কোনোদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কুশল কামনা করে তুলসীমঞ্চে কেউ জ্বালাবে না দীপ, কোনো নারী সীমন্তে ধরবে না তাঁর কল্যাণ কামনায় সিদুরচিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোনো চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবে অপসৃত, কোনো পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি।
প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কান্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার ।
মানুষটির নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়।
তিনি একটি বই লিখলেন- 'দৃষ্টিপাত' নামে। বইয়ের প্রধান চরিত্র মিনি বা পোটলা বলা যেতে পারে। সে ব্যারস্টারি পড়তে চায়। তিনি একটা পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন দিল্লীতে। 'দৃষ্টিপাত' কোনো প্রেমের উপন্যাস নয়। রাজনীতি নয়, রম্য গল্পও নয়। চিঠি নয়। নিছক কোনো গল্প নয়, আবার ভ্রমন কাহিনীও নয়। ডায়েরী নয়। জীবনদর্শন নয়। আমি বলব, যা মন চায়- লেখক শুধু লিখে গেছেন। বিনয় মুখোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম ছিলো- যাযাবর। দীর্ঘদিন মানুষ জানতে পারেননি 'দৃষ্টিপাত' এর লেখক কে? যখন বইটি লেখা হয়- একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
বইটিতে সেই সময়ের দিল্লী শহর উঠে এসেছে।
লেখক দিল্লী শহরের সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন। বই পড়লে বুঝা যায় লেখক যথেষ্ঠ রসিক মানুষ। লেখা সহজ সরল প্রানবন্ত। বইয়ের শেষের দিকে কিছুটা প্রেম ভালোবাসার ছোঁয়া পাওয়া যায়। মারাঠি যুবক আধারকার এর সঙ্গে এক বিবাহিতা বাঙালিনী সুনন্দার প্রেমকাহিনী। মারাঠি যুবক প্রেমে পড়ে পড়তে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। 'দৃষ্টিপাত' বইটি প্রথম প্রকাশ করা হয় ১৯৪৭ সালে। সত্য কথা বলি, দৃষ্টিপাত বইটি আমার তেমন ভাল লাগেনি। কিন্তু কলকাতার লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই বইয়ের খুব সুনাম করেছেন। এজন্যই পড়েছি। লেখকের প্রথম বই 'দৃষ্টিপাত'। এই লেখক খুব বেশি লেখালেখি করেন নি। সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ৭টি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একবার আমেরিকা যান।
সময়টা তখন ১৯৯৭। সেখানে গিয়ে তিনি দৃষ্টিপাত এর লেখকের দেখা পেয়ে যান। যাইহোক, লেখক তার 'দৃষ্টিপাত' বইতে নারীদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। এই বইয়ের দুটা লাইন আপনাদের জন্য- 'আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ।' আরেক জাগায় লেখক বলেছেন- 'মানুষের জীবন যখন জটিল হয় নি, তখন তার অভাব ছিল সামান্য, প্রয়োজন ছিল পরিমিত'।
১৯৫০ সালে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বই হিসেবে-
'দৃষ্টিপাত' নরসিংহ দাস পুরস্কারে সন্মানিত হয়। ১৯৬০ সালে এর হিন্দী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। লেখক সাহিত্যকীর্তির জন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর পুরস্কার পান। দৃষ্টিপাতের শেষ লাইনগুলি এখনও অনেক পাঠকের মুখস্ত আছে: প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার। মাত্র ৯৭ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস একটি পরকীয়া প্রেমের উপাখ্যান বলাটা অন্যায় হবে না।
বিনয় কুমারের জন্ম বাংলাদেশে।
চাঁদপুরের জুবিলি স্কুলে তার পড়াশোনা। তার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বিনয় সবার বড়। তিনি কলকাতা থেকে বি এ পাশ করেন। ছাত্র থাকাকালীন তিনি গান লিখতেন। কর্ম জীবনে দৈনিক পত্রিকায় 'শ্রী পথচারী' ছদ্মনামে রাজনৈতিক কলাম লিখতেন। ক্রিকেট খেলা নিয়ে তার দুটা বই রয়েছে। ২০০২ সালে এই লেখক দিল্লীতে ইন্তেকাল করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:০৭