনের ব্যবস্খাই নেয়া দরকার, যে ধরনের ব্যবস্খা ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে।
নিবìেধ ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার পরিবর্তে জয় ও সিওভাক্কো একটি মতবাদ হিসেবে দেখেছেন। তারা এমনভাবেই ‘ইসলামিজম’ কথাটা বলেছেন যেন ইসলাম একটি ধর্ম নয়, যেন কমিউনিজম বা ক্যাপিটালিজমের মতো মানুষের তৈরি কোনো সাধারণ মতবাদ! বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য দু’জনই ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন। কারণ, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের জন্মই নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল! কিন্তু পরবর্তীকালে, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে দ্রুত ‘ইসলামিজমের’ প্রসার ঘটেছে। জয় ও সিওভাক্কো মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষতার ‘পবিত্রতা’ বজায় রাখার পথে এই ‘ইসলামিজম’ প্রবল প্রতিবìধক হয়ে উঠতে পারে।
এমন এক সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে জয় ও সিওভাক্কোর পরামর্শ, যে কোনো মূল্যে ‘ইসলামিজম’-কে প্রতিহত করা দরকার। কিন্তু কাজটা যে সহজ নয় সে কথাও জানেন তারা। কারণ, বর্তমান ‘মিলিটারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ এবং তাদের ‘সামরিক শাসন’-এর অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, সেখানেও ‘ইসলামিজম’ একটি বড় প্রতিবìধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। দু’জনের মতে, নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে দুই প্রধান দলের মধ্যে ইসলামকে ব্যবহার করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে তারা ব্যতিক্রমী দল মনে করেন। তাদের ধারণা, জয় যে দলের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, সে দল আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হতে পারলে দ্রুত বেড়ে চলা ‘ইসলামিজম’কে প্রতিহত করে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দীর্ঘমেয়াদী করতে হলে আওয়ামী লীগকে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটা করতে পারলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ‘মডেল’ হয়ে উঠবে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্বাচনে আওয়ামী লীগও ইসলামকে ব্যবহার করবে বলার পরও জয় ও সিওভাক্কো কিন্তু দলটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরাট ‘পূজারী’ বানিয়ে ছেড়েছেন। তারা উল্লেখ করেননি যে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা ওমরাহ করতে গিয়েছিলেন, মাথায় হিজাব লাগিয়েছিলেন এবং হাতে নিয়েছিলেন তসবিহ। এখানেও শেষ নয়, বেগম খালেদা জিয়া যে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়ে দু’বার সরকার গঠন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তার উল্লেখ পর্যন্ত নেই নিবìেধ। এ সংক্রান্ত তথ্য তারা এমনভাবেই জানিয়েছেন যেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন!
জামায়াতে ইসলামীকে দোষারোপ করার ক্ষেত্রেও জয় ও সিওভাক্কো অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। তারা লিখেছেন, জোট সরকারের পাঁচ বছর এবং বর্তমান ‘মিলিটারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দু’ বছরেই নাকি বাংলাদেশে ‘ইসলামিস্টরা’ (ব্র্যাকেটে ‘মৌলবাদীরা’) বেশি শক্তিশালী হয়েছে! ‘ইসলামিস্টদের’ শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই বিএনপি নাকি ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গী বানিয়েছিল। এই সুযোগেই জামায়াত নাকি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। এর আগে জামায়াতের শক্তি ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে জয় ও সিওভাক্কো উল্লেখ করেছেন, দলটি সংসদে সর্বোচ্চ তিনটি আসন পেয়েছে। অথচ ১৯৯১ সালের সংসদে জামায়াতের ১৭টি আসন ছিল। এটা উল্লেখ না করার কারণ, যাতে প্রমাণ করা যায় যে, বিএনপিই জামায়াতকে এবং জামায়াতের মাধ্যমে ‘ইসলামিস্টদের’ শক্তিশালী করেছে।
এ পর্যন্ত এসেও থেমে যাননি জয় ও সিওভাক্কো। লিখেছেন, বাংলাদেশের ইসলামিস্টরা নাকি এখনো ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে একীভূত করার চিন্তা ও চেষ্টা চালাচ্ছেন! শুধু তা-ই নয়, এ লক্ষ্যে বিএনপি ও জামায়াত বোমাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং ২০০৫ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ৫০০ বোমাবাজির সঙ্গেই নাকি জামায়াত ও বিএনপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে! (৫০০ সংখ্যাটি বারবার ব্যবহার করেছেন তারা যেন বোমাবাজির সংখ্যা ৫০০-র কমও নয়, বেশিও নয়!) তারা বলেছেন, জেএমবি, জেএমজেবি ও হুজিসহ ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলো নাকি জামায়াতের সশস্ত্র শাখা! এটা জয় ও সিওভাক্কোর অনুমান নয়, সুচিন্তিত অভিমত!
সেনা বাহিনীতে ‘ইসলামিস্টদের’ দ্রুত বেড়ে চলা সংখ্যাও নাকি বাংলাদেশে ‘ইসলামিস্টদের’ প্রভাব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আর সেনা বাহিনীতে ‘ইসলামিস্টদের’ সংখ্যা বাড়ার কারণ হলো, দেশের মাদরাসাগুলোতে নাকি সেনা বাহিনীর ভর্তি পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়! কথাটা প্রমাণ করার জন্য বিচিত্র এক পরিসংখ্যানও হাজির করেছেন তারা। লিখেছেন, শেখ হাসিনার শেষ দিকে, ২০০১ সালে সেনাবাহিনীতে যেখানে মাদরাসা শিক্ষিতদের সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ সেখানে ২০০৬ সালে জোট সরকারের শেষভাগে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। একে ‘অবিশ্বাস্য’ এবং বিপদজনক মনে করেন জয় ও তার সঙ্গী লেখক। এর পেছনে নাকি জোট সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা কাজ করেছে। জোট সরকারের এই পরিকল্পনার কারণেই নাকি দেশে বোরখার ব্যবহার লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিগত পাঁচ বছরে দেশে নাকি বোরখার ব্যবহার বেড়েছে ৫০০ শতাংশ!
এভাবে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিস্টদের’ ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর এসেছে ‘প্রেসক্রিপশন’ দেয়ার পালা। ‘পুনরারম্ভের পরিকল্পনা’ শিরোনামে অবশ্য করণীয় হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে তুলে ধরেছেন জয় ও সিওভাক্কো (উচিত নয়, বলেছেন অবশ্যই করতে হবে)। জয় ও সিওভাক্কোর প্রেসক্রিপশনগুলো হলো প্রথমত, মাদরাসার পাঠ্যক্রমকে আধুনিকায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সঠিক ধর্মনিরপেক্ষ স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ধর্মনিরপেক্ষ ক্যাডেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মনাদের সেনা বাহিনীতে বেশি সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চতুর্থত, পরিচিত উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চালাতে হবে। সবশেষে, বাংলাদেশীদের দারিদ্র্য ও অশিক্ষা দূর করতে হবে যার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে নিচের অবস্খানে থাকছে।
এখানেও আফিমখোরদের মতো আবোল-তাবোল বকেছেন দু’জনে। লিখেছেন, মাদরাসার খরচের সব অর্থ নাকি সউদী আরব ও কুয়েত থেকে অনুদান হিসেবে এসে থাকে এবং সে কারণে মাদরাসার ব্যাপারে সরকারের নাকি কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাছাড়া মাদরাসায় নাকি অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ানো হয় না। এগুলো পড়ানোর ব্যবস্খা করার জন্য ‘উপদেশ খয়রাত’ করেছেন জয় ও সিওভাক্কো। তাদের পরামর্শ, মাদরাসার ছাত্রদের বোঝাতে হবে, শুধু ধর্মশিক্ষা করে লাভ নেই, জীবিকা ও উন্নততর জীবনের জন্য পৃথিবীর দিকেও তাকাতে হবে! কোরআন হেফ্জ করার মাধ্যমে নাকি জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়! এটা নাকি কাউন্টার প্রোডাক্টিভ! শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের ইসলামী হাসপাতালগুলো নাকি গরীব মানুষের অসুস্খতার সুযোগ নিয়ে ‘বাঙ্গালীদের’ মুসলমান ও উগ্রবাদী বানিয়ে ফেলছে! এর প্রতিবিধান হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ‘প্রেসক্রিপশন’ করেছেন হাসিনা-তনয় ও তার সঙ্গী লেখক। সেনাবাহিনীতে যাতে ‘ইসলামিস্টদের’ সংখ্যা কমে আসে এবং জামায়াত আর প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সে জন্যও ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়েছেন দু’জনে। লিখেছেন, ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্খা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলের ছাত্রদের সেনাবাহিনীর ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারাই বেশি সংখ্যায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
এর পর এসেছে বাংলাদেশকে ইসলামী মৌলবাদের ‘ক্যান্সার’ থেকে রক্ষার ‘প্রেসক্রিপশন’। জয় ও সিওভাক্কো বলেছেন, এ জন্য উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, তারা যাতে নিজেদের ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। ভবিষ্যতে যাতে আর উসকানি না দিতে পারেন, সে জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন দু’জনে। সউদী আরব ও মিসরের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, শেখ আল আউদা, সৈয়দ আল ইমাম আল শরীফ আকা ফজল, শেখ ওমর বাকরি মোহাম্মদ, আবু হামজা আল মাসরী, আবু কাতাদা প্রমুখ ধর্মীয় নেতারা কিভাবে ইসলামী জেহাদী ও বিন লাদেনের অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এদের মধ্যে ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠজনেরাও রয়েছেন। এ ব্যাপারে কাউন্টার টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ পিটার বারগেনের পরামর্শ অনুযায়ী ‘কেমোথেরাপি’ দিতে বলেছেন জয় ও সিওভাক্কো। দু’জনে বুঝিয়ে ছেড়েছেন যে, তারাও ইসলামী মৌলবাদের ‘ক্যান্সারে’ আক্রান্ত বাংলাদেশকে এতটাই বিপদজনক মনে করেন।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেও ব্যবস্খা নিতে বলেছেন তারা। কিন্তু এ ব্যবস্খার উদ্দেশ্য মানুষের সমৃদ্ধি নয়, উদ্দেশ্য হলো যাতে তরুণ-যুবকরা ‘ইসলামিস্ট’ ও ‘জেহাদী’ হয়ে না ওঠে। জয় ও সিওভাক্কো মনে করেন, অভাব আর দারিদ্র্যের জন্যই নাকি তারা ‘ইসলামিস্ট’ ও ‘জেহাদী’ হয়! এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে উন্নয়নের এমন কিছু বিচিত্র গল্প শুনিয়েছেন দু’জনে, যা পড়ে মনে হবে যেন লেখার ঠিক প্রাক্কালে তারা আফিমের জন্য বিখ্যাত দেশ আফগানিস্তানে গিয়ে ‘দম’ দিয়ে এসেছিলেন! তারা লিখেছেন, শেখ হাসিনার আমলে দারিদ্র্যের হার নাকি ৫৮ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছিল এবং শিক্ষার হার নাকি ৪৫ থেকে ৬৬ শতাংশে ও গড় আয়ু নাকি ৫৭ থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত হয়েছিল! যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ নাকি ২০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছিল দুই বিলিয়ন ডলার! জিডিপির প্রবৃদ্ধি নাকি চার থেকে ছয় শতাংশে উন্নীত হয়েছিল! সাড়ে চার মিলিয়ন মেট্রিক টনের খাদ্য ঘাটতি থেকে আড়াই মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়েছিল! জয় ও সিওভাক্কোর মন্তব্য, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। নাহলে বাংলাদেশ এতদিনে স্বর্গের কাছাকাছি অবস্খানে পৌঁছে যেতো!
আরো অনেক অসত্য তথ্য ও পরিসংখ্যানও রয়েছে নিবìেধ। কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে দু’জনের উদ্দেশ্যের দিকটি। জয় ও সিওভাক্কো বাংলাদেশকে উগ্র ও সন্ত্রাসবাদী ‘ইসলামিস্টদের’ ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, মাদরাসা শিক্ষা থেকে বোরখা পর্যন্ত মুসলমানদের সকল বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন। সবচেয়ে বড় আশংকার কথা হলো, একদিকে তারা বিএনপি ও জামায়াতকে সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে প্রধান টার্গেট বানিয়েছেন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে। কথিত ‘ইসলামিস্টদের’ কবল থেকে মুক্ত করার নামে তারা আসলে সশস্ত্র বাহিনীকেই ধ্বংস করে ফেলার ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়েছেন। বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, যুদ্ধবাজ একজন মার্কিন সেনা অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ‘প্রেসক্রিপশন’গুলো দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার ‘অ্যাডভাইজার’ সজীব ওয়াজেদ জয়। একথাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হবে। বড় কথা, জয় ও সিওভাক্কোর নিশ্চিত বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় আসবেই। কারণ, আগামী নির্বাচনের ‘পেন্ডুলাম’ ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের দিকে ‘হেলতে’ শুরু করেছে।